টরন্টো থেকে:-
তখন সবে আব্বার সংগে আমার পছন্দের অমিল শুরু হয়েছে। আমার বয়স নয়/দশ হবে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো চুল কাটা নিয়ে। বাসায় নাপিত ডেকে, আব্বা নিজে দাড়িয়ে থেকে চুল কাটাবেন। “আরো ছোটো..আরো ছোটো…” বলতে বলতে আমার সজারুর কাটা মার্কা চুলের যে অবস্থা করে ছাড়তেন তা দেখে আমার বুক ফেঁটে কান্না আসতো। কিন্তু মুখ ফোঁটার সাহস ছিলোনা। চুল কাটার পর ৩/৪ দিন বাসা থেকে বেরুতে চোর চোর লাগতো। বন্ধুরা দেখলেই..”কিরে কালা কদম…কই যাস..”। আয়নায় দেখেছি। আসলেই মাথাটাকে কালো কদম ফুলের মতোই লাগতো!
আর জুতা কেনা….?? জুতার দোকানে গেলেই আমি ঠিক ঠিক বুঝে ফেলতাম আব্বা আমাকে কোন জুতাটা কিনে দেবেন। একবার জুতার দোকানে গিয়ে শো-কেসে একটা মাথা মোটা, বাল্মিকী জুতা (সুপ্রাচীন কবি বাল্মিকী’র আমলে যে জুতা ব্যবহৃত হতো) দেখে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকলাম। “আল্লাহ এই জুতা আমার কপালে দিও না..প্লিজ…এই জুতা পায়ে দিলে আমি আত্মহত্যা করবো!” আল্লাহ এই না-লায়েক বান্দার ডাক শুনলেন না। স-ব জুতা বাদ দিয়ে আব্বা সেই জুতাটাই নামাতে বললেন! পাহাড়সম বোঝা বুকে আর পায়ে সেই বাল্মিকী জুতা নিয়ে আমি সেদিন বাড়ী ফিরেছিলাম।
সময় চলে যায়। বোঝা যায় না। তখন বড় হয়েছি। চাকরী করি। আম্মা চলে গেছেন। আব্বা একা। সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। কথা-বার্তা প্রায় বলেনই না। জাগতিক অনেক কিছুর উপরই আগ্রহ আর নিয়ন্ত্রন হারিয়েছেন।
গুলশান ২ থেকে জ্যাম ঠেলে ঠেলে কল্যানপুর আসতে সাতটা-সাড়ে সাতটা বেজে যেতো। কাপড়-চোপর পাল্টে গোসল করার আগে আব্বার ঘরে যেতাম।
“আব্বা আজকে কেমন?”
আব্বা পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন। ঘুরে চিৎ হয়ে শুতেন। মুখে কিছুই বলতেন না। আমার চোখের দিকেও তাকাতেন না। আমি আব্বাকে বুঝতাম। তাই আমিও এই সময় তার চোখের দিকে তাকাতাম না। মাথা নিঁচু করে চুপচাপ আব্বার ডায়াপার পাল্টে দিতাম। আব্বার দিনে দুইবার ডায়াপার পাল্টে দিতে হতো। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে ফিরে। শেষের দিকে আব্বা অসম্ভব শুকিয়ে গিয়েছিলেন। ঝুলে পরা চামড়ার দিকে তাকানো যেতো না। হাতের আঙ্গুলগুলো অসম্ভব রোগা রোগা। সব কিছু পরিষ্কার শেষে আমি তার লুঙ্গি পাল্টে দিলে সেই রোগা আঙ্গুলে তিনি লুঙ্গির গিঁট টাইট দিতেন। কোনো কথা না বলে আবার জানালার দিকে পাশ ফিরতেন। আমি চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম।
আমি আমার জীবনে দুজনের ডায়াপার পাল্টে দিয়েছি। আমার আব্বার আর আমার ছেলের। আমি আমার দুহাত বাড়িয়ে দুই দিকে দুজনকে ধরে দাড়িয়ে আছি। নিজেকে প্রায়শ:ই আমার নদীর মতো মনে হয়। উত্তরে হিমালয় থেকে সৃষ্টি হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু এই নদীর জল রংহীন না। টকটকে লাল। বিরামহীন বয়ে চলা এই নদীর ভালোবাসার রং রক্তের মতোই লাল।
শৈবাল ভাই, আপনার লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো. নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় যখন চিন্তা করি মা বাবার জন্য. জীবন ভর যারা অসীম মমতায় আগলে রাখেন সন্তানদের, বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে যান অবিরাম, তথাকথিত সমৃদ্ধ জীবনের আশায় আমরা তাদেরকেই ফেলে চলে আসি. কে জানে, বেচে থাকলে পরিনত বয়েসে হয়তবা ওল্ড হোমে বসে আমরাও একই স্মৃতি রোমন্থন করব. আপনাকে আবার ও অনেক ধন্যবাদ ভিন্নধর্মী সুন্দর একটি লেখার জন্য. আরো লেখার প্রত্যাশায় রইলাম.