পর্ব ১-

‘রেইকি’ মানে কি? রেইকি জাপানি শব্দ যুগল Ree – Ki, ‘রেই’ শব্দের ইংরেজী অর্থ হল-ইউনিভার্সল। বাংলায় মহাজাগতিক। ‘কি’ শব্দের অর্থ ‘ভাইটাল লাইফ ফোর্স এনার্জি’। অর্থাৎ ‘সঞ্জীবনী প্রাণশক্তি’।

‘রেইকি’ প্রাকৃতিক আরোগ্য সাধনকারী শক্তি এ সত্যের আবিষ্কর্তা হচ্ছেন – ডাঃ মিকাই উসুই (১৮৬৫ – ১৯২৬)। ১৯০০ শতাব্দীর শেষ দিকে ডাঃ মিকাও উসুই (Mikao Usui) জাপানের কিওটো শহরের দোশিশুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ডাঃ উসুই ধর্মোপসনার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তখন এক ছাত্র তাকে প্রশ্ন করে – “আপনি কি বাইবেল বিশ্বাস করেন”? ডাঃ উসুই ইতিবাচক উত্তর দেন। তখন ছাত্রটি বলে – ” বাইবেল বলেছে যীশু পীড়িতদের সুস্থ করেছিলেন এবং জলের উপর দিয়ে হেটে ছিলেন, আপনি এই লিখিত বার্তা বিশ্বাস করেন? এই সমস্ত জিনিস আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন কি? আপনি ডাঃ উসুই এই অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারেন, কারণ আপনার জীবন সূর্য এখন মধ্যগগন পার হয়ে এসেছে বাধাহীনভাবে। কিন্তু আমরা যারা সবেমাত্র জীবনের চলার পথে চলতে শুরু করেছি তাদের জন্য এই লেখা যথেষ্ট নয়। আমরা স্বচক্ষে দেখতে চাই সব কিছু। সেই দিনই ‘রেইকি’র বীজ বপন হল। পরের দিনই ডাঃ উসুই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট পদ হতে পদত্যাগ করলেন। তিনি ইউনাইটেড ষ্টেটস-এর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্রিষ্টানদের ধর্মশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন ও ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেন, যীশু খ্রিষ্ট কিভাবে রুগ্ন ব্যক্তিদের সুস্থ করতেন। কিন্তু তিনি এ গুপ্ত রহস্য সন্ধানে ব্যর্থ হন।

তিনি উপলব্ধি করলেন যে, বৌদ্ধ ধর্মে এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁর কাছে এ জাতীয় আরোগ্য সাধনকারী শক্তি ছিল। এবার তিনি জাপানে ফিরে যাবার ও বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান আহরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। জাপানে পৌঁছে তিনি এক বৌদ্ধ মঠ হতে অন্য বৌদ্ধ মঠে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে, যিনি বলতে পারবেন এ শক্তির গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে। কিন্তু সর্বত্রই তিনি একই উত্তর পেলেন – “আমরা আমাদের আত্মার শুদ্ধি সাধনে প্রচন্ডভাবে ব্যস্ত, শারীরিক আরোগ্য সাধনের পন্থার রহস্য আবিষ্কারের সময় আমাদের নেই”। অবশেষে তিনি জেন মঠের এক মঠাধ্যক্ষের সন্ধান পেলেন, যিনি তাঁকে কিছু আশার দেখাতে পারলেন। ডাঃ উসুই – এর অনুরোধে মঠাধ্যক্ষ তাঁকে বৌদ্ধ ধর্ম ও তার সূত্র সম্বন্ধে পড়াশুনা ও গবেষণার সুযোগ করে দেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের জাপানি অনুবাদ পড়লেন কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। তিনি চৈনিক ভাষা শিখলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃত ব্যাখ্যার সন্ধান পেলেন। কিন্তু অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না। তিনি তখন সংস্কৃত ভাষা শিখলেন। সংস্কৃত ভাষা শিখে মূল বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থ পড়লেন। অবশেষে তাঁর লক্ষ্য পূর্ণ হল। বুদ্ধদেব যেসব চিহ্নসমূহ (সূত্র ও মন্ত্র) ব্যবহার করে অন্যের আরোগ্য সাধন করতেন তার কোন এক শ্রুতিধর শিষ্য শুনে লিখে রেখেছিলেন। সেখান হতেই ডাঃ উসুই জানতে পারলেন সেই সব চিহ্নসমূহ (সূত্র ও মন্ত্র) ও বর্ণনা যা আরোগ্য সাধনে সাহায্য করে।

