করিমন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই অস্থির মনে ঘরের পিছনের দিকে কিছু সময় পায়চারি করে কি যেন খোঁজ করছে। সে ঘরের চার দিক ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করছে। আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তাকে পেরেশান দেখে বাড়ির এই ঘরের সে ঘরের মহিলারা একত্রে জড়ো হয়ে কানাঘুষা করছে। সে মাঝে মধ্যে ঘরের ভিটির মাটি খুঁড়ছে,সবাই বলাবলি করছে, কি খোঁজ করেন ? সে নিজের খেয়াল মতো এখানে/সেখানে কি যেন খোঁজ করছে, কারো ও কথার জবাব দিচ্ছে না।
কলিম সকালে ফজর নামাজ পড়ে আগে হুঁকা টানার অভ্যাস, করিমন আজ তামাক সাজিয়ে না দিয়ে বাহিরে কি করে ? কইগো বৌ আমার হুঁকা না দিয়ে কোথায় গেলে ? করিমন কোনো কথার জবাব দিচ্ছে না। কলিম বিড় বিড় করে বলে ছোটকাল থেকে তামাকের অভ্যাস, বহুবার চেষ্টা করেছি ছেড়ে দিতে। করিমন কতবার বলেছে , তামাক খাওয়া বন্ধ না করলে এই অসুখ ভালো হইবে না। কিন্তু তা ছাড়তে পারছি না।
কলিম ঘর থেকে আসতে আসতে লাঠি ভর দিয়ে বের হয়ে এসে দেখে মুরগি ওর ছোট ছোট বাচ্চা গুলিকে পাখার নিচে ঢেকে নারিকেল গাছটার নিচে বসে আছে। কলিম করিমনের দিকে তাকিয়ে বলে মুরগি আর ওর বাচ্চা গুলিকে কি খাওয়া দিয়েছো ? করিমন বলে ভোরে ধানের কুড়া খেতে দিয়েছি। হাঁস সকাল ছেড়ে দিলেই খাবার জন্য করিমনের চারিদিকে ঘোরাঘোরি করে, ওদের খাওয়া দিলে বাহির হয়ে পানিতে গিয়ে যা পায় খেয়ে ঘরের পাশে বসে থাকে। কলিম বলে দেখো মুরগি কি ভাবে তার বাচ্চাদের পাখনার নিচে আগলিয়ে রেখেছে। কাছে গেলে তোমাকে ঠোক্কর দেবে যেন বাচ্চা না ছুঁয়ে দূরে থাক। করিমন বলে সবাই তার বাচ্চাকে এ ভাবে বুকে আগলিয়ে রাখে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে সব ভুলে যায়। সেই মাবাবাকে দুটু খেতে ও দিতে চায় না, খেতে দিলেও কত নির্যাতন সহ্য করতে হয়, এ ভাবেই বুড়ো বয়েসে অবহেলায় মারা যায়।
করিমন বিড় বিড় করে বলে,বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন কি ? আমার দুই ছেলে রমিজ ও ইয়াছিন, ছেলে বৌ নাতি নাতনি নিয়ে খেয়ে ভালোই আছে। আপনি এ ভাবে বিনা চিকিৎসায় ভোগতেছেন , ওদের মুখে কোনো সাড়া শব্দ আছে ? মনে হয় যেন আমরা ওদের বোঝা, কেউ না। কলিম বলে, তোমার কি মনে পড়ে বৌ, কি নিয়ে একটু কথা বলেছো, আর অমনি তোমার ভাতের থালা সামনে থেকে কেড়ে নিয়ে না খাইয়ে রেখেছে। দুই দিন না খেয়ে, শেষে উত্তর ঘরের প্রধানিয়া আইয়া কয় “কিরে তোরা কি তোদের মাবাবাকে না খাইয়া মারবি ? আমার ছোট ভাইয়ের বৌটা আর এক জল্লাদ, সে আমাদের একদম সহ্য করতে পারে না, তা ছাড়া সে ও ওদের কু-পরামর্শ দেয়।
