সম্ভবত ১৯৯৫ সাল। কাজ করি ব্র্যাকের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স এন্ড কমিউনিকেশনস ডিপার্টমেন্টে। আসিফা রহমান আপা, ওবায়দুল্লাহ আল জাকির ভাই, তানভীর কামরুল ইসলাম আর আমি মিলে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট। হঠাৎ একদিন আবেদ ভাইয়ের পাঠানো এক অফিস সার্কুলার আসলো আমাদের সবার কাছে। বিষয়বস্তু: ব্র্যাকের পরিচালক পাবলিক অ্যাফেয়ার্স হিসেবে এম তাজুল ইসলামের যোগদান। তখন তাজুল ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও তার ভরাট কন্ঠস্বরের সাথে পরিচিত ছিলাম। রেডিওতে “খবর পড়ছি তাজুল ইসলাম” শুনলে পুরো খবর না শুনে উঠা যেত না। বলা যায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়েই খবর শুনতাম। সিরাজুল মজিদ মামুন এবং আসমা আহমেদ নামে আরো দুজন খ্যাতিমান খবর পাঠকের কথা এখন মনে পড়ে। খবর পাঠকে তাজুল ভাই একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বর্ণাঢ্য পেশাগত জীবনের অধিকারী, চৌকষ এই মানুষটির সাথে আমাদের সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছে কয়েক বছর। লেখালেখির বিষয়ে কেন জানিনা আমার উপর খুব আস্থা রাখতেন। জনসংযোগ, গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করে ব্র্যাকের কার্যক্রমের প্রচার, প্রসার, বিভিন্ন দেশ থেকে ব্র্যাকের কার্যক্রম দেখতে আসা অতিথিদের ব্রিফিং দেয়া, আবেদ ভাইয়ের বিভিন্ন ভাষণের ড্রাফট তৈরী করা থেকে শুরু করে আরো অনেক কাজেই তাজুল ভাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্র্যাকের মূল অফিস তখন ৭৫ মহাখালী হলেও আমাদের অফিস ছিল ৫৩ মহাখালির ইন্সুরেন্স বিল্ডিঙের পাঁচ তলায়। তাজুল ভাই বসতেন ৭৫ মহাখালীর তিন তলায় আবেদ ভাইয়ের অফিস ফ্লোরে। দিনে একবার হলেও তার অফিসে আমাদের ডাক পড়তো।
৯৭ সালের মাঝামাঝি ব্র্যাক ছেড়ে চলে আসার পরও অনেকবার দেখা হয়েছে তাজুল ভাইয়ের সাথে। ২০১১ সালে সর্বশেষ দেখা, ঢাকায়। জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত জীবনে অনেক প্রাক্তন সহকর্মীর সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ ছিলোনা তাজুল ভাইয়ের সাথেও। মাঝে মাঝে ব্র্যাকের কনিষ্ট সহকর্মী জুনায়েদের (বর্তমানে সম্ভবত বিবিসি বাংলা বিভাগে কর্মরত) কাছ থেকে তাজুল ভাইয়ের খবর জানতাম। সময়ের সাথে সাথে মানুষও হারিয়ে যেতে থাকে বিস্মৃতির অতলে। আবার হঠাৎ কোনো টুকরো স্মৃতি মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে পুরোনো সেই memory lane এ। জীবন্ত হয়ে উঠে তখন ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। এমনটাই ঘটেছে তাজুল ভাইয়ের ক্ষেত্রে। টরোন্টোতে Thanks Giving Day উপলক্ষে লং উইকেন্ডের টানা ছুটিতে পুরোনো কিছু কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করতে যেয়ে খুঁজে পেলাম আমাকে দেয়া তাজুল ভাইয়ের স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেট অফ এক্সপেরিয়েন্স। ব্র্যাক ছেড়ে চলে আসার পরপরই আমাকে এটি দেয়া হয়েছিল। অনেক বছর পর সার্টিফিকেটটা দেখে কেন জানি না বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। জানতে ইচ্ছে হলো তার বর্তমান অবস্থান। ফেসবুকে উনাকে খোজাঁর চেষ্টা করে কিছুই পেলাম না। গুগলে সার্চ করে পেলাম মন খারাপ করা বিষাদময় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি। প্রিয় তাজুল ভাই পরপারে পাড়ি দিয়েছেন গত বছরের ডিসেম্বরে। জীবনভর জনসংযোগে ডুবে থাকা এই মানুষটি চলে গেলেন অনেকটা নীরবে, নিঃশব্দে। জানলাম ও না।
বিশ্বব্রম্মান্ডে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুরই খুব সামান্যই আমরা জানি, দেখি। অনেকটা হারিকেনের আলোয় পথ দেখার মতোই। যা দেখি, যা জানি তার তিনগুন ঢাকা পড়ে থাকে আঁধারে। এই আঁধারের রহস্যভেদের সময় মানুষকে দেয়া হয়নি। অবাক হয়ে ভাবি, এতো রঙিন যে জীবন, সেই জীবন এতো অনিশ্চিত, সীমাবদ্ধ কেন ? এর উত্তর মিলে না। উত্তর খুঁজি কাজী নজরুল ইসলামের গানে,
“আমার যখন পথ ফুরাবে, আসবে গহীন রাতি, খোদা,
আমার যখন পথ ফুরাবে।
তখন তুমি হাত ধরো মোর, হয়ো পথের সাথী, খোদা,
আমার যখন পথ ফুরাবে।”
পথ একদিন সবারই ফুরাবে। এই পথ ফুরানোকে কেউ মনে রাখবে, কেউ মনে রাখবে না। কেউই থাকবো না আমরা। হয়তো থাকবে শুধু Memory Lane এ বিচরণের কিছু স্মৃতি।
(ছবি:-সৌজন্যে Northern Lights events)