“নড়ে চড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনম ভর মিলে না”
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (র:) কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল যে মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ কোনটাই নিরবিচ্ছিন্ন নয় কেন। আনন্দ ও বেদনার এই পালাক্রম না থাকলেও তো চলতো। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “ স্রষ্টা তোমাকে অনুভূতির এক স্তর থেকে আরেক স্তরে নিয়ে যান এবং বৈপরীত্যের মাধ্যমে শিক্ষাদান করেন যাতে আকাশে উড়ার জন্য তোমার দুটি পাখা থাকে, একটি নয়”। সুখ -দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশা এবং এর থেকে সৃষ্ট নৈরাশ্য, বিষন্নতা মানুষের জীবন যাত্রার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সাধারণ বিষয়। যে মানুষটি সদা হাস্যময়, যাকে দেখলে মনে হয় জগতের সব সুখ তাকে ঘিরে আছে, সেই মানুষটিরও বুকের গহীনে যে কোনো দুঃখবোধ, অসীম শূন্যতা, হতাশা লুকিয়ে নেই, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এটিই পার্থিব, মানব জীবনের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। দেহের খাঁচা ছেড়ে প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আশা নিরাশার এই রোলার কোস্টার চলতেই থাকে। সুতরাং এই বিষয়টিকে সহজ, স্বাভাবিক ভাবে নেয়াই শ্রেয়। কিন্তু সমস্যা হলো যে এই নৈরাশ্য এবং বিষন্নতা যখন দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকার কারণে chronic হয়ে উঠে, স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে ব্যাহত করে, স্থবির করে ফেলে আগ্রহ, উৎসাহ এবং উদ্যমকে,- তখন এই বিষয়টি আর স্বাভাবিক থাকে না। মনস্তত্বের বাইবেল খ্যাত Diagnostic and Statistical Manual (DSM 5) তখন এই অবস্থাটিকে কিছু নিদৃষ্ট সূচকের ভিত্তিতে ‘Major Depressive Disorder’ বা ‘Clinical Depression’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। আশাব্যঞ্জক তথ্য হচ্ছে বিষন্নতায় আক্তান্ত ৮০- ৯০ শতাংশ মানুষ যথাযথ চিকিৎসায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। যে চারটি প্রধান aporoach নিয়ে বিষন্নতার চিকিৎসা করা হয় তা হচ্ছে Medication, Psychotherapy/Counselling, Self Help & Coping এবং শেষ, চুড়ান্ত পন্থা Electroconvulsive Therapy বা ECT। বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠেন প্রথম তিন এপ্রোচ এর সমন্বিত চিকিৎসায়।
ইসলামে পবিত্র কোরআন হচ্ছে এমন একটি গ্রন্থ যেখানে উল্লেখযোগ্য যেকোনো বিষয়ে কোনো না কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। হতাশা নৈরাশ্য, দুঃখবোধ এসব বিষয়ে কোরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। এসব আয়াতে আল্লাহর উপর নিশ্চিন্ত নির্ভরতার দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে অনেক বেশি। যেমন সূরা বাকারার ২৫৭ নম্বর আয়াতের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, “আল্লাহ বিশ্বাসীদের অভিভাবক। তিনিই তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসেন।” রাসূলে পাক সাঃ এর কাছে এক পর্যায়ে ওহী বা ঐশী বাণী আসা কিছু দিন বন্ধ ছিল। সেজন্য আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) কিছুটা বিচলিত ছিলেন। মুফাসসিরে কোরআন বা তাফসীরবিদরা বলেন ঠিক ওই সময়টাতেই অবতীর্ণ হয় পবিত্র কোরআনের ৯৩ নম্বর সূরা – সূরা আদ দোহা। ঘোষণা দেয়া হয়, (আয়াত ৩-৫) “(হে নবী!) তোমার প্রতিপালক কখনো তোমাকে ত্যাগ করেন নি। না তিনি কোনো ব্যাপারে তোমার ওপরে অসন্তুষ্ট। নিঃসন্দেহে তোমার পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে পরবর্তী সময় অনেক ভালো। অচিরেই তোমার প্রভু তোমাকে এমন নেয়ামত দান করবেন, যাতে তুমি পরিতৃপ্ত হবে”। সেজন্য সূরা আদ দোহাকে হতাশা দূর করার দোয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিপদ, প্রতিকূল পরিস্তিতিতে বিচলিত না হয়ে, হাল ছেড়ে না দিয়ে ধৈর্য্য ধারণের বিষয়টি কোরআনে এসেছে অনেকবার। যেমন সূরা বাকারার ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো”।
অশান্তি, অপ্রাপ্তি, নিরাশায় চারদিক যখন আধার হয়ে আসে, যখন বন্ধ হয়ে যায় সামনে আগানোর সব রাস্তা, যখন মনে হয় কারো জন্য কোথাও কেউ নেই, তখনও একজন উন্মুক্ত করে রাখেন মানুষের জন্য তার করুণা, ক্ষমা ও প্রশান্তির সব দরোজা। আহবান জানান, “ প্রার্থনায় যে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাক শুনি। তার ডাকে সাড়া দেই (২:১৮৬)”। মনোবল তলানিতে পৌছে যাওয়া মানুষকে আশ্বাস দেন, “ওয়া লা তাহিনু ওয়া লা তাহযানু ওয়া আনতুমুল আ লাউনা ইন কুনতুম মুহমিনিন – হতাশ হয়ো না, দুঃখ করোনা। জয়ী তুমি হবেই যদি মুমিন হও (৩:১৩৯)”।
চিরস্থায়ী সুখ, প্রশান্তি, নিরাপত্তা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। স্রষ্টায় নিখাদ বিশ্বাসী মানুষের মনে এমনিতেই জন্ম নেয় আশ্চর্য্য এক নিরাপত্তা বোধ। গড়ে উঠে প্রশান্তির এক অদৃশ্য বলয়। এই ‘বিশ্বাস’কে বাদ দিয়ে জীবনভর খুঁজলেও মানসিক প্রশান্তি আসে না জীবনে। অনেকটা ফকির লালনের গানের মতোই, “নড়ে চড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনম ভর মিলে না” ।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে
বরাবরের মতো লেখায় সুন্দর চিন্তার প্রকাশ। শুভকামনা বাবাই, সালাম।