পুকুর পাড়ের আম গাছের পাকা পাকা আম, সামনে দিয়ে নিয়ে যায় , মনে চাইলে একটা দুইটা পোকা ধরা আম দিয়ে যায়। একটু গরুর গোছ দিয়ে ভাত খাইতে মন চায় , কতদিন ছেলেদের ও নাতি-নাতনিদের বললাম, আমরা কি মানুষ ? তারা ভালো ঘরে ঘুমায়, আমরা এই ভাঙা ঘরটায় ঘুমাই, বৃষ্টি না আসতে ঘরের ভিতর পানি পড়ে।ছেড়া কাঁথা, রাতে শীতে ঘুম আসে না। একটু জোরে বাতাস আইলে ঘরের চালা গুলি উইড়া নিয়ে যায়। এই যে ছেড়া কাপড় পড়ি, তাও একটু সাবান দিয়ে কেউ ধুয়ে দেয় না, হাতে সেলাই করে লজ্জা নিবারণ করি, দেখে ও কি ওদের অনুভূতি হয় না ? ভাত আর চোখের পানি, এই তো আমাদের জীবন।জমিজমা যা কিছু আছে, বিক্রি করে বসে বসে খাইতে পারি। কিন্তু তখন হগ্গলে আইয়া শালিসি করবে,। করিমন বলে থাক এখন চুপ থাকেন।
কলিম আস্তে আস্তে বলে, সকাল থেকে তুমি কি সব এলেবেলে কাজ নিয়ে এত ব্যাস্ত ? করিমন ফিসফিসিয়ে বলে “আমি রাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনাকে জাদুটোনা করে এখানে তাবিজ লুকিয়ে রেখেছে। ” কলিম বলে কে তাবিজ করেছে, তা কি কিছু দেখেছো ? করিমন বলে আর কে আপনার পিয়ারে লোকেরা ? কলিম বলে বাজে কথা না বলে কি দেখেছো তাই বলো, তাছাড়া তুমি মাটি খুঁড়ে কি তাবিজ বের করতে পারবে ? দেখি চেষ্টা করে। কলিম বলে আমি অনেক দিন থেকে অসুস্থ্য, কবিরাজি, ডাক্তারি, তাবিজ, ঝাড় ফুঁক সবই করেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আজ শুক্রবার, আমজাদ মুন্সি কুকিল কণ্ঠে মসজিদে আজান দিচ্ছেন ” আলাহু একবার, আল্লাহু একবার = আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান ” আজান শুনে করিমনের মনটা ভিতর থেকে কেঁপে উঠছে, মাথায় কাপড় টেনে করিমন ঘরে এসে বলে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি, তা ঠিক। কলিম বলে আচ্ছা পাগলামি না করে ধৈর্য ধরো। করিমন বলে, আজ শুক্রবার, আপনি নামাজে যাইবেন? কলিম বলে বউগো আজ জুমাবার, কিন্তু হাঁটতে তো পারি না। পাশের ঘরের জামাল বলে দাদা চলেন আমি আপনাকে মসজিদে নিয়ে যাবো। কলিম অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠে বুদ্ধিহীন চোখে এক দৃষ্টিতে করিমনের চোখের দিকে চেয়ে কি যেন কি ভাবছে ? করিমন একটা সুন্দর পাঞ্জাবি স্যুটকেস থেকে বের করে বলে এইডা পড়েন। কলিম বলে বৌ এই পাঞ্জাবিটা আমার শ্বশুর আমাদের বিয়ের সময় আমাকে বিয়ের উপহার হিসাবে দিয়েছিল , তুমি তোমার বাপজানের দেয়া হেই পাঞ্জাবিটা আমাকে আজ দিলে ? করিমন বলে এই পাঞ্জাবিটা পড়ে মাথায় টুপি দিলে আপনাকে কত সুন্দর লাগতো! আমি আপনাকে সাদা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি পরিয়ে দেখি কেমন লাগে? করিমন নিজ হাতে কলিমকে কাপড় পরিয়ে দেখে আর পুরানো দিনের স্মৃতি স্বরণ করে।
জামাল আস্তে আস্তে দাদাকে ধরে মসজিদে নিয়ে এক কোনে বসিয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসে। হাজি নুরুল ইসলাম বলে মুসল্লিরা নামাজের পরে তবারক আছে নিয়ে যাবেন। নামাজ শেষে মনু খাঁ মুসল্লিদের কলাপাতায় খেজুরের রসের সিন্নি বিলিয়ে দিলে মুসল্লিরা খেয়ে আস্তে আস্তে চলে যায়। জামাল বলে দাদা চলেন এবার ঘরে যাই। করিমন একটা মোড়া ঘরের বাহিরে দিয়ে বলে বসেন, আমি হুঁকা নিয়ে আসি। কলিম চিরদিনের অভ্যাস হুঁকা না হলে চলে না।
মনে পড়ে ছোটবেলার কথা, করিমন কলিমের সঙ্গে একই গ্রামের মক্তবে কায়দা,আমপারা পড়তো। আপিয়া, মাফিয়া,আমিনা, জামিনা আরো ও ছেলেমেয়েরা এই মক্তবে পড়ে । সবাই জোরে জোরে চিৎকার করে সূরা কায়দা পড়ি, একটু ভুল হলে মুন্সির বেতের পিটানি মাফ নেই। বেতের পিটানি খেয়ে রাতে অনেকের জ্বর এসে যেত। মাবাবা বলতেন ” মুন্সি সাহেবের বেতের পিটানি খেয়ে শরীরে যেখানে জখম হবে, সে স্থান বেহেস্তে যাবে। “দু হাত দিয়ে চোখ মুছে বেহেস্তের আসায় চুপ করে থাকি। আমার চাচাতো বোন কৈতরী বয়েসে আমাদের চেয়ে তিন/চার বৎসর বেশি। মুন্সি সাহেব আমার চাচাতো বোন কৈতরীকে সব সময় নিজের কাছে বসিয়ে অতি যত্ন সহকারে কোরান পড়ান, চোখের দিকে তাকিয়ে একটু একটু মুচকি হাসি। মুন্সি সাহেব খুব কড়া মেজাজি, পড়া না পারলে মারধর করতেন। এ নিয়ে বাড়িতে মা/চাচিদের মধ্যে সব সময় অসন্তোষ দেখা দেয়। কৈতরীর মতো কয়েকজন কাচারীতে আরবি পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। শেষে বাড়ির লোকজন একদিন মুন্সি সাহেবকে বিদায় করে দেয় । সকালে আরবি পড়া শেষ হলে আমাদের ছুট্টি এবং বাকি সময় মেয়েরা মিলেমিশে খেলাধুলা করে সময় পার করি।ছেলেরা স্কুলে যায় বা খেতখামারে কাজ করে ।
বহু পরিবার নিয়ে একটা বিরাট বাড়ি, সবার সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয় না,আমি কখনো ও সবার ঘরে যাই না। আমাদের সঙ্গে ছেলেরা কলিম, রফিক , আজিজ, সামসু ও আরো অনেকেই খেলাদুলা করে । বিকেল হলে আমরা ছুটাছুটি করি । আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির উঠানে লুকোচুরি খেলা করি, এই ঘরে সেই ঘরে বা খড়ের ভিতর লুকিয়ে থাকি ; যদি খোঁজে বের করে গায়ে ছুঁয়ে দিতে পারে, তা হলে আমি বা সে খেলা থেকে বাদ পড়ে যায় । কলিম সব সময় আমার গায়ে হাত দিতো, আমি কেন জানি আপত্তি করতাম না। এরই মাঝে কি ভাবে কলিমের সঙ্গে আমার একটু অন্তরঙ্গতা হয়ে উঠে। আমাদের অনেক সময় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া হতো। কিন্তু কলিমের সঙ্গে আমার কোনো দিন মনোমালিন্য হতো না। হিন্দুদের রথ যাত্রা, বৈশাখী মেলা বা বাজার থেকে কলিম আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে খেলনা, মুরুলী, কদম এনে দিতো। মা জানতো কলিম আমাকে খুব পছন্দ করে, কিছু বলতো না ।
আমি অনেক সময় এক/দুই মাস হাজীগঞ্জে নানাবাড়ি বেড়াতে যাইতাম। নানা বাড়িতে আমার অনেক ভালো লাগতো,নান বাড়িতে আমার অনেক ভাইবোন আছে যাদের সঙ্গে আমি সব সময় খেলাধুলা করি। বাজারে নানার একটা মুদি দোকান এবং দোকানের পাশে ছোট্ট একটা টিনের ঘর। নানা দুপুরে দোকান বন্ধ করে মসজিদে নামাজ পড়ে এই টিনের ঘরে ১-২ ঘন্টা ঘুমিয়ে বিকেলে আবার দোকান খুলে রাত ৮টায় রাতের জন্য বন্ধ করে দিতো। নানাদের বাড়ি বাজার থেকে ৮-১০ মিনিট হাঁটার রাস্তা।
কলিম আমাকে না দেখে থাকতে পারতো না। ,কলিম চুরি করে গোলা থেকে ধান বা চাল বিক্রি করে পয়সা জমিয়ে আমাকে দেখতে যেত। ওর মা এ সব টের পেলে ও বাবাকে কিছুই বলতো না। সে সকালে পান্তা ভাত খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার নানার বাড়িতে চলে আসতো। নানী ওকে অনেক আদর করতো, আসলেই ভাত খেতে দিতো। আমরা দুই জনে বোয়ালজরি খালের পুলের উপর দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো ধানের নৌকা , পাটের নৌকা বা খালি নৌকা এ দিক সে দিক আসা যাওয়া করতে দেখতাম এবং অনেক সময় দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে আলীগঞ্জ বা বলাখাল পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসতাম। দোকানে গেলে নানা মুরুলী, বাজার থেকে আখ, আচার কিনে খাইতে দিতেন এবং অনেক আদর করতেন।
কলিম জানতো ট্রেনে বিনা টিকেটে ধরা পড়লে টিকেট চেকার আমাদের ছেড়ে দেবে। একদিন আমরা হাজীগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে চাঁদপুর কালী বাড়ি গিয়ে নেমে বড়ো স্টেশনে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চ ঘাটে কিছু সময় বসে থাকি । সে দিন- ই প্রথম কলিম আমাকে ভালোবাসে বলে জানিয়েছে এবং আমি কোনো আপত্তি করি নি। এর পরে ও আমরা কয়েকবার চাঁদপুর ট্রেনে গিয়েছি, কলিম কখন ও ট্রেনের ভাড়ার পয়সা দিতো না। তবে দোকান থেকে এটা সেটা কিনে আমার সঙ্গে শেয়ার করতো। আমরা ছায়াবানী সিনেমা হলের্ সামনে ঘোরাঘোরি করি দেখে সিকিউরিটির লোক বলে তোমরা সিনেমা দেখবে ? কলিম মাথা নেড়ে বলে দেখবো। সিকিউরিটি বলে পয়সা আছে ? কলিম বলে না। সে আসতে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে ভিতরে ঢুকিয়ে দুইটি সিটে বসিয়ে দিয়ে বলে আধ ঘন্টা দেখার পর বাহিরে চলে আসবে। আমরা আধ ঘন্টা পর বাহিরে আসলে সিকিউরিটি বলে ভালো লেগেছে ? আমরা মাথা নেড়ে সায় দিলে সে বলে কোত্থেকে এসেছো ? কলিম বলে আমরা হাজীগঞ্জ থেকে এসেছি। যাও, আর কোনোদিন বিনা পয়সায় সিনেমা দেখতে আসবে না। আমরা মাথা নেড়ে বলি, আচ্ছা ।
কিছু সময় আমরা হলের্ বাহিরে ঘোরে পরবর্তী ট্রেনে হাজীগঞ্জ স্টেশন নেমে নানা বাড়ি গেলে নানু আমাদের বকুনি দিয়ে বলে কলিম তুমি বাড়ি যাও। ও মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসে। আমি ওর জন্য অনেক দুঃখ পেয়েছি। নানু হাঁসতে হাঁসতে বলে বুঝেছি তুই কলিমকে ভালো বাসিছ , তাই না ?
নানা কাজ থেকে ঘরে আসার পর রাতের খাওয়া শেষে জিজ্ঞেস করে করিমন কোথায় ? নানু বলে ওকে বকুনি দিয়েছি এবং সে জন্য কিছু না খেয়ে শুয়ে আছে। কেন বকুনি দিয়েছো ?
