Domestication Syndrome বলে বিবর্তনে একটা ধাপ আছে। বন্য জন্তু যখন বেশ কয়েক পুরুষ ধরে মানুষের পোষ্য হিসেবে থাকে , তখন তাদের বেশ কিছু শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। যেমন বন্য কুকুর বেড়ালের খাড়া কান নেতিয়ে পড়ে, পশমের রঙ ম্লান হয়ে আসে, খাড়া নাক ছোট হয়ে আসে। কারন মানুষের সাথে থাকার কারনে তাদের সর্বদা উৎকর্ন হয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় না। তাদের শরীরে এড্রেনালিন নামক বিশেষ হরমোন নি:সরন কমে যায়, ফলে তাদের আচরন ও বন্য থেকে শান্ত হয়ে ওঠে। সবটাই ঘটে নিউরাল ক্রেস্ট নামের কিছু দেহকোষের বিবর্তনে।
বিবর্তনে না হলে ও আপাত দৃষ্টিতে মানুষেরও Domestication ঘটে, বিশেষ করে মেয়েরা যখন মহিলা হয়ে ঘর সংসারে জড়িয়ে রান্নাঘর, কাজের লোক আর হিন্দি সিরিয়ালে হারিয়ে যায়, বিপুলা পৃথিবীর অন্য কিছুতে তাদের আগ্রহ থাকে না।
একসময় আমি নিজের জন্য সময় আলাদা করতাম, প্রিয় লেখকের বই হাতে কফিশপে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আসতাম, একা। ভরদুপুরে একান্ত পছন্দের মুভি দেখতাম চায়ের কাপ হাতে। এইসব কিছু আমাকে ভীষন ভাবে উজ্জীবিত করতো, সতেজ করতো।
আমার domestication ঘটতে শুরু করলো। বাচ্চা সামলে আর কিছু করার ইচ্ছেটাই চলে গেল। ভুল বুঝবেন না, বাচ্চা সংসার ইত্যাদি আমার ওপর চাপ ছিলো না। আমি নিজেই চাইতাম বাচ্চার সাথে সময় কাটাতে। আর তখন ঢাকা শহরে ছোট বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার জায়গাই বা কোথায় ! আমি ঘরকুনো হয়ে গেলাম। আমার পৃথিবী সন্তানময়, ধুলো জমতে থাকে বইয়ের মলাটে, হাত পড়ে না মিউজিক সিস্টেমে, টিভি তে চলে শুধু কার্টুন।তানপুরার ছেঁড়া তার মেরামত হয় না, বাক্সবন্দী হারমোনিয়াম, রেডিও প্রোগ্রাম ছেড়ে দিয়েছি, লিখি না কোথাও বহুদিন। বাচ্চা স্কুলে যাওয়া শুরু করার পরেও তেমন হেলদোল ঘটেনি, তখন ভীনদেশে নতুন সংসার, জামাইয়ের নতুন চাকরী পড়ালেখা, আমি সংসার গোছানোর নামে বিছানার চাদর পাল্টাই, রান্নার নামে নতুন সব মশলা কিনি, নিত্যকার রান্না খাওয়া ধোয়া মোছা অভ্যাসগত রমনে দিনগত পাপক্ষয় করে মোক্ষলাভের চেষ্টা করি। পড়ালেখায়, অফিসে ইঁদুর দৌড় ক্লান্ত আমাকে আরও ভীষন ভীষন ক্লান্ত করে তোলে।
হঠাৎ, একদিন, কেন যেন মনে পড়ে, এই যে এইটা, এইটা ঠিক আমি না। আমার আমি কে এক দীর্ঘ শীতনিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে আমার ছায়া ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে।
আমি ছিলাম উচ্ছল, প্রানবন্ত, রঙীন বুদ্বুদের মতো। অনবরত হাত নেড়ে বকে যাওয়া কিশোরী, যার হাসি আর কথা অতিষ্ঠ করে ছাড়তো বাসা স্কুল কলেজে সবাইকে।পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম বিষয়েও যার ছিল প্রবল আগ্রহ, সারারাত পরীক্ষার পড়া পড়েও সকালে দু’পাতা গল্পের বই না পড়লে যার ঘুম আসতো না।
আয়নায় দেখলাম এক মাঝবয়সী মহিলার মুখ। স্থুলকায়া, চোখের কোলে কালির পোঁচ, চোখ হারিয়েছে দ্যুতি, রাজ্যের ক্লান্তি চিবুকের খাঁজে, চুলের ভাঁজে রুপোলি ঝিলিক। চমকে যাইনি, এমনটাই ভেবেছিলাম। সময় নিলাম।
ভাবলাম, আমি কি চাই। ভালোই তো আছি। Aging gracefully. মধ্যবয়স তো আসবেই, তারুণ্য কি চিরকাল থাকে? কেটে গেলো আরো কিছুদিন।
কিন্ত কেন যেন শেষ চৈত্রের বাতাসে আবার মনটা হু হু করতে লাগলো, গুটিয়ে রাখা গল্পের বইয়ের বাক্স খুলে গুছিয়ে রাখলাম একদিন, ভরদুপুরে চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে আবার দেখলাম অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’, ঘুমাবার আগে ফ্রেন্ডস রি-রানের বদলে আবার দেখলাম Eat Pray Love.
এ যেন ফুলের মেলায় মৃদু বাতাসে বসে এক অচিন মনকেমন, ‘কি জানি কিসের লাগি প্রান করে হায় হায়’। বুঝতে পারলাম সময় হয়েছে। তৃষিতের মতো অপেক্ষা করতে লাগলাম আমার নিজের জন্য, শর্বরীর প্রতীক্ষা।কোন এক প্রস্তর যুগে চাপা পড়া মহাকালের মতো গভীর শীতনিদ্রা ভেঙে জেগে উঠছিলাম আমি।
নিজের ভবিষ্যতের কাছ থেকে অতীতের নিজেকে ফিরে পেতে চাওয়া অলীক কল্পনা নয়।ফিরে যে পেতেই হবে এমন ও কোন কথা নেই। তবে নিজেকে সময় দিন। তারুণ্যে থাকুন কি প্রৌঢ়ত্বে, উপভোগ করুন এই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে আরো আশ্চর্য সুন্দর জীবন কে। ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
লেখক: মাফিয়া মালিক /ডাক্তার ও স্বাস্থ্য গবেষক
অনেক ধন্যবাদ একটা সুন্দর লেখার জন্য , খুব ভালো লাগলো।
আশাকরি নিয়মিত লিখে যাবেন।