কমলাকান্তের লালসালু মোড়ানো মোটা “দপ্তর” খাতাখানি এখন আমার নিকট । দুইদিন পূর্বে তিনি তাহার ফ্ল্যাটের চাবি এবং খাতাখানি আমার কাছে গচ্ছিত রাখিয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছেন । আমি উদ্বিগ্ন হই নাই , কারণ প্রায়শঃই তিনি এই রূপ করেন এবং কয়েকদিন পর ফিরিয়া আসেন । সময় ক্ষেপণ উদ্দেশ্যে আনমনা হইয়া খাতাখানি খুলিয়া পড়িতে লাগিলাম । পড়িতে পড়িতে আমার মস্তিষ্ক সচকিত হইয়া উঠিল এবং মনস্থির করিলাম যে , ইহা আমার সন্মানিত পাঠকদের নিকট উপস্থাপন করিবো…..
—জন্ম-মৃত্যু-স্রষ্টা—
আমি কমলাকান্ত । রহস্য আবৃত স্রষ্টা কর্তৃক বর প্রাপ্ত হইয়া রহস্যময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ রূপে রহস্যময় পৃথিবীতে প্রেরিত হইয়াছি । এই প্রেরিত হইবার নাম ,” জন্ম”। আমাকে পৃথিবীতেআনয়নে যাহারা সম্পৃক্ত ছিলেন ,তাহারা নিশ্চিত জানিতেন যে , আমাকে রহস্যময় স্থানে ফিরাইয়া নেওয়া হইবে।এই ফিরাইয়া লইবার নাম,” মৃত্যু অথবা ইন্তেকাল”।( ইন্তেকাল আরবী শব্দ, ইহার বাংলা শব্দার্থ “স্থান পরিবর্তন” )
অতঃপর আমি কমলাকান্ত, সর্বক্ষণ একখানা মৃত্যু পরোয়ানা হস্তে লইয়া পৃথিবীময় সানন্দে বিচরণ করিতেছি । আরো অধিক পরিতাপের বিষয় হইলো , সেই পরোয়ানা পত্রে কোন প্রকার দিন, ক্ষণ বা সনের উল্লেখ নাই । আমি ইহাকে ” অনিশ্চিত যাত্রা ” নামকরণ করিয়াছি । একদিনের শিশুর মৃত্যু ঘটিতেছে , অথচ প্রায় শত বর্ষীয় একজন পক্ষাঘাত গ্রস্থ মানুষ অহর্নিশি স্রষ্টার নিকট মৃত্যুর আবেদন করিয়াও মৃত্যু দূতের দেখা মিলিতেছে না । যাহা, অনিশ্চিত যাত্রার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বটে ।
এই অনিশ্চিত যাত্রা বোধ প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান । কিন্তু স্রষ্টা তাহার পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে , মানুষের মনের মধ্যে ” চাহিদা ” এবং ” প্রেম” নামক অনুভূতি অত্যন্ত সুকৌশলে স্থাপন করিয়া উক্ত বোধের বিস্মৃত ঘটাইয়াছেন । ফলে আমি কমলাকান্ত বিভ্রান্ত হইয়া অপরিসীম চাহিদা আর ভালোবাসার নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া অন্ধের মত ছুটিয়া চলিয়াছি ।
কিন্তু কি লাভ হইলো ? দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া আমার জন্মদাতা পিতা এবং আমার গৃহলক্ষ্মী সহধর্মিণী, বাঁচিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াও অকালে চিরপ্রস্থান করিলেন । আমি হতবাক হইয়া অসহায় দন্ডায়মান রহিলাম । অর্থ, সম্পদ, প্রেম , ভালোবাসা তাহাদের মৃত্যুকে রোধ করিতে পারিলোনা। স্রষ্টা আবারো আমার মস্তিষ্ক হইতে ক্ষণিকের জন্য , বিস্মৃত ভাব অপসারণ করিলেন । যাহাদের অনুপস্থিতিতে আমার জীবন ধারণ কল্পনাতীত ছিল, তাহাদের প্রাণহীন দেহ আমার নিকট নিতান্তই পরিবেশ দূষণশীল বস্তু বলিয়া মনে হইলো । আমি তাহা সৎকারে ব্যাস্ত হইলাম ।
তাহাদের মায়ময় মুখ চিরতরে অন্তর্ধান হইয়া গেল । অতিব আশ্চর্যের বিষয় হইতেছে, এই উপলক্ষে আমি আমার আত্বিয় এবং বন্ধুজন সহ মিষ্টান্ন ভক্ষণ(!!!!)করিলাম !!!!!!
অতঃপর আমি কমলাকান্ত স্রষ্টার প্রতি বিরূপ হইয়া ” নাস্তিক ” হইবার মনস্থ করিয়াছিলাম । কিন্তু ব্যর্থ হইয়াছি । গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া নাস্তিক হইবার যুক্তি অন্বেষণ করিতেছিলাম । হঠাৎ আমার অবচেতন মন আমাকে কহিল ,” মানুষ যাহা সৃষ্টি করিয়া তৃপ্তি লাভ করে , গর্ব করে , অহংকার করে তাহা যৌগ ।মানুষ মৌল সৃষ্টি করিতে পারে না । তাহারা কতগুলি মৌল কে সংমিশ্রণ করিয়া যৌগ সৃষ্টি করে মাত্র । মৌল সৃষ্টির একমাত্র ক্ষমতাধর কারিগর হইলো , মহান সৃষ্টিকর্তা । তিনি আছেন এবং এই ক্ষমতা তিনি কাহাকেও প্রদান করেন না”।
আমার নাস্তিক হওয়া হইলো না । আমি কমলাকান্ত ভাবিয়া দেখিলাম যে , যৌগ বস্তু ছাড়া আমি অচল । মৌল ছাড়া যৌগ সৃষ্টি অসম্ভব । অতএব মৌল সৃষ্টির একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা সম্ভব নহে ।
যেহেতু আমি মৌলিক সেহেতু আমাকে তিনিই সৃষ্টি করিয়াছেন । কোন মানুষের পক্ষে আমার জন্ম মৃত্যু ঘটানো , রোধ করা এবং ইহার রহস্য ভেদ করা সম্ভব নহে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- –
বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হইয়াছে, একদা গভীর নিস্তব্ধ রাত্রিতে সৃষ্টিকর্তার সহিত আমার আত্মিক যোগাযোগ ঘটিয়াছিল ।আমি তাহাকে বলিয়াছি……. ” তোমার কর্মকান্ড আমার বোধগম্য নয় । যাহা আমার বোধগম্য নয়, তাহা লইয়া আমি তোমার সহিত বিবাদ করিবো না । তুমি যথেচ্ছ তোমার কর্ম করিয়া যাও ।আমি কমলাকান্ত সদা প্রস্তুত”………..।।।।