তাঁর গবেষণা ও সন্ধানের সপ্তম বৎসরের শেষে তিনি আরোগ্য সাধনের পথ পেলেন, কিন্তু অন্যকে সুস্থ করার শক্তি পেলেন না। তাঁর পুরাতন বৃদ্ধ বন্ধু সেই মহান্তের সাথে আলোচনার পর তিনি পাহাড়ে গিয়ে ধ্যানে উপবেসনের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মঠাধ্যক্ষ সাবধান করে দিলেন যে, এই পথ খুবই বিপদজনক, তাঁর জীবনাবসানও হতে পারে। কিন্তু ডাঃ উসুই তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, তিনি এর শেষ পর্যন্ত যাবেন। জাপানের এক পর্বতের চূড়ায় আরোহন করে ডাঃ উসুই একুশ দিন পর্যন্ত ধ্যান মগ্ন ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, স্বর্গ হতে এক আলোকরশ্মি তাঁর দিকে আসছে। যদিও তিনি ভয় পেয়েছিলেন, তিনি তাঁর স্থান হতে সরে গেলেন না। অবশেষে আলোকপিন্ড তাঁকে আঘাত করলো এবং তিনি জ্ঞান হারালেন। তারপর তিনি তাঁর সামনে দ্রুত পরম্পরানুসারে আলোক বুদবুদের মাধ্যমে বুদ্ধের সেইভাবে চিহ্নগুলি দেখতে লাগলেন যা তিনি পূর্বে আবিষ্কার করেছেন – বুদ্ধদেব ও যীশুখ্রিষ্টের আরোগ্য সাধনের চাবিকাঠি। চিহ্নগুলি তাঁর স্মৃতিতে প্রজ্জ্বলিত হয়ে রইলো। ধ্যানের শেষ দিন তিনি পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলেন, তেমন চলৎশক্তি অবস্থা তাঁর আর নেই।

তিনি পাহাড় হতে নামতে শুরু করলেন। পথে পাথরে হোচট খেয়ে তাঁর পা-এর নখ উল্টে ভেঙ্গে গেল। প্রচন্ড ব্যথায় হাত দিয়ে পা চেপে ধরলেন, সাথে সাথে তাঁর ব্যথা সেরে গেল এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ হল। পাহাড় থেকে নামার পর তিনি খাবারের জন্য একটি দোকানে উপস্থিত হলেন। দোকানদার তাঁর শরীর ও পোষাকের জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে – তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অভুক্ত। সে তাঁকে গাছের নিচে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ জানায়। দোকানদারের মেয়ে ডাঃ উসুই – এর জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন, ডাঃ উসুই দেখলেন মেয়েটার মুখমন্ডল রক্তবর্ণ এবং সে কাঁদছিল। ডাঃ উসুই জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে – গত তিন দিন যাবৎ ভীষণ দাঁত ব্যথা হচ্ছে। তিনি তার অনুমতি নিয়ে মেয়েটির গাল স্পর্শ করলেন ও দু’হাতের মধ্যে তার মুখটি ধরলেন। কয়েক মুহার্তের মধ্যে তার ব্যথা কমে গেল।

পরবর্তীকালে সাত বৎসর ডাঃ উসুই জাপানের ভিক্ষুকদের আস্থানায় অসুস্থদের আরোগ্য সাধনে ব্যস্ত ছিলেন। যাদের বয়স অল্প, যুবক, কর্মশক্তি আছে সেসব ভিক্ষুকদের তিনি কাজে পাঠালেন। কিন্তু সাত বৎসর পর তিনি দেখলেন – ভিক্ষুকরা আবার আস্তানায় ফিরে এসেছে। তিনি ভিক্ষুকদের ফিরে আসার কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন যে, ভিক্ষুকরা তাদের পূর্বের জীবনযাপনই পছন্দ করে। ডাঃ উসুই অনুভব করলেন যে – তিনি শারীরিক রোগের লক্ষণসমূহের আরোগ্য সাধন করেছেন। কিন্তু নতুন জীবন ধারণের সারমর্ম গ্রহণ বা উপলব্ধি করার শিক্ষা তিনি দেননি।

তিনি ভিক্ষুকদের আস্তানা ছেড়ে ‘রেইকি’ শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের শিক্ষাদান শুরু করলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্য চুজিরো হায়াসি একজন অবসরপ্রাপ্ত নৌ সেনাপতি। সে ডাঃ উসুই – এর কাছ হতে দীক্ষা গ্রহণ করে ও ‘রেইকি’ চর্চায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।

ডাঃ উসুই যখন দেখলেন যে তাঁর জীবন সূর্য অস্তমিত হতে চলছে, তিনি তখন ডাঃ হায়াসিকে তাঁর শিক্ষার মূলমন্ত্র বা মূল শক্তিতে শক্তিমান করে দিয়ে গেলেন। ডাঃ হায়াসি ‘রেইকি’র গুরুত্ব বুঝে টোকিওতে এক ক্লিনিক খুললেন, যেখানে মানুষ ‘রেইকি’ চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য আসতে পারে। তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে – ‘রেইকি’ নিজেই রোগের কারণ বা উৎপত্তিস্থল খুঁজে বার করে ও সেখানে আন্দোলন সৃষ্টি করে ও প্রয়োজনীয় শক্তি প্রেরণ করে এবং দেহকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলে।

