নিউ ইয়র্ক থেকে:-
এ যে আমারই ‘উত্তরাধিকার’!
ঘর থেকে বের হয়েছি পঁচিশ দিন হয়ে গেলো!আট দিন নেপালে, সাতদিন শান্তিনিকেতনে।আর বাকি দিনগুলো এই দার্জিলিং-এ। কিন্তু মনে হয় এইতো এলাম সেদিন। আসলে সুখের দিনগুলো চলে যায় নিমিষে, যেভাবে গেল আমাদের গত পঁচিশ দিন। আর দুঃখের দিনগুলো আটকে থাকে, গলায় বেঁধে যাওয়া কাঁটার মতো!
কাল চলে যাবো কলকাতায়।তার পরের দিন ঢাকায়।
বিদায় দার্জিলিং!
বিদায় জলপাইগুরি!
বিদায় শিলিগুড়ি!
বিদায় শান্তিনিকেতন!
বিদায় কোলকাতা!
সন্ধ্যের পরে মাকে নিয়ে বসেছি হোটেলের পেছনের বারানদায়। সামনে কুয়াসাঘেরা বন-বনানী। পেছনে সারি সারি পাহাড়।আরো দূরে কানচনজংঘা! আমাদের সামনের টেবিলে ‘স্যাম্পেন অফ দি টি’- দার্জিলিং চা আর গরম গরম সিঙ্গারা।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘মা,কেমন লেগেছে আমাদের এই ভ্রমণ?
মা বললেন- ‘ভালো, খুব ভালো’!
আমি বললাম,’কোন কোন জায়গাগুলো তোমার ভাল লেগেছে’!
মা বললেন,’ধূলিখেলে কানচনজংঘা আর শান্তিনিকেতনের প্রার্থনা ঘর আমার খুব ভালো লেগেছে!ভাল লেগেছে দার্জিলিংয়ের পুরোটাই!এখানে না আসলে কখনোই বুঝতাম মানুষ কিসের টানে দার্জিলিংয়ে আসে।যেমন প্রকৃতি!তেমনিই হাওয়া!তেমনি জলবায়ু!আমরা আবার এখানে বেড়াতে আসবো’!
মা’র চোখে মুখে উচ্ছাস!আনন্দ!ভাল লাগা!এ আনন্দ নির্মল!এ আনন্দ স্বর্গীয়! মা’র রুচি ফিরে এসেছে, উদ্যম ও ফিরে এসেছে পুরোপুরি। বিধাতাকে অশেষ ধন্যবাদ।
আমি বললাম- ‘সময় ও সুযোগ করে অবশ্যই আমরা আবার এখানে বেড়াতে আসবো! অথবা যাবো অন্য কোথাও’!
বিদগ্ধ পাঠক, একসাথে আমাদের আর যাওয়া হয়নি কোথাও! মায়ের সাথে ওটাই ছিল আমার শেষ ভ্রমন! দেশে ফেরার বছর দুয়েক পরে আমি পাড়ি জমালাম আমেরিকায়, উচ্চশিক্ষার জন্যে। মা রইলেন দেশে। এরই মধ্যে আমার উচ্চশিক্ষা হলো, ডিগ্রী হলো, যশ প্রতিপত্তিও হলো কিছুটা!
কিন্তু একদিন মা চলে গেলেন! অন্য এক ভ্রমনে, অন্য এক ভুবনের উদ্দেশ্যে শুরু করলেন তার অন্তহীন ভ্রমন! যে ভ্রমনে কোন সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না, যে ভ্রমন থেকে কেউ ফেরেনি কখনো, ফেরেননি মা’ও।
এরপরে আমি একা,বন্ধু-বান্ধব অথবা স্ত্রী পরিজন সহ ঘুরে বেড়িয়েছি কত অজানা দ্বীপে,কত অজানা দেশে আর কত অজানা জনপদে!কিন্তু মায়ের সাথে সেই অদ্ভুদ ভ্রমণের স্মৃতি আজও আমাকে নাড়া দেয়। এ যেন আমার স্মৃতির মনিকোঠায় এক অমূল্য সঞ্চয়!
পুনশ্চ:
আমার দুছেলে ফারহান ও ফারদিন, বয়সে ওরা খুবই ছোট।
ঠিক করেছি যখন ওরা বড় হবে, একদিন এক বসন্ত বিকেলে সন্তর্পণে ওদের দু’জনকে আড়ালে ডেকে বলবো- ‘যাও, তোমাদের মাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসো, দূরে কোথাও,অজানা অচেনা কোথাও। আমার মতো তোমরাও পেয়ে যাবে সেইসব অদ্ভুত ভ্রমনের কিছু অমূল্য স্মৃতি। জীবন চলার কঠিন পথে যার উপস্থিতি খুবই জরুরী!
একমনে ভাবি,ওরা কি আমার কথা শুনবে!হয়তো শুনবে না!আবার আরেক মনে ভাবি,আমি নিশ্চিত ওরা আমার কথা শুনবে।কেননা এ যে আমারই ‘উত্তরাধিকার’!
সেইসব অদ্ভুত ভ্রমন
সিনহা মনসুর।