পৃথিবীতে কঠিন কিছু কাজের মধ্যে সম্ভবত একটি হচ্ছে আশাহীন মানুষের মনে আশা জাগানো। আশা নিরাশায় দোলায়মান মানুষকে জাগানো সম্ভব হলে ও যিনি ‘কিছুই হবে না’ বলে হাত পা ছেড়ে বসে আছেন তাকে নাড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। অনেকটা জেগে ঘুমানো মানুষকে জাগানোর মতোই। বৃহত্তর অর্থে মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীরা আশা জাগানো এবং স্বপ্ন দেখানোর এই কাজটিই নিভৃতে করে যান দিনের পর দিন। কাজ করতে গিয়ে দেখি অনেক মানুষই বুকের মধ্যে পুষে রাখেন পাহাড়সম আক্ষেপ অথবা ‘হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট’ । সমাজ সংসার ছেড়ে আসা এসব মানুষ নিজের মধ্যে গড়ে তুলেন আর এক ভুবন। কেউ কেউ মাঝে মাঝে ফেলে আসা দিনের ডালা খুলে বসেন, আবার কেউ কেউ নিজের অতীত জীবনের ধারে কাছেও ভিড়তে চান না। এদের পথচলা হয়ে উঠে উদ্দেশ্যহীন। এদের অনেকেই জানেন না এবং জানতেও চাননা যে জীবনের কোন ঘাটে তাদের তরী ভিড়বে। অথচ কোনো না কোনো ‘Purpose’ নিয়েই পৃথিবীতে আমাদের পদার্পন। যদিও জানি যে এদের অনেকের আপাতত থেমে যাওয়া জীবনের চাকা শুধু motivational counselling দিয়ে ঘুরানো সহজ নয়, তবুও বুঝানোর চেষ্টা করি এই বলে যে ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে যেকোনো একটি লক্ষ্য নিয়েই মানুষ বাঁচে। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচলে জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে, প্রতিটি দিন উপস্হিত হয় নুতন সম্ভাবনা নিয়ে। শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার সময় আক্ষেপ থাকে না। বাংলাদেশের প্রচলিত প্রবাদ “যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষন আশ” কে নুতন মোড়কে নুতনভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করি। উত্তরে কেউ মাথা নাড়েন, আবার কেউ অসীম শূন্যতা নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে হয়তো খুঁজে ফিরেন জীবনের অন্য কোনো অর্থ। শুধু মানসিক স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ এবং আসক্তি আক্রান্ত মানুষই নয়, আশে পাশে দেখি কেউ কেউ পারিপার্শিক অবস্থা, সীমাবদ্দতা অথবা জীবনের ভারে নুয়ে পড়েন, কিংবা হারিয়ে ফেলেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়তো প্রতুল মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন,
“কলা বেচো, কয়লা বেচো, বেচো মটরদানা
বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক, কান্না বেচোনা।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে, হাজার টাকায় সোনা
বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচোনা।”
সব কিছু বিক্রি হলেও শুধু স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখার হৃদয় নিংড়ানো এই আকুতি খুব কম গানেই শুনি। এই স্বপ্নটুকুই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের, প্রেরণা জোগায় জীবনের জটিল পথ চলায়। হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতেও মানুষ উঠে দাঁড়ায় । আবারো স্বপ্ন দেখে নুতন দিনের। মানুষ লিখে Long Walk to Freedom এর মতো অদম্য মনোবল আর ঘুরে দাড়ানোর ইতিহাস সৃষ্টির কাহিনী। সব বাধা ডিঙিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদাহরণ আমাদের চারিপাশেই রয়েছে বিস্তর। এই স্বপ্ন না থাকলে সহজেই দানা বাধে কষ্টবিলাস, অনেকটা হেলাল হাফিজের ‘ফেরিঅলা’ কবিতার মতোই,
“কষ্ট নেবে কষ্ট,
হরেক রখম কষ্ট আছে।
কষ্ট নেবে কষ্ট,
——হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।”
‘কষ্টের ফেরিঅলা’ না হয়ে চেষ্টা করি নাহয় লাল টুকটুকে সেই স্বপ্ন নিয়েই বাঁচার।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে
ছবি:-সৌজন্যে Tom Jones
স্বপ্নের সওদাগর হাসান ভাই,
সুন্দর লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জীবনের এই লম্বা চলার পথে স্বপ্নগুলো কবে কোথায় হারিয়ে ফেলেছি, তা আজ আর মনে নাই।
শুধু মনে আছে একদিন স্বপ্ন ছিলো. ……
প্রদীপ হয়ে আলো জ্বালানোর ক্ষমতা আমাদের নেই, কিন্তু আয়না হয়ে সেই আলো প্রতিফলনের চেষ্টা অন্তত করতে পারি. সেই আশাতেই এই লেখা. ধন্যবাদ হাফিজ ভাই.