চারিদিকের লোকজন কানাঘুষা করে ওদের চলাফেরা নিয়ে। কলিম-ই বা কোথায় ? ওকে ও বকুনি দেয়াতে বাড়ি চলে গেছে। আরে এ কি করছো, ওকে না খাইয়ে দিলে ? ওকে কলিমের সঙ্গে বিয়ে দাও, এতে সব ঝামেলা মিটমাট হয়ে যাবে। আপনিতো দেখি নাতিন কে আশকারা দিচ্ছেন। নানু বলে ,ও এতক্ষন বুঝতে পারছি, এই জন্য কলিম ঘন ঘন আসে। অসুবিধা কোথায় ? ছেলেটা দেখতে শুনতে খারাপ না। তাছাড়া করিমন ও ওকে পছন্দ করে। কইগো করিমন, এ দিকে আয় , দেখি তোর মতামত কি ? করিমন নানার কথা শুনে মনে মনে খুশি। কিন্তু লজ্জা পেয়ে নানানানির সামনে আসে না। আহা ! এক মাত্র নাতিন , ওর বিয়েতে একটু আনন্দ করবো। আর আমরা হইলাম সেকালের মানুষ , একটু পিরিত করলে আমিতো দোষের কিছু দেখছি না।
আরে তুমি শুনো নাই ওই যে গান
” কেন পিরিতি শিখাইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি … “।
এই বৈতাল্লা গান এখন রাখেন। কইগো করিমন ভাত খাইতে আয়। করিমন আসতে আসতে যাইয়া খাইতে বসেছে। নানানানি দুইজনেই ওর দিকে তাকিয়ে হাঁসে। করিমন নিচের দিকে মুখ করে ভাত খাচ্ছে। নানা বলে তুই চিন্তা করিস না, আমি দেখি কি করতে পারি। করিমন আসতে করে হাঁসি মুখ করে নানার দিকে তাকিয়ে আছে। নানা বলে কইগো বৌ, বুঝতে পারছো ? নানী বলে কি আর বুঝার আছে ? শুইন্না রাখো, কালকে আমি দোকান বন্ধ রাখবো, করিমনকে নিয়ে মাইয়াডারে দেখতে যামু এবং করিমনের বিয়ের কথা পাকা করে আমু । নানী বলে করিমনকে বিয়ে দেয়ার জন্য আপনারই আগ্রহ বেশি। আরে কি হাগলের কথা কও ? পাঁচটা না সাতটা না, একটা মাত্র নাতিন আমার। তুমি আর আমি দুইজনে নাচবো, গাইবো, ফুর্তি কইরা বিয়ে দেব।
করিমন অতীতের জীবন নিয়ে ধ্যান করতে গিয়ে দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে। কলিম বলে ও বৌ কি জন্য কাঁদো ? কাঁদি কোথায় ? আমাকে বল, কি ভাবতে ছিলে ?
আমাদের সে ছোট সময়ের কথা, আপনি এবং আমি দুই জন্যে কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতাম না। নানা বাড়ি গেলে আপনি আমাকে নিয়ে বোয়ালজরি খালের পুলের উপর দুইজনে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে ডাকাতিয়ার নৌকা, বাস,রিকশা আসা যাওয়া দেখতাম। নানার দোকান থেকে পয়সা নিয়ে মুরালি , আখ, আমের আচার কিনে দুই জনে খাইতাম। গ্রামের মানুষ আমাদের নামে কত কি বলতো ? লোকের নিন্দা সহ্য করেছি।
আপনি বিদেশে করাত কাম করতে গেছেন , আমি রোজ রোজ আপনার চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম। কবে চিঠি আসবে ? কাকে দিয়ে চিঠি পড়াবো এবং জবাব দেব ? মাঝে মধ্যে আপনার গামছাটা নাকের কাছে নিয়ে ধরলে আপনার শরীরের গন্ধ পাইতাম। আপনার কি মনে আছে ? আমরা নানা বাড়ি থেকে চাঁদপুর গিয়ে সিনেমা দেখেছিলাম। তার- ই গানের একটা কলি মনে মনে আওড়াইতাম।
” কেন পিরিতি শিখাইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি … “।
আপনার চিঠি আসলে মনে হতো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি,পড়তে পারতাম না, কাউকে দিয়ে পড়িয়ে আবার জবাব দিতাম এবং সারা রাত ওই চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে বার বার হাতে নিয়ে দেখতাম। কবে বৈদেশ থাইকা বাড়ি আসবেন হেই আশায় পথের পানে চাইয়া থাকি । এই দুই মাসে আপনার চেহেরা জানি কত সুন্দর দেখাইবে, মনে মনে কত কল্পনার জাল বুনি । প্রতিদিন দাগারমুড়ার হেই রাস্তার দিকে এক নজরে চাইয়া থাকি, না জানি আজ আসবে।