১৯৩৫ সালের একদিন হাওয়াই দ্বীপের এক অল্প বয়সী মহিলা টোকিওর হাসপাতালের এক কর্মীকে নিয়ে ডাঃ হায়াসির ক্লিনিকে উপস্থিত হয়। এই মহিলার নাম হায়াও তাকাতা। তিনি জাপানে আসেন টিউমার অপারেশনের জন্য। হাসপাতালে তিনি যখন অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন তার এক অদ্ভূত অনুভূতি হল যে – তার আর অস্রোপচারের প্রয়োজন নেই, অন্য কোনো পন্থা আছে। তখন তিনি রেইকির সাহায্য নিলেন। রেইকির মাধ্যমে হায়াও তাকাতার অসুস্থতার উপশম হল এবং সাথে সাথে তার এই বিদ্যায় পারদর্শী হবার ইচ্ছা জাগলো। তাকাতা অনুভব করলেন যে – তিনি রেইকির জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন এবং তার এই অনুভূতির কথা ডাঃ হায়াসিকে জানালেন। তাকাতা রেইকির শিক্ষা শেষ করে হাওয়াই দ্বীপে ফিরে গেলেন। হাওয়াই-এ তার চিকিৎসার উন্নতি ও প্রসার লাভ করে। ১৯৩৮ সালে হায়াও তাকাতা “মাষ্টার” ডিগ্রী লাভ করেন।

ডাঃ হায়াসি হঠাৎ উপলব্ধি করলেন যে, ইউনাইটেড ষ্টেটস ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন। তাঁকে যুদ্ধে যেতে হবে। তিনি তার যাবতীয় কাজ গুছাতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তাকাতা অনুভব করলেন যে, জাপানে গিয়ে ডাঃ হায়াসিকে সাহায্য করতে হবে। তিনি জাপানে গেলেন। ডাঃ হায়াসি তাকে আসন্ন যুদ্ধের সংবাদ দিলেন। তাকাতার কি করণীয়, তাকে কোথায় যেতে হবে এবং উপদেশ দিলেন রেইকিকে নিরাপদে রাখার জন্য। ডাঃ হায়াসি তার সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে তিনি তার পরিবার ও সকল “রেইকি” মাষ্টারদের আহ্বান জানালেন এবং বললেন যে – তাকাতাই ‘রেইকি’ বিদ্যার উত্তরাধিকারী এবং তাকাতার কাছে সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। তারপর জাপানী প্রথানুযায়ী আসন গ্রহণ করে চোখ বুঝলেন এবং ইচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন।

ডাঃ হায়াসির উপদেশ অনুযায়ী তাকাতা হাওয়াই দ্বীপে ফিরে গেলেন। তিনি শক্তি সম্পন্ন রেইকি মাষ্টার হিসেবে চিহ্নিত হলেন ও রেইকিকে পাশ্চাত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শৈশবে ফিলিস ফুরুমোতো তার দিদিমা হায়াও তাকাতার কাছ হতে প্রথম ডিগ্রী রেইকি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সত্তর দশকের শেষ দিকে ২৭ বৎসর বয়সে ফিলিস দ্বিতীয় ডিগ্রী রেইকিতে দীক্ষিত হলেন। ১৯৭৯ সালে তাকাতা ফিলিসকে ‘মাষ্টার’ ডিগ্রীতে দীক্ষিত করলে পরবর্তীকালে ফিলিস অনুভব করলেন যে এই রেইকি বিদ্যার দায়িত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে তার উপরই বর্তাবে। তাকাতার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তিনি এ বিদ্যার স্বরূপকে জানতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারার পর বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পারলেন যে, মিকাও উসুইর রেইকি অসীম শক্তিশালী। মানব কল্যাণে ‘রেইকি’ সারা বিশ্বে আজ প্রচলিত ও পরিচিত।

(চলবে)

#পাঁচ_পর্বে_সমাপ্ত

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন সংগ্রাম-পর্ব-১২
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ইমিগ্রেশন- পর্ব ১১
কামাল উদ্দিন
লেখক পরিচিতি: কামাল উদ্দিন (জন্ম: ১৯৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে "বাংলা সাহিত্যে" স্নাতকোত্তর (১৯৮২) সম্পন্ন করেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ফটোগ্রাফি চর্চা করেন। বেগার্ট ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি থেকে ডিপ্লোমা-ইন-ফটোগ্রাফি (১৯৯০) এবং বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি'র (বিপিএস) যোগ্যতা বোর্ড থেকে ১৯৯০ সালে "সিনিয়র গ্রেড ফটোগ্রাফার" "লাইসেনসিয়েটশীপ" (এলবিপিএস) অর্জন করেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রকাশিত বই "সহজ আলোকচিত্র" ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং "আলোকচিত্র সহজ ও উচ্চতর" (২০০২ সালে) ভারত হতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জ সুধীজন পাঠাগারে অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক হিসাবে নয় বৎসর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য। " কামাল হাসান" ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করেন। তিনি "কথন" আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা ও এক বৎসর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন