নরওয়ে থেকে –
২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পড়ালেখার জন্য লন্ডনে ছিলাম। প্রতি রবিবারে আমার ছুটি ছিলো। ছুটির দিনে হয় সালমা ফুফুর বাসায় যেতাম নয়তোবা সফিনা আপার বাসায় যেতাম। সালাম ফুফু আমার আব্বার দূর সম্পর্কের এক বোন হন তবে আব্বার দূর সম্পর্কের বোন হলেও তিনি আমার আব্বাকে অনেক ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। কথায় কথায় সব সময় বলতেন আমার ভাই সাহেবের মতো ভালো লোক পৃথিবীতে খুব কম আছে। আব্বার প্রতি অপার শ্রদ্ধার কারণে ফুফু আমাকে অনেক যত্ন নিতেন। লন্ডনে কাটানো দিনগুলোতে সালমা ফুফুর বাসায় বেড়াতে গেলে ফুফু আমার কাপড় ধুয়ে দিতেন, গুসলের জন্য গরম পানি ভর্তি বাথ ট্যাব রেডি করে দিতেন এবং অনেক মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়াতেন। ফুফুর বাসায় বেড়াতে গেলে ফুফার সাথে দিনভর গল্প হতো । দেশ, রাজনীতি, ধর্ম, পরিবার নিয়ে ফুফার সাথে আলাপ আলোচনায় কোনদিকে যে দিন কেটে যেতো বুঝতমান ই না। ফুফুর তিন মেয়ে ছিল যারা আমার ভক্ত ছিলো, তারা সপ্তাহভর আমার জন্য অপেক্ষায় থাকতো যে কখন আমি ওদের বাসায় বেড়াতে যাবো কখন আমি ওদের সুন্দর সুন্দর গল্প শুনাবো।
যাই হোক আসল ঘটনায় আসি। আমার সালমা ফুফুর হাসবেন্ডরা কত ভাইবোন তা আমার সঠিক মনে নেই। তবে উনার সাথে কথা বার্তা বললেই উনি সব সময় ওনার এক ছোট ভাইয়ের গল্প করতেন যিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকেন। ফুফা ওনার সেই ছোট ভাইকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করতেন। ওনার সেই ছোট ভাই দেশে মৌলানা হিসেবে পড়ালেখা করলেও দক্ষিণ আফ্রিকাতে এসে নিজের ব্যবসা দিয়ে খুব কম সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান এবং দিনকে দিন উনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে একটার পর একটা দোকান খুলতে থাকেন। আমি দেশে থাকতে প্রায় সময় খবর কাগজে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশীদের নির্মমভাবে হত্যার খবর পড়তাম এবং আমাদের আস পাশের গ্রামগুলোর অনেকেই যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন জানতাম তাই ফুফাকে ওনার ভাই যাতে সাবধানে থাকেন সে জন্য উপদেশ দেবার অনুরোধ করতাম। ফুফা সব সময় বলতেন যে ওনার ভাই মৌলানা হলেও অনেক বুদ্ধিমান মানুষ তাই উনার ভাইয়ের কিছু হবেনা।
২০০৯ সালের শেষের দিকে বিয়ে করে আমি নরওয়ে চলে আসার পর ব্যস্ত হয়ে গেলে সালমা ফুফুর সাথে কয়েক মাসের জন্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমার মেয়ের জন্মের বছরখানেক পর একদিন আমি লন্ডনে ফুফুকে আবার ফোন করি। অনেক্ষন কথা হবার পর উনাকে ফুফার কথা জিজ্ঞেস করি এবং ফুফাকে ফোনটা দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। ফুফুর কাছ থেকে জানতে পারি ফুফা এখন কারো সাথেই তেমন একটা কথা বলেন না কারণ কয়েকদিন যাবৎ উনি অনেক অসুস্থ কেননা কারা জানি ওনার ছোট ভাইকে দক্ষিণ আফ্রিকায় তার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্টানে ঢুকে গুলি করে হত্যা করেছে যা ফুফা কোনো মতেই মেনে নিতে পারছেন না। নিজের স্নেহের ছোট ভাইয়ের এমন অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে যে কারো শারীরিক কিংবা মানুষিক অবস্থা ফুফার মতোই হবার কথা।
আজকেও দেখলাম আমাদের আস পাশের গ্রামের অন্য অনেকের মতো আরো এক তরুণ যুবক কে দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। যদি বিগত ২০ বছরে আমাদের আমাদের আশ পাশের গ্রামেরই ২০-২৫ জন মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়ে থাকেন তবে সারা বাংলাদেশের কতজন মানুষ বিগত বছরগুলোতে ওই দেশটিতে মৃত্যু বরন করেছেন ভাবতে গেলেই গা শিউরে উঠে।
আশার কথা হচ্ছে আস্তে আস্তে বাংলাদেশ বদলে যাচ্ছে । পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে দেখার দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প বিপ্লব ঘটবে বলে আশা করছেন অনেকেই। দেশে অনেক কলকারখানা গড়ে উঠলে অনেক কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করি। তাই আশা রাখি জীবন বদলানোর জন্য বাংলাদেশিরা আগামীতে দেশ ছেড়ে এমন কোনো দেশে পাড়ি দেবেন না যেখানে পদে পদে মৃত্যুর ভয় থাকে। জীবনে সফলতা দরকার তবে যে সফলতার জন্য অকালে প্রাণ দিতে হয় সে সফলতা কোনো ক্রমেই কাম্য নয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল প্রবাসী ভাই বোনদের জন্য শুভকামনা সব সময়।