(চতুর্থ কিস্তি)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে ১৯৭৭ সনের শেষদিকে ঢাকা শহর ত্যাগ করি । কিন্তু লেখালেখি ছাড়িনি কখনো। শ্রীমঙ্গল কলেজের অধ্যাপনা এবং মফস্বল শহরে চাকুরী করে ১৯৯২ সনে ঢাকা ফিরে আসি। তখন আমার মুভমেন্ট বেড়ে যায়। রাজধানীতে এসে পত্রিকা অফিসে যাতায়ত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গমনাগমন, রেডিও-টিভি, সাহিত্যসভাসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৯২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত লেখালেখির জন্যে ছিল আমার সোনালি সময় ।
১৯৯২ সন থেকেই আমি বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য বা লাইফ ম্যাম্বর। আজীবন সদস্যকে বাংলা একাডেমি জীবনসদস্য বলে অভিহিত করে থাকে। বাংলা একাডেমি মনে করে এটাই সঠিক। আমাকে একাডেমির জীবন সদস্য হতে সহায়তা করেছেন কবি আশম বাবর আলী ( শ্রদ্ধেয় বাবর ভাই) । তিনি শুধু আমাকেই নয়, অনেককেই এসকল কাজে ও লেখালেখির ব্যাপারে সহায়তা করে থাকেন।
আরেকজনের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি, তিনি বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক গোলাম মঈনুদ্দীন ( প্রিয় মঈনুদ্দিন ভাই)। ঊনার মধ্যে কোনো আমলাতান্ত্রিকতা ছিল না। নিজে চেয়ার ছেড়ে, হাতে কাগজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ডেস্কে চলে যেতেন। যেমন চেহারা সুন্দর তেমনি তার মন ও কাজ ছিল চমৎকার! তিনি কথা বলতেন সুন্দর করে গুছিয়ে। তার সাথে কথা বলতে বা আড্ডা দিতে অনেকেই পছন্দ করতেন এবং তার অফিস কক্ষে ছুটে আসতেন। গোলাম মঈনুদ্দিন ভাই থাকাতে খুব সহজে ও কম সময়ে আমি বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য হয়ে যাই।
১৯৯২ সনে বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য হবার পর, সেই থেকে আজ পর্যন্ত , প্রতিটি বার্ষিক সাধারণ সভায় কমপক্ষে ২ টা করে প্রস্তাব (কৌশলে ৩/৪টাও) পেশ করে আসছি। সে প্রস্তাবগুলো যথেষ্ঠ গুরুত্ব সহকারে বাংলা একাডেমি ছেপেছে ও মন্তব্যের কলামে কোনো কোনো প্রস্তাবের জবাবও দিয়েছে। প্রেরিত প্রস্তাবের ওপর, একাডেমির বাজেট ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তৃতাও দিয়ে আসছি। একাডেমির কার্যবিবরণীতে অনেকের সাথে আমার বক্তব্যও ছাপা হয়েছে । এগুলো বই আকারে বরাবরই আমরা পেয়ে আসছি।
বাংলা একাডেমির সাথে আমার ২৯ বছরের সম্পর্ক । এরমধ্যে, পুরস্কার ছাড়া, বাংলা একাডেমি অনেক কিছু দিয়েছে। প্রতি বছর ১ টি ব্যাগ, কলম, ডাইরি, পরিচয়পত্র সহ গলায় ঝুলানোর ফিতা, বাজেট, কার্যবিবরণী ও প্রাপ্ত প্রস্তাবাবলি সম্পর্কিত বই প্রদান করে থাকে। ব্যাগের ভেতর আরও দিয়ে থাকে ডায়রি বা নোটবই, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকা ও জার্নাল। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত এসকল উপহার সামগ্রী ছাড়াও প্রতিবছর ৫০% কমিশনে কিছু কিছু বই ক্রয় করেছি । এখান একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলা একাডেমি ছাড়া এতো সস্তায় বোধ হয় আর কোথাও বই কিনতে পাওয়া যায় না ।
বাংলা একাডেমি আমার মনের ও পরিচিতির জগতকে বিস্তৃত করে দিয়েছে। বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভা একটি প্রাণচঞ্চল মিলনমেলা ৷ এখানে দেশের প্রায় সকল গুণিজনের দেখা মেলে। স্বাক্ষাত পাওয়া যায় চেনাজানা বন্ধু ও সহযোদ্ধার। অচেনা সুধিজনের সাথেও পরিচয় হয়, কথা হয়, ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় । চা-বিরতি ও দুপুরের খাবার সময়ে এধরণের সুযোগ বেশি পাওয়া যায়।
বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভার মধ্যাহ্ন ভোজের প্রসংশা করতেই হয়। ভালো খাবারের আয়োজন ছাড়াও মহাপরিচালক মহোদয়গন খাবার টেবিলে ঘুরে ফিরে যখন সদস্য, জীবনসদস্য ও ফেলোদের খোঁজখবর নেন ও কুশলবিনিময় করেন তখন বেশ ভালো লাগে। মনে হয় আমরা যেন কোনো এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাটের শাহী মেহমান।