কলিম সব সময় মাঠে রাতে কইয়া জাল পেতে কৈই মাছ , পাট খেতে বড়শি পেতে মাছ ধরতো। বর্ষার শেষে মাঠে বক ছোট ছোট মাছ খেতে আসলে কলিম বড়শি পেতে বক ধরতো। তাছাড়া রাতে নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করতে যেত। আমরা সব সময় মাছে ভাতেই খেয়েছি। বিশেষ করে আমার নানা নানী আসলে ও বেশি বেশি মাছ ধরে উঠানে রাখলে লাফালাফি করে, দেখতে কত ভালো লাগতো। । পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে বড়ো মাছ ধরলে কত যে খুশি লাগতো, যা বলার মতো না।
আমরা সারা জীবন গরিব ছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে ছিল একে অপরের ভালোবাসার টান। আপনি কি ভালো অইবেন ? আগ বৌ ! তুমি দোআ করলে আমি বালা অইয়া যামু। এই বলে কলিম নিজের কাঁদের গামছা দিয়ে করিমনের চোখ মুছে দেয়।
কলিম অনেক দিন থেকে অসুস্থ্য। যা কিছু খায় বমি করে ফেলে, সারাক্ষন পেট ব্যাথা নিয়ে পড়ে থাকে। কবিরাজি ঔষুধ খাওয়ানো হয়েছে , কিছুতেই ভালো হয় না। লোকে বলে ওকে তাবিজ করেছে , হেই চিকিৎসা ও করানো হয়েছে। কলিম ও সলিম দুই ভাই বাবা আইজুদ্দি অতি অল্প বয়সে স্ত্রী হারিয়েছে। আইজুদ্দির তিন মেয়ে নুরি, হাসি ও মাসিমা।
বাড়ির লোকজন বলে তুমি কি জন্য মাটি খুড়ো ? সে কিছুই বলছে না। কলিম বলে , আমাকে বলো , আমি শুনি আগে । সে চুপিসারে বলে, রাতে সে স্বপ্নে দেখেছে যে এই ঘর জাদু টোনা করা হয়েছে, সে জন্য এই ঘরে অসুখ ভালো হয় না। কলিম শুনে গ্রামের জালাল মুন্সি সাহেবকে বলে হুজুর ” আমার স্ত্রী করিমন রাতে স্বপ্নে দেখেছে , আমার ঘর জাদু টোনা করা হয়েছে। ” এই জন্য আমার অসুখ ভালো হয় না। মুন্সি সাহেব বলে আমাকে এক সপ্তাহ সময় দিন, আমি তদবির করে দেখবো। কলিম বলে জালাল মুন্সি জিন চালা জানে , জিন দিয়ে তাবিজ বের করে আনলে, আমি ভালো হয়ে যাবো।
এক সপ্তাহ এস্তেখারা করার পর জালাল মুন্সি বলেন আপনার আশেপাশের লোক আপনাকে তাবিজ করেছে এবং কিছু খাইয়ে দিয়েছে। কলিম বলে এখন কি করার আছে ? বলে আছে, কঠিন তদবির আছে , তদবিরের জোরে সব ঠিক করে দেব। একটা তুলারাশির লোক লাগবে। হুজুর তুলারাশির লোক কোথায় পাবেন ? জালাল মুন্সি খুঁজে কোত্থেকে এক লোক বের করে এনে বলে আমি বাটি পড়ে দিলে তুমি চালা দিয়ে যেখানে বাটি থামবে, সেখানে মাটি খুঁড়ে তাবিজ বের করে নিয়ে আসবে। আমি জানি কে তাবিজ করেছে, বাড়িতে হইচই শুরু হয়েছে। কিছু লোক মারমূখী হয়ে উঠেছে এবং প্রকাশ্যে বলা বলি করতেছে যদি কাউকে সন্দহ করা হয় তাহলে বিপদ আছে।
জালাল মুন্সি কলিমকে চুপে চুপে বলে তোমাকে একটা ছাগল জবাই করে তার মাংস আমাকে দেবে এবং ওর চামড়া বিক্রি করে টাকা হাদিয়া হিসাবে দেবে জিনের খরচের জন্য। কলিম ছাগলের পুরা মাংস জালাল মুন্সিকে দিয়ে বলে, আপনি খেয়ে আমার জন্য তদবির করেন। আরো কাজ আছে, আমি কয়েকটা তাবিজ লিখে দেব, বড়ো ধরণের হাদিয়া লাগবে, ঠিক হয়ে যাবে।
ক্রমশ :