ফ্লোরিডা থেকে:-
ওমর খৈয়াম আমাদের দেশে খুব পরিচিত এবং প্রিয় নাম । বড়দার অমূল্য বইয়ের সংগ্রহে ছিল কান্তি ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, কাজী নজরুল ইসলাম, সিকান্দর আবু জাফরের অনুবাদ বইগুলো। তাই স্কুল পার হবার আগেই আমার পরিচয় হয় তার সাথে , সম্ভবত দু আড়াই শ রুবাই ছিল মুখস্ত। মনে আছে লিক লিকে ঢ্যাংগা শরীরে টই টই করে চষে বেড়াতাম প্রিয় শহর, হাঁটতাম আর বির বির করে আবৃত্তি করতাম রুবাই গুলো ।
খৈয়াম আমার মধ্যে যে প্রভাব সৃষ্টি করেছিল কৈশোরে তা আজও কাটেনি , উনি আমাকে উদার মনের একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন । যারা এখন অল্প বয়েসে বেড়ে ওঠার সন্ধীক্ষণে তাদের খুব করে বলবো খৈয়াম পড়তে ।
খৈয়ামের কবিতায় সুরা সাকীর উল্লেখ খুব বেশী । পড়ে মনে হবে ওমর খৈয়াম একজন বেহেড মাতাল ছিলেন। কিন্তু তার মত প্রজ্ঞাবান অসম্ভব পরিশ্রমী একজন ব্যক্তি যিনি তার বেশীর ভাগ সময় ব্যায় করেছেন এষ্ট্রোনমি এলজ্যাবরা এবং জিওম্যাট্রি নিয়ে এবং রুবাই লিখেছেন কেবল মাত্র হবি হিসেবে, তার কখন সময় হলো মাতাল থাকার? তিনি ছিলেন তার সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং একজন মুসলিম বিজ্ঞানী হয়েও সে সময়ের পারস্যে তার পক্ষে মদ পান কতটা সম্ভব ছিল সেটাও প্রশ্ন । ভাষ্যমতে খৈয়ামের সুরা ছিল ঈশ্বর প্রেমের প্রতীক। মদে চুর হয়ে থাকা মানে তিনি ঈশ্বর প্রেমে নিবিষ্ট থাকতেন। বিজ্ঞানে নিবিষ্ট থাকাটাকে ও কি ঈশ্বর প্রেমে নিবিষ্ট থাকা বলা যাবে? কে জানে ?
মদ কে কি প্রেমের প্রতীক হিসেবে ধরে নেয়া যায়? একজন প্রেমিক কি একজন মাতালের মত স্থান পাত্র পরিস্থিতি জ্ঞান রহিত হন না ? মজনুর গল্প তো তাই বলে। যতদূর মনে পড়ে নীচের গল্পটি রুমির।
একদিন এক মওলানা রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন । এ সময়ে নামাজের সময় হয়ে গেলে উনি রাস্তায় জায়নামাজ বিছিয়ে কেবলা মুখী হয়ে নামাজ পড়তে থাকেন। এই সময়ে মজনু যাচ্ছিল সে রাস্তা দিয়ে । মওলানা তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করে রাগান্বিত ভাবে মজনু কে থামালেন, “তুমি বেকুব, তুমি দেখছ যে আমি সেজদা দিচ্ছি এবং তা সত্বেও তুমি আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে কেবলা নষ্ট করলে?”
মজনু বলল , ” হুজুর আমার বেয়াদবী মাফ করবেন , আমি লাইলীর প্রেমে এতই মশগুল যে লাইলীর মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখিনা ,আমি দেখিই নি যে আপনি নামাজ পড়ছেন । কিন্তু হুজুর আপনি আল্লার প্রেমে মশগুল হয়ে নামাজ পড়ার সময় কিভাবে দেখলেন যে আমি আপনার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ?”
খৈয়াম মুক্ত বুদ্ধির প্রতীক , অতুলনীয় প্রজ্ঞার আধার। আজকের অন্ধত্ব এবং গোঁড়ামির তড়িৎ বিস্তারে আশাহত হবার যুক্তিযুক্ত কারন থাকলেও ইতিহাস বলে খৈয়ামের যুগ ছিল আরও বেশী অন্ধকার। যতদূর জানা যায় গোঁড়ারা তার মান মন্দির পুডিয়ে দিয়েছিল। হয়েছিল তার জীবনের সংশয় ।
আজ সেই অন্ধদের চিহ্ন মাত্র নেই কিন্তু খৈয়াম বেঁচে আছেন।
কান্তি ঘোষের একটি অনুবাদ দিয়ে শেষ করছি:
“তর্ক তুলে করত যারা দ্যুলোক ভুলোক নস্যসাৎ
কোথায় তাদের কন্ঠ আজি এক পলকে কিস্তিমাৎ?
বিধান তাদের ফুৎকারেতে উড়িয়ে সবাই দিচ্ছে আজ
মুখটি তাদের ধুলোয় ঠাসা বন্ধ এখন জিভের কাজ।”