এক সময় ছিল যখন অনেক আগ্রহ নিয়ে শিকারের কাহিনী পড়তাম। প্রিয় লেখক ছিলেন জিম করবেট। “রুদ্রপ্রয়াগের চিতা” নাম দিয়ে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তার বইয়ের বাংলা অনুবাদ দিয়ে শুরু হলেও পরে জিম করবেটের সবগুলো ইংরেজি বই পড়েছি। শিকারী কেনেথ এন্ডারসনের কোনো বইও বাদ পড়েনি। পড়েছি সুন্দরবনের বিখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজীর বই। শিকারের সত্যিকার কাহিনী হলেও ক্ষণজন্মা এই মানুষগুলো বন-জঙ্গলের ভিতরের প্রাকৃতিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অদ্ভুত এক মমতায়। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে শিউরে উঠতাম ভয়ে অথবা বিস্ময়ে। কোনোদিন কল্পনাও করিনি যে এরকম বনের মধ্যেও তাবু খাটিয়ে মানুষ বসবাস করতে পারে মনের আনন্দে। শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিক জীবন থেকে বের হয়ে একাত্ম হয়ে যেতে পারে নির্মল প্রকৃতির সান্নিধ্যে। ক্যাম্পিং নিয়ে আমার নিজেরও কিছু ভুল ধারণা ছিল। ক্যাম্পিং, ক্যাম্প সাইট, ন্যাশনাল পার্ক, টেন্ট এই শব্দগুলোর সাথে কেন জানিনা বন্য জীব জন্তু আর পোকামাকড়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেতাম। বছর তিনেক আগে কানাডায় আমাদের অতি ঘনিষ্ট দুই অগ্রজ হাফিজ ভাই এবং হুমায়ুন ভাই আমার এই ভ্রান্ত ধারণার অবসানের ব্যবস্থা করেন। উনাদের উৎসাহে Wheatly প্রভিন্সিয়াল পার্কে ক্যাম্পিং এর মধ্যে দিয়ে নুতন এক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। সেই থেকে প্রতি বছরই আমরা কয়েকটি পরিবার একসাথে ক্যাম্পিংয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এবারও কানাডা ডের লং উইকেন্ডকে সামনে রেখে টরন্টো থেকে তিনশত কিলোমিটার দূরত্বে  Grundy Lake প্রভিন্সিয়াল পার্কের দুটো ইলেকট্রিক সাইট ক্যাম্পিংয়ের জন্য প্রায় ছয়মাস আগেই হাফিজ ভাই ভাড়া নিয়ে রাখেন। শুধু ক্যাম্প সাইট নয়, আয়েশ করে থাকার জন্য অনেক খুঁজে একটি RV ও বুকিং দিয়ে রাখেন হাফিজ ভাই। এই জাতীয় বিষয়ে সিদ্ধহস্ত হুমায়ুন ভাই ক্যাম্পিং এ কাজে লাগবে এরখম সব সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ শুরু করে দেন অনেক আগে থেকেই।

অবশেষে কানাডা ডে এর আগেরদিন, শুক্রবারে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বৃষ্টিস্নাত সকাল পেরিয়ে, পথে Tim ব্রেক নিয়ে প্রায় তিনশত পঁচিশ কিলোমিটার ড্রাইভ করে পার্কের কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়লো বড় করে লেখা সাইনবোর্ড “You are in Bear Country”।পুলকিত না শিহরিত হবো ভাবতে না ভাবতেই গাড়ি এসে থামলো grundy প্রভিন্সিয়াল পার্কে প্রবেশের মূল গেটে। ঘড়িতে তখন বেলা আড়াইটা। তাবু খাটানো, RV তে মহিলা, বাচ্চাদের আগামী তিন রাত থাকার আয়োজন এবং বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবার শেষে সবাই যার যার মতো করে আশেপাশের বন্দোবস্ত যেমন, ওয়াশ/শাওয়ার রুম, পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই চোখে পড়লো গভীর জঙ্গলের মধ্যে আধুনিক সুবিধাসমৃদ্ধ ওয়াশ/ শাওয়ার কমপ্লেক্স। ভিতরে যেয়ে দেখলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই কমপ্লেক্সে ছোট একটি লন্ড্রি সেকশন ও আছে। এরই মধ্যে আমাদের গ্রূপের আর এক সদস্য রইস আব্দুল্লাহ ভাই যিনি মাছ ধরাকে মোটামুটি একটা ধ্যান এবং শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তিনি ততক্ষনে আশপাশটা দেখে লেকের কোন জায়গায় বড়শি ফেলা যায় তা স্থির করে ফেলেছেন। আমরাও রইস ভাইয়ের পিছু নিলাম মৎস শিকার প্রত্যক্ষ করার আশায়। ঘন্টা দেড়েকের চেষ্টা শেষে ক্যাম্প ফায়ারের কাঠ কেনার জন্য যেতে হলো পার্ক অন্টারিওর অফিস/স্টোরে। ততক্ষনে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাঁবুর মধ্যেই নামাজ পড়া শেষে ক্যাম্পফায়ারের জন্য কাঠে আগুন জ্বালানোর চেষ্টার মধ্যেই ভাবীদের সৌজন্যে ছোলামুড়ি এবং চায়ের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। আশেপাশের ক্যাম্পগুলোতেও তখন ক্যাম্পফায়ার চালু হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার ফ্ল্যাশলাইট জেলে হাটতে বের হয়েছেন। মাঝে মাঝে পার্ক অন্টারিওর গাড়িও চোখে পড়লো যারা ক্যাম্পসাইট এ  অবস্থানরত মানুষদের নিরাপত্তা এবং নির্বিগ্নতা নিশ্চিত করার জন্য সারারাত টহল দিয়ে বেড়ায়। মানুষের হই হুল্লোড় না থাকলেও মশার সরব উপস্থিতি ভালোই টের পাচ্ছিলাম যদিও স্প্রে, রেপেলেন্ট, ক্যাম্প ফায়ারের ধোঁয়া এবং মশার কয়েল (হুমায়ুন ভাইয়ের সৌজন্যে বাংলাদেশ থেকে আনা) এর কারণে মশক সমাজ খুব সুবিধা করতে পারছিলোনা। ক্যাম্পফায়ার ঘিরে গল্পগুজব এবং খাওয়া দাওয়ার পাঠচুকিয়ে দীর্ঘ দিন শেষের ক্লান্তিতে চোঁখের পাতা ভারী হয়ে আসছিলো সবার। মহিলা এবং বাচ্চারা সব RV (recreational Vehicle ) তে আর বাকি সবাই আমরা কাছাকাছি আর এক সাইটএ অনেক যত্ন এবং সময় নিয়ে মজবুত করে টাঙানো তাঁবুতে ফিরলাম। ঝিঝি পোকার ডাক, মানুষের প্রায় নিঃশব্দ পদচারণা, থেকে থেকে বন থেকে ভেসে আসা অজানা পাখির ডাক শোনা আর “আপনি এখন ভালুকের দেশে”র  সতর্ক বাণী মনে করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি মনে নেই।