বার্ষিক সাধারণ সভার সময় খাবার টেবিলে জমিয়ে আড্ডা হয়। দেখাসাক্ষাৎ ও ছবি তোলা হয়। তদবিরও হয় এখানে। ভিজিটিং কার্ড, মোবাইল নম্বর ও নিজেদের প্রকাশনা আদান-প্রদান করা হয়। কয়েক বছর যাবৎ আমাদের সাথে, বাবর ( কবি আশম বাবর আলী) ভাই ও দৈনিক সমাচারের আমিনুল আহসান ভাই ( যিনি ইন্তকাল করেছেন) য়ের সাথে, এক টেবিলে খেতে বসেন পুলিশ কর্মকর্তা ও যাদুশিল্পী সালাম সিকদার। তিনি আমাদের ছোট- খাটো যাদু দেখিয়ে ক্ষুধা বাড়িয়ে দেন। আশপাশের অনেকেই, আমাদের মতো, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তার কথা শুনেন ও যাদু দেখেন।
এবার, ২০১৯ সনের বার্ষিক সভায়, আমাদের খাবার টেবিলে আমাকে ছাড়া আর যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কবি আশম বাবর আলী, ভাষা গবেষক প্রফেসর অলী উল্লাহ, পুলিশ কর্মকর্তা ও যাদুশিল্পী সালাম সিকদার অন্যতম। এবারও যথারীতি সালাম সিকদার আমাদের নতুন নতুন যাদু দেখিয়ে অবাক করে দিলেন।
পাশের টেবিলে ছিলেন কবি আলমুজাহিদি, বিশিষ্ট ছড়াকার আলম তালুকদার ও ফারুক নওয়াজ। অদূরে মোনায়েম ভাই ( বিশিষ্ট রাজনীতিক আব্দুল মোনায়েম সরকার) আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন এবং সকলই উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে, আমাদের টেবিলে কিছু একটা হচ্ছে!
বলছিলাম, বাংলা একাডেমির সাথে আমার ২৯ বছরের সম্পর্কের কথা। সময় যত যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে আমার ঘরে বাংলাএকাডেমির সম্পদের বোঝা। হিসাব করে দেখতে পেলাম, শুধু বাংলাএকাডেমির বই প্রায় তিন শতাধিক। এছাড়া, অন্যান্য শতশত বইপত্রতো রয়েছেই। ফেলতে কি ইচ্ছে হয়? কিন্তু কী করি আমি, কী করি ?
কী করবো এগুলো? তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এখন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ক্রমে ক্রমে বিসর্জনের পথ বেছে নিচ্ছি ও ঘরের বোঝা হাল্কা করছি। আমার স্ত্রী এতদিন এ সম্পদ আগলিয়ে রেখেছিলেন, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন। জীবনে বহুবার বাসা বদলের ধকল তাকেই সইতে হয়েছে। চুপচাপ থাকা ও নিরবে কাজ করে যাওয়া ভদ্রমহিলা সেদিন আমার বিসর্জনের কান্ড দেখে বললেন , “একাজটি আরও আগে করলে ভালো হতো। আমার পরিশ্রম কিছুটা কম হতো। ”
বিষয়টি সরল না জটিল জানি না।
অনেক কিছু যেমন বুঝতে পারিনা এটিও উপলব্ধি করতে অক্ষম। একটা বই ফেলছি আর কষ্ট পাচ্ছি। একটি ক্রেস্ট বিসর্জন দিচ্ছি আর হৃদয়ের তার ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি জিনিসের পেছনে কতো স্মৃতি, কতো কষ্ট, কতো সময়, কতো আবেগ! মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ক্রেস্ট, শ্রেস্ঠ কর্মকর্তার ক্রেস্ট, প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথির ক্রেস্ট, শান্তনার ক্রেস্ট, বিদেশ প্রশিক্ষণের ক্রেস্ট, পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট এবং আরও কত কী? কোনোটা বেশ বড়, কোনোটা মধ্যম, কোনোটা সহনীয় সাইজের। বেসাইজেরও আছে ৩/৪ টা। তাই ক্রমেক্রমে নির্দয় হয়ে উঠছি । এক্ষেত্রে নির্দয় না হলে আর চলছে না।
আমি না থাকলে আমার এ সম্পদের অধিকাংশই কারও কোনো কাজে লাগবে না। কে আগলে রাখবে এগুলো ? আমিও এমন কী করতে পারলাম? কেবল বোঝা বহন করে গেলাম। কতো কিছু করবো ভেবেছিলাম, কিছুই তো করা হলো না । আর কিছু করতে পারবো বলেও মনে হয় না। জীবন নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু ভাবে, আমিও ভেবেছিলাম। সকলের সাধ কি পুর্ণ হয়? এক জীবনে আর কত! যা পেয়েছি তা-ও কম কীসে? এর জন্যে স্রষ্টার দরবারে লক্ষকোটি শুকরিয়া জানাই।
( ক্রমশঃ )
১৫-৫-২০২০
রূপায়ণ টাউন