লেখার শিরোনাম নির্ধারণের চেষ্টা করছি। আমার মেয়ে লামিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম “ আচ্ছা মা, মানুষের মনকে কি ফড়িঙের সাথে তুলনা করা যায়?” খানিকটা বিস্মিত লামিয়ার উত্তর, “ Foring ? What is the Foring ?” সমস্যায় পড়লাম, ফড়িঙের ইংরেজি কি মাথায় আসছে না । ভেবে চিন্তে বললাম, “Grasshopper”। এবার লামিয়ার আরো অবাক হবার পালা, “ How do you compare grasshopper with the human mind ? The speed of the thought process of an average human being ranges between 70-120 miles per second whereas grasshopper ……….”। ফড়িং একলাফে কতদূর যেতে পারে সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞান নির্ভর বক্তব্য থামিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে মানুষের মন আর ফড়িঙের গতির তুলনা আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আমি মানুষের মনের সাথে ফড়িঙের সাদৃশ্য খুঁজে পাই অন্য জায়গায়। ফড়িঙের মতো মানুষের মনও একজায়গায় স্থির থাকে না, লাফিয়ে বেড়ায় দিকবিদিক। লক্ষ মাইল পাড়ি দেয় এক নিমিষে। এই লাফিয়ে বেড়ানো অস্থির মনকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে প্রতিনিয়ত বিপাকে পড়ে মানুষ। কিভাবে ? নিজেকে জিজ্ঞেস করলেই এর উত্তর মিলবে।
আমরা জানি প্রার্থনার সময় একাগ্রতার দরকার হয়। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক ওই সময়টাতেই ঘটে তার উল্টো। বেড়ে যায় তার মনের অস্তিরতা। দেখা গেলো দাঁড়িয়ে আছি জায়নামাজে আর মন তখন রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের ‘পাগলা হাওয়া‘ হয়ে বিপুল গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে অন্য কোথাও। কিংবা কর্মক্লান্ত দিন শেষে ঘুমানোর চেষ্টা, ঠিক সেই মুহূর্তেই হাজারটা এলোমেলো চিন্তা মাথার মধ্যে গিজ গিজ করে। প্রশান্তির ঘুম তখন পালিয়ে যায় হাজার মাইল দূরে। বিশেষজ্ঞদের মতে গড়ে একজন সাধারণ মানুষ প্রতিদিন প্রায় ৫০০০০ চিন্তা করে – অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় মানুষের মনে আসা চিন্তা বা ভাবনার সংখ্যা প্রায় ২১০০। তার মানে আমাদের মন কোনো না কোনো ভাবনা নিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ মন ফড়িঙের এই লম্ফ ঝম্ফ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করেছিলেন। তিনি জানতেন পার্থিব ও অপার্থিব অনেক পরিবর্তনেরই মূল বাহন হচ্ছে মন। বুদ্ধ অবশ্য ফড়িং নয়, মনকে তুলনা করেছিলেন বানরের সাথে। “Kapicitta” বা “ Having a Monkey Mind” প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “Just as a monkey swinging through the trees grabs one branch and lets it go only to seize another, so too, that which is called thought, mind or consciousness arises and disappears continually both day and night.”। এই “ বানর মন” কে বশীভূত করার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন বুদ্ধ, প্রতিদিন শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রবাহকে গুরুত্ব দিয়ে মনকে শান্ত করার জন্য নীরবে মেডিটেশন করার উপদেশ দিয়েছেন, “— you can, over time, tame the monkeys. They will grow more peaceful if you lovingly bring them into submission with a consistent practice of meditation”। মেডিটেশনের ব্যবহার এখন লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সমসাময়িক মনস্তত্ত্বে শুধু “Flight of Thoughts” নিয়ন্ত্রনেই নয়, বিষন্নতা, দুঃশ্চিন্তা, Borderline Personality Disorder সহ আরো অনেক মানসিক স্বাস্থ্যজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়ও Mindfulness based Cognitive Therapy, Mindfulness based Dialectical Behavioural Therapy ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনেও আত্ম উন্নয়নে নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার কোনো বিকল্প নেই।
সুফী সাধক, মহাপুরুষেরা মনের দাসত্ব করেন না। মন থাকে সম্পূর্ণ তাদের নিজের নিয়ন্ত্রণে। মনকে জয় করে তারা পৌঁছে যান অনন্য এক আধ্যাত্মিক উচ্চতায়। আমরা পারিনা। আমাদের মতো নগন্য, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। মনের সাথে নিত্য যুদ্ধ করেই আমরা বেঁচে থাকি। “Monkey Mind” প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদের।