নিউ ইয়র্ক থেকে:-

প্রার্থনা সংগীত!
আগামীকাল বুধবার।শান্তিনিকেতনে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কোন ক্লাস নেই।আছে প্রার্থনা সংগীত। খুব ভোরে।
মা’কে বললাম,’যাবে নাকি প্রার্থনা সংগীত শুনতে’?
মা বললেন,’অবশ্যই যাবো’!
ঘুম থেকে উঠে আমরা যথারীতি রওয়ানা দিলাম ক্যাম্পাসের দিকে।আমরা ক্যাম্পাসের পৌছুলাম সকাল সাডে ছ’টায়।অবাক বিস্ময়ে দেখলাম,এত ভোরেও ঘুম ভেঙে ছাত্রছাত্রীরা লাইন ধরে উপাসনা গৃহে আসছে।সবাইকে আসার জন্য আহ্বান করে ঘণ্টাতলায় কিছুক্ষণ পরপর ঘণ্টা বাজানো হচছে।

sinha9b

সাতটা নাগাদ প্রার্থনা ঘর ও তার আংগিনায় ভ’রে গেল।সবাই বসেছে প্রার্থনা ঘরের মেঝেতে।সকালের হাল্কা রোদ,হালকা বাতাস, আর চারদিকে পাখির কলতান।বাতাসে সদ্য ফোটা ফুলের সুবাস। কী যে সুন্দর এই সকাল!
এরি মধ্যে শুরু হলো আজকের আয়োজন।

শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বিজয়া-সম্মিলন’ থেকে পাঠ করে শোনানো হলো।যিনি পাঠ করলেন বড গম্ভীর আর সুরেলা তার গলা!গম্ভীর আর সুরেলাও কন্ঠে তিনি বলে গেলেন:

‘মনে রাখিতে হইবে, আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে ইহা রাজার কোনো প্রসাদ বা অপ্রসাদে নির্ভর করে না।কোনো আইন পাস হউক বা না হউক, বিলাতের লোক আমাদের করুণোক্তিতে কর্ণপাত করুক বা না করুক, আমার স্বদেশ আমার চিরন্তন স্বদেশ।আমার পিতৃ পিতামহের স্বদেশ, আমার সন্তানসন্ততির স্বদেশ, আমার প্রাণদাতা শক্তিদাতা সম্পদদাতার স্বদেশ।কোনো মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিব না,কাহারো মুখের কথায় ইহাকে বিকাইতে পারিব না।একবার যে হস্তে ইহার স্পর্শ উপলব্ধি করিয়াছি সে হস্তকে ভিক্ষাপাত্র বহনে আর নিযুক্ত করিব না।সে হস্ত মাতৃসেবার জন্য সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করিলাম’!

আজ থেকে প্রায় একশত বারো বছর আগে কথাগুলো লিখেছিলেন রবিঠাকুর,সেই ১৯০৫ সালে!অথচ মনে হলো এইতো সেদিন-এর লেখা।এখনকার জন্যই লেখা!বড ভাল লাগলো।

‘বিজয়া-সম্মিলন’ শুনে আমি প্রার্থনা ঘরের বাইরে এলাম।ওখানে দেখা হলো অভিজিৎ রায়ের সাথে।
আমাকে জিজ্ঞেশ করলো,’আর ক’দিন আছেন’?
আমি বললাম,’আজ রাতে চলে যাবো’।
‘ঢাকায় যাবেন’? পাল্টা প্রশ্ন অভিজিৎ-এর।
আমি বললাম,’না,আমরা যাবো দার্জিলিংয়ে’!
অভিজিৎ বললো,’ভাল,খুব ভাল’!

ভেতরে প্রার্থনা সংগীত শুরু হয়েছে। সমবেত স্বরে প্রার্থনা সংগীত গাইছেন বিশ্ব ভারতীর ভবনের শিক্ষার্থীরা।
দূর থেকে কানে ভেসে আসছে……..

‘আজি শুভক্ষণে পিতার ভবনে
অমৃত সদনে চলো যাই
চলো চলো – চলো যাই।’

মা সবার সাথে বসে আছেন প্রার্থনা ঘরের মেঝেতে।আমিও নি:শব্দে গিয়ে বসলাম মা’র পাশে।শিল্পীরা নতুন গান ধরেছে।

‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলি,
শোন শোন পিতা কহ কানে কানে,
শোনাও প্রাণে প্রাণে, মঙ্গল বারতা’।

এবার ওরা ধরলো-

ভেঙে মোর ঘরের চাবি
নিয়ে যাবি কে আমার
ও বন্ধু আমার!

না পেয়ে তোমার দেখা,
একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–

সমুখে ওই হেরি পথ,
তোমার কি রথ
পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥

আকাশের যত তারা
চেয়ে রয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।

প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে–
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে ॥

বাগানে সদ্য প্রস্ফুটিত জেসমিনের গন্ধ আর রবীঠাকুরের সুরেলা সুরে ঘোর লেগেছে শান্তি নিকেতনের বাতাসে। এই গানগুলো আমি আগেও শুনেছি বহুবার!কিন্তু আজকের এই পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মনে হচ্ছে এক অলৌকিক আয়নার মুখোমুখি দাডিয়ে আমরা।ওই আয়না টা হচছে আমাদের মন!

মা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন- ‘তোর কি মন খারাপ?’
আমি বললাম- ‘না মা,মন খুব ভালো হয়েছে।’
‘তাহলে কাঁদছিস কেন ?
আমি বললাম- ‘মা, সব সময় কি শুধু মন খারাপেই কি কাঁদতে হয়? মাঝে মাঝে মন ভালোতেও কাঁদতে হয়’!

sinha9a

সংগীত শেষে আমরা সবাই প্রার্থনা ঘর থেকে লাইন ধরে বাইরে বেডিয়ে এলাম।ছাত্র-ছাত্রীরা চলে যাচছে হোসটেলে। আমরা পা বাড়ালাম টুরিষ্ট লজের দিকে।আজ রাতের ট্রেনে আমরা চলে যাবো জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে দার্জিলিং!
আবার কবে কখন শান্তিনিকেতন আসবো জানি না।কিনতু শান্তিনিকেতনের এই দিনগুলো রয়ে যাবে স্মৃতিতে অম্লান!

সিনহা মনসুর।
চলবে… …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন