( চতুর্দশ পর্ব )
০৮. কবি আশম বাবর আলীর কাব্যগ্রন্হ “অথচ একদিন”। প্রকাশকঃ ঢাকা আহছানিয়া মিশন ট্রাষ্ট। প্রচ্ছদ শিল্পীঃ হাশেম খান। পৃষ্ঠাঃ ৬৪, মূল্যঃ ৩০ টাকা।
কাব্যগ্রন্হটির রিভিউ করেছি আমি, সামাদ সিকদার। দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় ২০ চৈত্র ১৪০১ বঙ্গাব্দ, মার্চ ১৯৯৫ তারিখে প্রায় পৃষ্ঠাব্যাপী ” অথচ একদিন”-এর রিভিউটি প্রকাশিত হয়।
৫৫টি কবিতার সমন্বয়ে “অথচ একদিন”। সবক’টা কবিতাই ষাট থেকে আশি দশকের মধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থের শুরু ‘পুরাকীর্তি’ নামক কবিতা দিয়ে। রোমান্টিকতা ও শ্বাশত চিন্তার এক অপুর্ব সমন্বয় ঘটেছে এই কবিতায়।
আশম বাবর আলী তার কবিতায় বলেছেন, সব মানুষে প্রেম নেই। মানবী হলেই হৃদয় থাকে না। প্রেম নিয়ে চূলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন তার বিভিন্ন কবিতায়। কখনো বা অনুভব করেছেন তীব্র দহন।
” ভালোবাসা তোমার কাছে / পুতুল পুতুল খেলা,/আমার কাছে তীব্র দহন /চৈত্রের দুপুর বেলা ” (ভালোবাসা, পৃঃ ৪২)। প্রেম সে তো ভোলার নয়। নয় এক জনমেরও। তাইতো নীলাকে কবি ভুলতে পারেন না। জানতে ইচ্ছে করে — নীলা কোথায়, কেমন আছে, কী করে? নীলা কি আজও গুনগুন করে গান গায়?…
রবীন্দ্রনাথের বাঁশি কবিতায় ‘কিনু গোয়ালার গলি’-এর হরিপদ কেরানীর শতছিন্ন ছাতা আর আকবর বাদশার রাজছত্র যেমন একসাথে মিলে যায়, তেমনি কবি বাবর আলীর কবিতায় প্রিন্সেস দীনা ও রমেচা খাতুনের সহাবস্থান দেখি। এখানে, বাবর আলী আর রবীন্দ্রনাথ একই বৃত্তে এসে যেন দাঁড়িয়েছেন বিবেকের তাড়নায়।
“প্রিন্সেস দীনার সাথে/ মন্তাজ মিস্ত্রির মেয়ে রমেচা খাতুনের / কোনো প্রভেদ নেই-” (প্রভেদ নেই প্রেমে এবং রমণে, পৃঃ ৪১)।
বাবর আলীর কবিতায় নান্দনিক প্রেমের ছোঁয়া পাই। কখনোবা দার্শনিক তত্ত্বেরও সন্ধান মিলে তার কবিতায়। তার বর্ণনাভংগী ও কবিতার গতিময়তা প্রশংসার দাবিদার। “অথচ একদিন” কাব্যে ছন্দ নিয়ে অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন কবি। স্বরবৃত্তের প্রাধান্য থাকলেও অক্ষরবৃত্ত কিংবা মাত্রাবৃত্তেও স্বাচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন কবি এখানে। আধুনিক গদ্য কবিতাও ছন্দে ছন্দে ছন্দোময় হয়ে উঠেছে “অথচ একদিন ” কাব্যগ্রন্থে। এখানেই একজন কবির কৃতিত্ব। আর এ কাজটাই বাবর আলী এখানে সম্পন্ন করেছেন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে।
০৯. দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৬ তারিখে ‘দীর্ঘ সময়’ নামে আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার অংশবিশেষ দেয়া হলো।
‘কেবল আমারই দেরি হয়ে গেলো।
…
সবকিছু বিলম্বেই বুঝি/ সত্য-মিথ্য, জ্বরা-ব্যাধি-মৃত্যু-সব/ তাই, অসময়ে ব্যবস্হা নেই/ আশ্রয়ের সম্ভাবনা খুঁজি/ কিছুতেই হয়না কিছুই।
আমিই দেরি করে ফেললাম/ আর সকলেই কিনে নিলো মুক্তি-কবজ/ পৃথিবীর পাঠশালা থেকে/ সুখের ঝিনুক কুড়াতে গিয়ে/ দীর্ঘ সময় ধরে আমিই বঞ্চিত আছি।’
১০. ফেব্রুয়ারি ২৭, ১৯৯৭ তারিখের দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় ছাপা হয় “ঈদের আনন্দ” শিরোনামে আমার আরেকটি কবিতা। ঈদের ওপর লিখিত কবিতাটিতে আছে,
‘আমায় ছুঁয়ে গেছে ঈদের আনন্দ আজ/ মুগ্ধ শিহরণে শিহরিত আমি / চেনাজানা শব্দের শিল্প মেলায়। / এমন খুশির দিনে/ বিচিত্র চিন্তারা সব ছুঁয়েছুৃঁয়ে যায়৷ / বিস্মিত হই…
