নিউ ইয়র্ক থেকে:-

ধূলিখেল:হিমালয়ের মুখোমুখি অপূর্ব এক শহর!
আমরা ঘুম থেকে উঠেছি ভোর ৩টায়। হোটেল ম্যানেজারই আমাদের উঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে চলে এলাম হোটেলের লবীতে। সেখানেই অপেক্ষা করছেন আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার,গনেশ থাপা।আমরা যাবো ধূলিখেল।

sinha3b

দুটি কারনে ধূলিখেল নেপালের মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে।প্রথম কারনটি হচছে ধূলিখেল একটি দর্শনীয় জায়গা। কাঠমুন্ডু থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে তিব্বত বর্ডার এর কাছাকাছি একটি শহর। ধূলিখেল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫৫০ মিটার উচুতে। এখান থেকে হিমালয়ের অনেকগুলো শৃঙ্গ খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়।এর মধ্যে আছে পশ্চিমের অন্নপূর্ণা খেকে পূবের কারুলাং!মাঝে আরো প্রায় বিশটি পর্বত শৃঙ্গ!এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচছে:
অন্নপূর্ণা,গনেশ হিমালয়,মাউনট ল্যাংটেনট ও মাউনট গৌরিকিশোর।

দ্বিতীয় কারনটি হচছে নেপালের দুটি মেইন হাইওয়ে এই ধূলিখেলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।একটি হচছে বি.পি হাইওয়ে।আরেকটি হচছে আর্নিকো হাইওয়ে।নেপালের রাজধানী কাঠমুনডু থেকে তিব্বতের সীমান্তবর্তী শহর কোডারিকে সংযুক্ত করেছে এই আর্নিকো হাইওয়ে।ধূলিখেল খেকে কোডারির দূরত্ব প্রায় ৭৪ কিলোমিটার।

প্রত্যুষে হিমালয়ের পেছনে খেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য নাকি অপূর্ব এক মহিমা তৈরি করে।ওই মহিমা স্বচক্ষে দেখার উদ্দেশ্যেই এই সাঝ-সকালে আমাদের ধূলিখেল যাত্রা!সূর্যোদয়ের আগেই আমাদেরকে পৌছুতে হবে ধূলিখেল-এর অবজারভেশন ডেকে।
তাই কফি হাতেই উঠে পড়লাম গাড়িতে।দশ মিনিটের মাথায় গাড়ী পরলো পাহাড়ী রাস্তায়। অর্নিকো হাইওয়ে ধরে গাড়ী এগিয়ে চললো। ১১৫ কিলোমিটার লম্বা এই হাইওয়ে!আমরা ভ্রমন করবো ৩২ কিলোমিটার।আঁকাবাঁকা পাহাডী পথ।

sinha3

অর্নিকো হাইওয়ে উঠার পর পরই মুখ খুললো আমাদের গাইড গনেশ থাপা।
গনেশ থাপা ইংরেজীতে বললো,’আমি কি ইংরেজীতে কথা বলবো না হিন্দিতে’?
আমি বললাম,’আপনি বাংলা পারেন’?
গনেশ থাপা লজ্জিত হয়ে বললো,’না, তবে যে হারে বাংগালিরা নেপাল আসতে শুরু করছে তাতে খুব শীরঘই বাংলা শিখে ফেলবো’!
আমি বললাম,’আপনি ইংরেজি-হিন্দি যেকোন ভাষায় বলতে পারেন’।

গনেশ থাপা হিন্দিটাকেই বেছে নিলো।তবে আপনাদেরকে বলবো বাংলায়।
গনেশ থাপা বললো,’নেপালে যতগুলা হাইওয়ে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচছে এই আর্নিকো হাইওয়ে!পদে পদে বাঁক আর স্লোপ এগুলো হচছে ঝুকির প্রধান কারন। বৃসটি হলে এই রাস্তা আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।১৯৬০ সালে চাইনিজরা আমাদেরকে এই রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে।এই রাস্তা ধরে ৫০ কিলোমিটার এগুলেই চোখে পড়বে ‘সাইনো-নেপাল ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ’।ওই ব্রিজ কানেকট করেছে ‘চায়না ন্যাশনাল হাইওয়ে’তে।ওটা চলে গেছে তিব্বতের লাসার দিকে। সেখান খেকে সাংহাই’।
আমি বললাম,’তার মানে এই রাস্তা ধরে আগালে তিব্বত আর চীন দু’দেশেই যাওয়া যাবে’!
গনেশ থাপা বললো,’আলবৎ’!

মা জিজ্ঞেস করলেন,’হিমালয় কি ভারত আর নেপালেই আছে না অন্য কোন দেশেও আছে’?
থাপা বললো,’আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, চীন, নেপাল ও ভূটান এশিয়ার এই পাঁচ দেশে বিস্তৃত এই হিমালয়!এই পর্বতমালা তিব্বতীয় মালভুমি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে পৃথক করেছে। হিমালয়ের প্রধান প্রধান শৃঙ্গমালা আফগানিস্তান ও মায়ানমারের সীমান্ত মধ্যবর্তী প্রায় ৩০০০ কিমি স্থান জুড়ে বিরাজমান’!

থাপা আরো বললো,’হিমালয় আমাদের জীবন’!
মা বললেল,’সেটা কিরকম’?
উততরে থাপা বললো,’কি জানেন মাইজি, হিমালয় পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে এসেছে এশিয়ার তিনটি প্রধান নদী।এগুলো হচছে:সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র।তার থেকে কত শাখা-প্রশাখা।এইসব নদীর পারে গডে উঠেছে সভ্যতা, গডে উঠেছে সংস্কৃতি।এই নদীগুলোর সাথে জডিয়ে আমাদের অস্তিত্ব।আর তাইতো,হিমালয় আমাদের জীবন’!
আমি মনে মনে ভাবলাম কথাটা ওভাবে কখনো ভাবিনি।কিনতু কথাটা দিবালোকের মতো সত্যি!

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা চলে এলাম ধূলিখেল। এখন সময় চারটা বিশ।চারদিকে হাল্কা অন্ধকার।সূর্য উঠবে চারটা একান্নোতে।এখানে পাহাড়ের উপরে রয়েছে অবজারভেশন ডেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫০০ মিটার উপরে।

আমাদের গাইড বললো- ‘তোমাদের ভাগ্য ভালো আজ কুয়াসা নেই, কুয়াসা থাকলে চারপাশ দেখা যায় না তেমন একটা।’

sinha3a

অবজারভেশন ডেকে মা আর আমি দাড়িয়েছি পাশাপাশি, আমাদের সাথে আছে আরো প্রায় শ’খানেক ট্যুরিষ্ট। আমাদের বায়ে,ঢালু হয়ে পাহাড়টা গিয়ে মিলেছে দুরের সমতলে, ডানে বহু দূরে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে কিছু গুচ্ছ গ্রাম। আর সামনেই(আসলে বহুদূরে!) দেখা যাচ্ছে হিমালয়!

অবজারভেশন ডেক থেকে আমরা তাকিয়ে আছি হিমালয় পর্বতমালা দিকে।আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে জন্ম নিয়েছে ওই হিমালয়।’হিম’ আর ‘আলয়’ এই দুটি শব্দ খেকে এসেছে হিমালয়!হিম কথাটির অর্থ ‘বরফ’।আর আলয় কথাটির মানে ‘ঘর’।তার মানে হিমালয় হচছে ‘বরফের ঘর’।

অবাক বিসনয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি প্রতিটি শৃঙ্গের মাথায় শ্বেত শুভ্র বরফ।মনে হচছে চূডাগুলো যেন লাইন ধরে দাডিয়ে আছে। বিশাল ধ্যানে মগ্ন।বিধাতার সনে!

গাইড বললো- ‘ঐ যে ডানপাশে ওটা হচ্ছে ‘অন্নপূর্ণা’!বামদিকে ওটা,ওটা হচছে ‘গনেশ হিমালয়’!আর তার পাশেরটাই ‘গৌরীশংকর’!
ওগুলো হচ্ছে হিমালয়ের একেকটা পর্বতশৃঙ্গ। শৃঙ্গগুলোর মাথায় বরফ জমেছে। অদ্ভুদ শ্বেতশুভ্র ওই পর্বত শৃঙ্গগুলোর রং।

এখন সময় চারটা ছাপ্পানন।শ্বেতশুভ্র ওই পর্বত শৃঙ্গগুলোর উপরে প্রথমে দেখলাম হালকা সোনালী আভা।
মা আমাকে বললেন- ‘দেখ, দেখ পাহাড়ের পেছনে সূর্য্য উঠছে!’

দেখতে দেখতে অন্নপূর্ণা, গনেশ হিমালয় আর গৌরীশংকর ‘শ্বেত শুভ্র বরফে’র পাহাড় থেকে হয়ে গলো ‘সোনালী পাহাড়’! সূর্য্যের আলো পড়ছে ওই সোনালী চূড়োগুলোতে। আর সেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। ওই আলো শুদ্ধতার, স্নিন্ধতার আর সততার! সৃষ্টির শুরু থেকে এই আলোই শুদ্ধ করেছে এই ধরনীর মানব-মানবীকে। রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করেছিল এই স্নিদ্ধতা!আর এই শুভ্রতা!আর তাইতো তিনি লিখতে পেরেছিলেন:
‘আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রানের পর
কেমনে পশিল গুহার আধারে প্রভাত পাখির গান।
না জানিরে কেনরে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ’!

ভোরের প্রথম আলোয় মা জডিয়ে ধরলেন আমাকে।আমিও মায়ের কাঁধ স্পর্শ করলাম!
এ স্পর্শ নির্ভরতার!
মাও আমার মতো আনন্দিত ও উচ্ছসিত।
যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি ও আমরা নেপাল এসেছিলাম- সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মা- হাসতে শুরু করেছেন, হাসাতেও শুরু করেছেন। কথার ফুলঝুড়ি ছোটাচ্ছেন!
ঢাকা থেকে আসার সময় ভারতের ভিসা নিয়ে এসেছিলাম।
মা’কে বললাম- ‘মা,চলো দার্জিলিং আর শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে আসি। হাতে তো ছুটি আছেই।’

মা রাজি হলেন সানন্দে।ভোরের প্রথম আলো হিমালয়ের চূডো ছুঁয়ে এসে পড়লো আমার দু’চোখে!সেখানে চিক চিক করছিল কয়েকফোঁটা আনন্দের অশ্রু!

চলবে… … …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন