আমাদের বদ্ধমুল ধারনা ইয়োরোপ , আমেরিকা বা উন্নত দেশগুলতে বাবা মার বয়স হলেই তাদেরকে সন্তানরা ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দেন , কথাটা অনেকাংশেই সত্যি না । এখানেও সন্তানেরা বাবা মা দের অনেক কেয়ার করে , যত্ন নেয় । বাবা মা যতদিন সক্ষম থাকেন ওনারা নিজেদের মত থাকতে পছন্দ করেন , এমন কি একজন বেঁচে থাকলেও । কিন্তু তাই বলে এটা না যে সন্তানরা তাদের খোঁজ রাখেনা। এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুজনেই কাজ করে, সুতরাং বয়োবৃদ্ধ মা বাবাকে যথাযথ সময় দিতে পারেনা। যখন তাদের প্রয়োজন সার্বক্ষণিক সেবা। বেশীরভাগ মানুষ অন্যের দয়ায় বাচতে আগ্রহী নন,তারা নিজেরাই চাকুরী ছাড়ার আগে সব ব্যবস্থা করে রাখেন। ছেলে মেয়েরা পালাক্রমে বাবা বা মাকে প্রতি উইকেন্ডে দেখতে যায়, বিশেষ দিনে বাইরে নিয়ে যায়। তাদের কাছেও নিয়ে আসে। আমি দেখেছি এখানে ৮০/৮৫ বছরের স্বামী/স্ত্রী যতদিন সম্ভব নিজেদের বাড়ীতেই থাকেন, এমন কি একজন থাকলেও যদি তারা নিজের কাজ নিজে করতে সক্ষম হোন।
রিটায়ার ম্যান্ট হোম গুলো ডিপেন্ট করে আপনি কি ধরনের চাকুরী করতেন । যার যার ইনকামের ওপর এগুল নির্ভর করে। কিন্তু সেসব হোম আপনার ব্যাসিক ্নিডস গুলো পুরন করবেই , থাকা , খাবার , কাপড়, চিকিৎসা , আর ২৪/৭ সেবা । আবার ছেলেমেয়েরা এখানেও পালাক্রমে তাদের সাথে সময় কাটিয়ে আসে।
আমি অনেকগুল হোম ভিজিট করেছি পড়াশুনার জন্য আর কাজও করেছি এক্সপ্রিয়েন্সের জন্য । তাদের নিজস্ব চয়েস থাকে সে কোন হোমে থাকবে , যেমন তাদের কালচার ,ভাষা এসব মিল রেখেই তারা যেতে পারে । পোলিশ , পর্তুগীজ , রাশিয়ান এদের নিজেদের কমিউনিটির জন্য আলাদা হোম আছে , এরকম সব দেশের জন্যই কিছু কিছু সার্ভিস আছে ।
এদেরকে বাইরে নিয়ে যাবার জন্য স্পেশাল বাস আছে , একসাথে সবাই যায় কোন শপিং মল বা যে কোন জায়গায় , ভিতরে গল্প করার, চা কফি খাবার , পড়াশুনার জন্য বই ,কমন রুম আছে যাতে সবাই একসাথে টিভি দেখতে পারে । আর পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার থাকে তাদের রুম মেইন্টেইন করার জন্য ।নার্স আর ডাক্তার তো প্রতিদিনই তাদের হেলথ চেক করে ।
এখানে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই কাজ করতে হয় , ছেলেমেয়েরাও কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মুভ করে সুতরাং বয়স্ক বাবা মাকে একা থাকতে হয় না , আর তারা একটা সেফ আর সিকিউর জায়গায় থাকেন , কারন এখানে সবার কাজ মনিটর করা হয় হিডেন ক্যামেরা দিয়ে । আবার বাসায় রেখে যদি কেউ অযত্ন করে বাবা মাকে সোশ্যাল সার্ভিসে কেউ রিপোর্ট করলে কাঠগড়ায় যেতে হবে । আবার অনেকে শেষ বয়সে তাদের সন্তান দের কাছেই থাকেন। তাদের জন্য বাসায় লোক রেখে দেয়া হয় সেবা যত্নের জন্য।
আমাদের দেশে যেটা হচ্ছে ছেলেমেয়েরা এতটাই নির্মম বাবা মা অনেকটা অসহায় অবস্থায় হোমে আশ্রয় নেন আর পরবর্তীতে এরা কোন খোঁজ খবরও নেয় না । যার ফলে এর নেতিবাচক দিকই বেশী দেখি । আমাদের দেশে যদি সরকারী বেসরকারি উদ্যগে ভাল কিছু হোম বা আশ্রম যাই বলি গড়ে উঠে , সবাই না শুধু যাদের প্রয়োজন তারা যাবেন , শেষ বয়সে ছেলে মেয়েদের বোঝা হয়ে না থাকতে হয়।
আর আমাদের দেশে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাবা মা যতদিন কাজে লাগেন ছেলে মেয়েরা কাছে রাখেন নিজেদের সুবিধার জন্য । আর এখন তো দেশেও স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরী করে না পারে বাবা মাকে কাছে এনে রাখতে আর না পারে কছে গিয়ে সেবা যত্ন করতে । বাবা মা গ্রামের বাড়ীতে পড়ে থাকেন । আবার অনেকে তাদের কাছে রাখে ঠিকই কিন্তু তাদের যে যত্ন সেটা মোটেই করে না ।
সন্তান হিসেবে তাদের যত্ন করা যেমন দায়িত্ব আর এটা তাদের অধিকার । মনে করার কোন কারন নাই আমরা তাদের ফেবার দিচ্ছি । এটা তাদের রাইট আর সন্তানদের রেস্পন্সিবিলিটি ।
উন্নত দেশে :সিনিয়র লোকেরা অবসরের পর নিজের মনের মতন চলা ফেরা করার জন্য অথবা ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনি এদের কোলাহল থেকে দূরে থাকার জন্য বৃদ্ধাশ্রম এ স্বাধীন ভাবে থাকতে পছন্দ করেন
উন্নয়নশীল দেশে: সন্তানরা যখন বাবা মাকে দেখা শুনা করেনা বা স্বামীর মৃত্যুর পর যাবতীয় সম্পত্তি বন্টন হয়ে গেলে সন্তানদের গৃহে মা’র যখন কোনো মূল্যায়ন থাকে না, তখন বৃদ্ধাশ্রম এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে যে কয়টা প্রতিবেদন আমি টিভিতে দেখেছি, দেখার পর চোখের পানি আটকাতে পারিনি। এখানকার বৃদ্ধাশ্রম দেখে বিস্মিত হয়েছি । এইখানে বৃদ্ধদের জন্য উন্নত খাবার- দাবার ,চিকিৎসা আর বাসসস্থান ছাড়াও বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রম, মুভি শো, পাঠাগার,ট্রেনিং রুম,সুইমিং পুল, ইনডোর-আউট ডোর কার্যক্রম সহ নানাবিধ প্রোগ্রাম এ ভরপুর। কোন দিন কোন খাবার পরিবেশিত হবে বা সেদিন সারাদিনের কি কি কার্যক্রম আছে তা লবিতে বিশাল বড় টিভি স্ক্রিন এ দেখাতে থাকে।
আমি যতটুকু জানি,বাংলাদেশ এ সরকারি ব্যবস্থাপনায় শান্তিনিবাস নামে ছয়টা কেন্দ্র এবং বেসরকারি ভাবে আরো বেশ কিছু বৃদ্ধাশ্রম আছে যেগুলো চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।আমরা এখন যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে পরিণত হয়েছি।জীবিকার প্রয়োজনে আমরা এখন আমাদের সন্তানদের বাসার কাজের লোক বা দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে বড় করি তাহলে ওরা ওদের ব্যস্ততার সময় আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখবে না এমন দিন কি খুব বেশি দূরে..?!
লিখাটা লিখার উদ্দেশ্য বৃদ্ধাশ্রমকে মোটেও উৎসাহিত করার জন্য না বরং সময়ের দাবিতে কখনো যদি আমাদের দেশে ও এই রকম প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তাহলে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলোতে কিছু মানুষ যেন হাসি আনন্দের মাঝেই সময় কাটাতে পারে….তার একটা সুন্দর অবকাঠামোগত ছবি দেখানোর প্রয়াস মাত্র।
অন্তর্গত ভাবনা : আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনি আগামী দিনের বৃদ্ধ পিতা-মাতা।কোনো পিতা মাতার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নচিকেতার কণ্ঠে “ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার……….”গানটা যতবার শুনি ততবারই বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ব্যথা করে ,চোখের জলে চারপাশ কেমন ঝাপসা লাগে ।
তাই বৃদ্ধাশ্রম নয় , তাঁদের জন্য আমরা সুন্দর আবাসস্থল তৈরি করতে চাই, চাই হৃদপিন্ডের গভীর থেকে প্রবাহিত নির্মল ভালবাসা।