বৃষ্টির উপদ্রবে পরিকল্পনা কিছুটা ব্যাহত হলেও আমাদের পরবর্তী দুটি দিন কেটেছে তাবু অথবা RV তে বসে গল্প গুজব, অন্নান্য ক্যাম্পসাইট ঘুরে ঘুরে দেখা, পার্শবর্তী ছোট শহর ‘ব্রিট’ দেখা, ফ্রেঞ্চ রিভার পরিদর্শন, মাছ ধরা, বার্বিকিউ আর ক্যাম্পফায়ারের আড্ডায়। ক্যাম্পিং বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা সীমিত হলেও আমার পর্যবেক্ষণে তিন ধরণের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ ক্যাম্পিং এ আসে। এক. শহরের যান্ত্রিক, ত্রস্ত, ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাঠানো। দুই. স্রেফ নিজের শারীরিক, মানসিক প্রশান্তির জন্য নিরুপদ্রব পরিবেশে থাকা।আমাদের ক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থানরত এক ভদ্র মহিলাকে দেখলাম ক্যাম্পফায়ার পাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়তে।সাহস করে কাছে যেয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলাম উনি লেখক কিনা। স্মিত হাস্যে উত্তর দিলেন, “No,  iam not a writer. This is my way of relaxation” । তৃতীয় আর এক গ্রূপ আছেন আমার মতো যাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই। তারা হচ্ছেন ‘চলো যাই, ঘুরে আসি’ গ্রূপের সদস্য। এনাদের খাবার দাবারের বিশাল আয়োজনের ভিড়ে ক্যাম্পিং এর আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় যে ক্যাম্পিং এর জন্য খাবার না খাবারের জন্য ক্যাম্পিং। আন্দাজ করতে পারছি যে বেঁচে থাকলে আগামী ক্যাম্পিং এ এই লেখার কারণে আমার জন্য খাবারের কঠিন রেশনিং হবে। স্বীকার করি ক্যাম্পিং এ অনেক জায়গায় মাইলের পর মাইল খুঁজেও একটি টিম হর্টনের দেখা মিলে না, সেজন্য খাবারের যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়াই সমীচীন। কিন্তু সেই আয়োজনে বেশি সময় দিলে মূল আনন্দ উপভোগের সময়ে টান পড়ে। অবশ্য এবারের ক্যাম্পিংয়ে খাবারের আধিক্য ছিলোনা যদিও কলি/রুমা/মঞ্জু ভাবি এবং নওশীনের প্রচেষ্টায় ভুরিভোজন এবং চা নাস্তার কমতিও ছিল না।

মানুষ যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, আল্লাহ্পাক তার চারিদিকে অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রাখেন। অফুরান এই নেয়ামতকে চেনা এবং উপলব্দি করার জন্য আমরা এক এক জন এক এক ধরণের লেন্স ব্যবহার করি। আমার কাছে ক্যাম্পিং এর অভিজ্ঞতা এরখম একটি লেন্স ব্যবহার করার মতোই মনে হয়। শুধুমাত্র নিজের জন্যই নয়, ছেলেমেয়েদেরকে ইন্টারনেট আর টেক্সটিং এর খপ্পর থেকে বের করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে এনে বাস্তব জীবনের পাঠদানেও ক্যাম্পিং এর জুড়ি নেই। ‘ওয়াই ফাই’ এর সংযোগ না থাকলেও ক্যাম্পিং আমাদের জন্য ‘অপার্থিব সংযোগের’ এক পরিবেশ তৈরী করে দেয়। ফলে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে নূতনভাবে আবিষ্কার করি, খুঁজে পাই জীবনের নুতন অর্থ ও প্রেরণা। বিমূর্ত হয়ে উঠে তখন জঙ্গলের দিন রাত্রি।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন