ফ্লোরিডা থেকে:-
১৯৮২ সাল পর্যন্ত মাটিতে হেঁটেছি, জলে ভেসেছি আর দুলেছি হাওয়া ও হৃদয়ের দোলায়।জানালার ওপাশে গাছ, সেই গাছে পাখী, সেই পাখী ফৈর ফুলিয়ে ঠোঁট দিয়ে খুঁটেছে শরীর আর হাওয়া দুলিয়ে গেছে ডাল।ডাল যেন দোলনা, শৈশবের স্নেহমাখা দুধ-ঘ্রান-মুখ।
আমি ঘরে বসে বই পড়েছি , টিনের চালে শব্দ শুনেছি বৃষ্টির , আর আকাশে মেঘের সাথে ভেসে ভেসে কত কত স্বপ্ন দেখেছি, সামনের স্বপ্ন, ন্যায় সমাজ,শোষন মুক্তি , ভালো দিন ও ভালোবাসার দিন।
বন্ধুরা ছিল ।
যখন অনেক অনেক বন্ধু থাকে পাশে, আর থাকে পথ সামনে ,দৃষ্টির জোর থাকে অনেক দূরে তাকানোর ,তখন সময়টা আসলেই সুন্দর সময়। যখন সামনের পথ পেছনের পথ থেকে সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে, তখন বিষন্ন লাগে বৈকি। কিন্তু বিষন্নতায় বাস করা যায়না।
পাখী যেমন গাছের ডালে ফৈর ফুলিয়ে নিজস্ব দেহ খুঁটে দীর্ঘ সময় কাটাতে পারেনা, তাকে আবার উড়তে হয়।
উড়নেই জীবন।
আমার জীবন পাখীর মতই।
যেখানেই যাই বাসা বাঁধি ।
মধুপায়ী হামিং নয়, শ্রমজীবী বাবুই।
১৯৮২ সালে প্রথম মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ি, এরোফ্লত প্লেনে চড়ে মস্কোর পথে। সেকি রোমান্চ মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে যাওয়া, রূপসী বিমানবালাদের সহাস্য স্বপ্নিলতায়। তন্দ্রার দুলুনীতে দুলতে দুলতে পরিখা পার হয়ে যাওয়া। দেশ ও সংস্কৃতির পরিখাই শুধু নয়, জীবন পুস্তকের এক চ্যাপ্টারের পরিখা ছেড়ে অন্য চ্যাপ্টারে , ছুটি গল্পের ফটিকের গ্রাম ছেড়ে কলকাতা অথবা পথের পাঁচালীর অপুর নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কাশী চলে যাবার মত ।
যাবার সময় মনে হয় প্রস্থান ও প্রত্যাবর্তন একে অন্যের পরিপূরক কিন্তু সময় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে তা বাধ্যতামূলক নয়।
একে অন্যকে ছাড়াও চলতে পারে।
ফিরে না এসেও চলে যাওয়া যায়।
হোক তা হৃদয়ে বহু রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে ।জীবন মানেই অনুভূতি।
অনুভূতি নেই – মানুষ পাথর পাথরে বুক ঘষে।
যাহোক, সেই প্লেনে চড়ার দুদিন পরেই আমি পাতাল ট্রেনে নেমে গিয়েছিলাম অতল থেকে অতলে ,লেনিনগ্রাদের মেট্রোতে।
মাটি থেকে আকাশ, তারপরে আকাশ থেকে মাটি, বিস্ময়ের অবসান হবার আগেই এবার মাটি থেকে পাতালে! বিস্ময়ের পর বিস্ময় !
বিস্ময়েরই শহর লেনিনগ্রাদ।
যৌবনের শহর।
ভালোবাসার আকাংখার , অপ্রাপ্তি ও প্রাপ্তির শহর ।
মনে আছে ট্রেন লাইন গিয়েছিল নেভা নদীর নীচ দিয়ে।
কী দ্রুত গতি!
আর কী গতির শব্দ!
অন্ধকার টানেলের ভিতর দিয়ে ছুটেছে দৃষ্টি অন্ধ উন্মত্ত ষাড়ের মত।
সেই ট্রেনে থেকে অন্য ট্রেনে, সেই প্লেন থেকে অন্য প্লেনে চড়ে চড়ে, কখন জীবন চলে গিয়েছে পশ্চিমে।
অতিক্রম হয়েছে কত দেশ, কত নদী, মহাসাগর, ইতিহাস, দর্শন, ভুগোল !
পরিচয় হয়েছে কত মৃত্যু , হত্যা, ধর্ষন ও মানবতার অপমানের সাথে।
চোখে পড়েছে কত ধার্মিক , নাস্তিক , আস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী , ক্ষমতান্ধ, নির্মোহ বিপ্লবী আর কত কত হন্তা।
আর কত কত অন্ধ ও অন্ধকার !
কত গোরস্থান , শ্মশ্মান ও গনকবর!
স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা, আদর্শের কফিন কাঁধে কত কত মানুষ!
স্বপ্নচারী মানুষও দেখেছি অনেক! এখনও স্বপ্ন দেখে যারা মৃত মানবতার শ্মশ্মানে বসে। আর ভালোবাসায় বেপোরোয়া যুবক যুবতী কত কত প্রেমের কবিতা লেখে, সুর বাঁধে, হয়তো মানে উণ , কিন্তু হৃদয়ের অনিন্দ্য আকুলতার অপূ্র্ব ঝর্ণাধারায়!
১০৮ টি নীলপদ্ম তুলে আনার এখনও কত কত মৃত্যুন্জয়ী প্রত্যয়!
প্রশ্নে প্রশ্নে চিক চিক করে কত কত শিশুর চোখ! শিশু জন্মায় , মানে জীবন বয়ে চলে, বয়ে চলে নদীর মত।
জীবনের শেষ নেই।
সুতরাং আশা ও স্বপ্নের শেষ নেই।
দ্রোহ ও সংগ্রামের শেষ নেই ।
চলার শেষ নেই।
আমিও চলছি … চলছি… চলছি।
এবার নেমেছি জলের অতলে , মাউই দ্বীপে আটলান্টিস সাবমেরিনে ১৩০ ফুট নীচে ।
রংয়ের খেলা ভিন্ন সেখানে, যে রংয়ের বৈভব আমরা জলের উপরের পৃথিবীতে দেখি সব রং সেখানে নেই।
সেখানে পাখী নয় ,আছে মাছ।
মাছ গুলো এক্যুরিয়মের বর্ণালী ও ব্যতিক্রমহীন জীবনের নয়, সেখানে সতত অস্তিত্বের লড়াই , আছে হাঙর ও অক্টোপাস । কত ধরণের চোয়াল ও মৃত্যুর আলিঙ্গন । সেই মৃত্যুকে কাতুকুতু দিয়ে আছে বর্ণহীন কোরাল ও সমুদ্র শৈবাল।
আছে জীবন।
জয় হোক জীবনের!
আমি যাকে ভালোবাসি , যে আমার সন্ততিকে স্নেহে বেঁধে রাখার অম্লান ব্রততী,অনিন্দ্য ও অকল্ক, সে আছে পাশে।
আছি আমি।
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৮
শাহাব আহমেদ