অাবাল্য বাংলায় আমি/ ঈদেরই আনন্দ নিয়ে বড় হয়েছি/ সে বাংলায় আমি আজ/ দ্বিধাযুক্ত সংলাপে বিভোর, / হৃদয়ের মধ্যিখানে কালো ছায়া দেখে সংকুচিত হই, / আমার উচ্চারণে আজ কোনো শুদ্ধতা নেই।’
১১. আমার কবিতার নাম “ইচ্ছে ছিলো”। এটি দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে ২৭ এপ্রিল ১৯৯৭ তারিখ।
‘ইচ্ছে ছিলো… /
বেকার লাঙ্গল ব্যস্ত হবে, ক্ষেত খামারে /অসুখেরা দুর হবে সব, অপুষ্টি আর থাকবে না /…
ভাবতেই পারি না আমি, ভাবতে লাগে কষ্ট/ আনন্দতো নয় প্রতিদিন, গোটা দিনই নষ্ট। ‘
এইতো গেলো লেখা-লেখির কথা। এবার অন্য একটি কথা বলি। দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের একটি স্মৃতি এখনও মনে আছে। ১৯৯৭ সালের কথা। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আই. বি. এস.)-এর পি. এইচ. ডি. গবেষক। পরিবারসহ থাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আই. বি. এস. কোয়ার্টারে। কী কাজে যেন রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছি। যেদিন ঢাকার কাজ শেষ করে রাজশাহী ফিরে যাবো, সেইদিনের দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় আমার ছবিসহ বক্স নিউজ, “সামাদ সিকদার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। তাঁর মেয়ে… দিনকালকে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।”
দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সংবাদটি যারা পাঠ করেছেন বা যারা এই সংবাদটি শুনেছেন তারা ইন্না-লিল্লাহ… পাঠ করেছেন। ধরেই নিয়েছেন আমি মৃত্যুবরণ করেছি । আর সংবাদটিতো আমার ছবি দিয়েই করা। বাদসাধলো মেয়ে নিয়ে। আমাকে যারা চেনেন, তারা জানেন যে আমার কোনো মেয়ে নেই। সন্দেহ করতে থাকলো, হয়তো ঢাকায় আমার আরেক স্ত্রী-সংসার আছে এবং একটি বড় মেয়েও আছে।
বাসায় দৈনিক দিনকাল পত্রিকা রাখা হয় না। তাই আমার স্ত্রী এবিষয়ে কিছু জানতে পারেননি। ঐ সময়ে আই. বি. এস.-এর পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ডক্টর জয়নুল আবেদীন। তাঁর সাথে আমাদের পারিবারিক সুসম্পর্ক ছিলো। তিনি স্বস্ত্রীক আমাদের বাসায় এলেন।
তাঁর নিজের দায়িত্ব মনে করে, বহুকষ্টে আমার স্ত্রীকে দুসংবাদটি দিলেন। তিনি বললেন, “ভাবি, মনটাকে শক্ত করেন। একটা খারাপ খবর জানাতে বাধ্য হচ্ছি। এর জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।” ইত্যাদি ইত্যাদি…
আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা। বিনোধপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসায় যেতে দুই মিনিটের রাস্তা। যে আমাকে রাস্তায় দেখে সে-ই যেন কেমন আৎকে ওঠে! কিছু না বুঝেই বাসায় পৌঁছে দরজার কড়া নাড়লাম। শুনতে পেলাম, অনেক মানুষের শোরগোল বাসার ভেতর। তখন পর্যন্ত দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সংবাদ সম্পর্কে আমি কিছুই অবহিত ছিলাম না। অতঃপর…
মূল ঘটনাটি হলো, জনৈক মোঃ আব্দুস সামাদ ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার একটি বড় মেয়ে আছে। দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদটি এসেছে। ঐ সময়ে দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় আমার লেখা খুব ছাপা হতো। রিপোর্টার, আমি সামাদ সিকদারকে মনে করে, আমার ছবিসহ নিউজটি ছেপেছে! বেশ গুরুত্ব দিয়েই ছেপেছে!
দৈনিক দিনকাল পত্রিকার মুশাররাফ করিম ভাই ও আনোয়ারুল কবির বুলুর কথা সংক্ষিপ্তাকারে বলেছি। এবার বলবো সাংবাদিক মারুফ কামাল খানের কথা। সুদর্শন, স্মার্ট, ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ তিনি। চোখে পুরুলেন্সের চশমা। মারুফ কামালের সাথেও দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় দেখা হয়েছে। তিনি দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন।
‘দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় মারুফ কামাল দু’বার স্বল্প সময়ের জন্য নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমবার ২০০১ সালে এবং পরে ২০০৭ সালে।’ এছাড়া, দৈনিক দেশ পত্রিকা অফিসে এবং প্রেসক্লাবেও মারুফ কামালের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ঐ সময়ে আমার সাথে ছিলো সালাহউদ্দিন মাহমুদ বকুল।
সাংবাদিক মারুফ কামালের সাথে পরিচয় অনেক আগে থেকে। তিনি তখন দৈনিক দেশ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও পাক্ষিক ঊষা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বনানী চেয়ারম্যান বাড়িতে ছিল ঊষা কার্যালয়। ঊষা পত্রিকায় প্রিয় সালাহউদ্দিন মাহমুদ বকুলও কাজ করতো। একদিন সে আমাকে ঊষা কার্যালয়ে নিয়ে যায়। পরিচয় করিয়ে দেয় মারুফ কামালের সাথে। সেদিন থেকেই মারুফ কামাল আমাকে আপন করে নেয় এবং পত্রিকায় লেখা দিতে বলে। পাক্ষিক ঊষা পত্রিকায় আমার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। কোনো কোনো সংখ্যায় সামাদ সিকদারের কবিতা শিরোনামে পুরো পৃষ্ঠায় আমার কবিতা ছাপা হতো। দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট কাজী সিরাজ। কাজী সিরাজ একজন মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ তিনি সাপ্তাহিক রোববার- এর উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এরআগে দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক দিনকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রামের দৈনিক কিষান পত্রিকার ঢাকার ব্যুরো প্রধান ছিলেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিবর্তন।
কাজী সিরাজ ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক হন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতেন। টেলিভিশনের আলোচনায় ছিলেন পরিচিত মুখ। জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদের চাচাত ভাই কাজী সিরাজ। তার স্ত্রী শাহরিয়ার আখতার বুলু বিএনপি সরকারের সময় সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন।
অত্যম্ত ভালো মানুষ ছিলেন কাজী সিরাজ। তিনি খুব পান খেতে খেতে গল্প করতেন। সকলের সাথে, সব বয়সের মানুষের সাথে অনায়াসে মিশতে পারতেন কাজী সিরাজ। হাসতে পারতেন, হাসাতেও পারতেন।
পরবর্তীতে কাজী সিরাজ ভাই টেলিভিশনের ‘টক শো’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত ছিলেন এবং সুন্দর বক্তব্য রাখতেন। তিনি হাসতে হাসতে কথা বলতেন। কারও সঙ্গে বিরোধে যেতেন না। তার গলায় বেশির ভাগ সময়ে একটি মাফলার পেচানো থাকতো। সেই সহজ-সরল কাজী সিরাজ ভাইকে আর কোনোদিন দেখা যাবেনা। তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। কাজী সিরাজ ভাই এখন আমাদের থেকে অনেক দুরে। আল্লাহ পাক কাজী সিরাজ ও মুশাররাফ করিম ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্ব্বোচ্চ স্হানে দাখিল করুন। আমীন।
(চলবে)
২০-০৬-২০২০।