২৪ জুলাই ২০১৯। দীর্ঘ ৯ ঘন্টা ট্রানজিটের পর আবার চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের বিমানে চেপে বসলাম। সঠিক সময়েই বিমান ছাড়লো। আমার স্ত্রী উইন্ডো সাইডে আসন পেয়ে খুব খুশি। বাইরে চীনের আকাশে তখন ঝলমলে রোদ। জানালা দিয়ে বাইরে অনেকদুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।
দীর্ঘপথ, দীর্ঘক্ষন বিমানে ভ্রমন করতে হলো। এরমধ্যে ২/৩ বার খাবার পরিবেশন করা হলো। মুসলমানদের জন্য হালাল ফুড। আগে থেকেই অর্ডার দেয়া। সবজী, মাছ, মুরগী, আলু, ফল, রুটি ও সালাদ। সব খাবারই সিদ্ধ। চায়নিজ ফ্ল্যাভারের জন্য আমার সহযাত্রী ওদের দেয়া খাবার খেতে পারেননি। ফল, চা- কফি, ফলের রস দিয়েই খাবার পর্ব শেষ করেছেন। আমার কিন্তু মন্দ লাগেনি। আমি খেয়িছি তৃপ্তিসহকারেই। সিদ্ধ করা স্বাস্থ্যসম্মত হালাল খাবার ভালোই লাগলো। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ সময়।
রূপায়ন টাউনের বাসা থেকে বেড় হয়েছি প্রায় ৩০ ঘন্টা। তখন মনে হচ্ছিল যে, বিমান থেকে নামতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচি। আর আমাদের একমাত্র নাতি আফনান সামাদের চিন্তাতো এক মিনিটের জন্যেও মন থেকে বিদায় করতে পারছিলাম না। প্রসংগটি আসলেই দুজন একেবারে চুপ। কারন, ও আমাদের ছাড়া থাকে না, আমরাও ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। ৩ বছর বয়স পার হয়েছে মাত্র! আমরা যেমন ওকে মিস করছি সে-ও আমাদের মিস করবে। হয়ত বলতে পারবেনা।
ততক্ষনে বিমান টরন্টোর আকাশ চক্কর দিচ্ছে। আমাদের বিমান কানাডার স্হানীয় সময় ০৬ঃ৩০ টায় টরন্টো পিয়ারসন বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার কথা। আমরা বিকেল ০৬ঃ০০ টায় ঘোষণা শুনলাম ০৬ঃ১৫ টায়ই বিমান ল্যান্ড করবে। প্রকৃতপক্ষে হোলও তাই। আলহামদুলিল্লাহ, বিকেল ৬ঃ১৫ টায় আমাদের বিমান টরন্টো পিয়ারসন বিমানবন্দরে অবতরণ করলো।
আমরা বিমান থেকে বের হলাম। পাশের সিটে বসা চায়নিজ হুয়ান থেকে বিদায় নিলাম। কোলাকুলি করে ছেলেটি ভাংগা ভাংগা ইংরেজিতে বললো, তোমাদের আমার খুব ভালো লেগেছে।
হুয়ানকে বিদায় জানিয়ে, মালপত্র বুঝে নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে এগুচ্ছি। সাথে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আলী আকবর। তিনিও সস্ত্রীক কানাডা বেড়াতে এসেছেন। তার ছেলে মুশফিক এখানে পি- এইচ.ডি করছে। গোয়াংজু বিমানবন্দরেই তার সাথে পরিচয়। এখন আরও ঘনিষ্ঠ হলাম আমরা।
ইমিগ্রেশনে পৌঁছে নিজের পাসপোর্ট নিজেই মেশিনে ঢুকিয়ে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি টাইপ করতে হয়। সব ঠিক থাকলে এক পিঠ সাদা আরেক দিকে রংগীন একটি রশিদ বের হয়। ওটা নিয়ে গেটের দিকে যেতেই ইমিগ্রেশন কাউন্টার। কানাডা পুলিশ পাসপোর্ট নেড়েচেড়ে দেখে, ইচ্ছে হলে দু’একটা প্রশ্ন করে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ওই রংগীন রশিদের কাগজটা গেটে জমা দিয়ে আমরা ট্রলি ও মালামাল নিয়ে এয়ারপোর্টের
বাইরে চলে আসি। বের হয়ে শত শত মানুষের মাঝেই ডাকতে থাকি খুরশিদ, আমরা এসে গেছি। লুনা, এই লুন্টি তোমরা কোথায়? অবাক করা কান্ড। সে নাকি আমার ডাক শুনেছে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে লুনা এসে হাজির, জড়িয়ে ধরে বোনকে। আমি জড়িয়ে ধরি খুরশিদকে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের মেয়ে আদৃতাকে। উল্লেখ্য, খুরশিদ আমার ভায়রাভাই এবং লুনা আমার শ্যালিকা। ওদের একমাত্র মেয়ে আদৃতা।খুরশিদ জানালো, ওরা ভাবতেই পারেনি এত তারাতাড়ি বের হতে পারব! ওরা ভেবেছিল, অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে।
সে যা হোক, খুরশিদ, লুনা আর আদৃতা বিমানবন্দরে আমাদের আন্তরিকভাবে বরন করে নিল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আলী আকবর ও তার ছেলে মুশফিকের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমরা গাড়িতে চেপে বসলাম। লুনাদের ২টি গাড়ি। এটি খুরশিদ ড্রাইভ করে, ভাল চালায়। সে ৪৫ মিনিট গাড়ি চালিয়ে ওদের হিরন পার্ক প্যালেসের বাড়িতে আমাদের নিয়ে এলো। কানাডার বিকেল ০৭ঃ১৫ টা হলেও আকাশে তখন চকচকে রোদ।
বাসায় ছিল ওদের ০২ ছেলে জারীফ আর আফীফ। ওরা আমাদের দেখে খুব খুশি হলো। জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পরে দেখা। বড়ো ছেলে জারীফ আবেগে কেঁদেই ফেললো।
বাসস্থান থেকে কানাডা পর্যন্ত আসতে যত কষ্ট, ক্লান্তি, বিরক্তি যেন এক নিমিষেই উড়ে গেলো। মাথয় রয়ে গেলো আফনানের চিন্তা। বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই ছেলের বউ (আমাদের মেয়ে) তাসমিয়া ভিডিও কল দিলো। আফনানকে দেখলাম মন খারাপ। আমাদের মুখ থেকেও কোনো কথা বের হচ্ছিল না।
হায়রে মায়া! হায়রে বন্ধন!!
# # #
@ডক্টর সামাদ সিকদার
*** ডক্টর মুহম্মদ আব্দুস সামাদ সিকদার, কবি–প্রাবন্ধিক ও গবেষক। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যাঃ ১৩।।