গত চার মাস ধরে বাংলা বই পড়ি না, দম বন্ধ হয়ে আসে। তার চাইতেও বড় কথা হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ি না। নিকেতনের বাসায় আমার কয়েক হাজার বই আছে। কিছু আছে কেনা হয়েছে, কিন্তু পড়া হয়নি। তারপরও মধ্যরাতে কোন কারণে অস্থির লাগলে বা ঘুম না আসলে, কখনও না পড়া বইগুলো আগ্রহ মেটাতে পারেনি, বহুবার পড়া হুমায়ুনের বইয়েই ফিরতে হয়েছে বারংবার।
সপ্তাহখানেক আগে বিশ্বতরঙ্গ (world wide web) ঘেঁটে জানতে পারলাম, টরোন্টোর কিছু পাবলিক লাইব্রেরিতে নাকি বাংলা বই পাওয়া যায়! সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি আমার অস্থায়ী নিবাস থেকে হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। বিবি-বাচ্চাকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম ঝটপট। লাইব্রেরিয়ান অমায়িক ভদ্রমহিলা, যতটুকু জানতে চাই, তার চাইতেও ঢের বেশী সাহায্য করতে চান। কম্পিউটারে ঢুকে, নানাকিছু ঘেটেঘুটে বললেন, “আমাদের বাংলা বইয়ের সংগ্রহ মাঝারি। তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না। তবে আমাদের সংগ্রহই এখানে সবচেয়ে ভালো, অন্য আরও কিছু লাইব্রেরিতে আরও কিছু বই পাবে, কিন্তু সংখ্যায় আমাদের চাইতে বেশী নয়।” আমি ভদ্রমহিলাকে শুকরিয়া জানিয়ে লাইব্রেরির নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে যাই। মুগ্ধ হয়ে দেখি প্রায় হাজারখানেক বাংলা বই। মহিলাকে বলা হয়নি, আমার একটা বাংলা বই হলেই চলত, আমি তো আর পড়তে আসিনি, জীবনে বহু বাংলা বই পড়েছি, তার মানে এই নয় যে আর পড়তে নেই, কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য তো বইয়ের মলাট উল্টে বাংলা বর্ণমালায় হাত বুলোনো!
যাই হোক, এমনিতে রেফারেন্স লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি বই আনতে দেয় না, ওখানেই বসে পড়তে হয়, তবে ভিনদেশী বই আনা যায়। হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটা বই নিয়ে এসেছি, তারমধ্যে একটি হচ্ছে ৯০ দশকের নির্বাচিত পাঁচটি উপন্যাস। এই উপন্যাসগুলোর কোনটিই পাঁচ-সাতবারের কম পড়া হয়নি। রাতের খাবারের পর এক শোয়ায় পড়ে শেষ করলাম কৃষ্ণপক্ষ। অসম্ভব প্রিয় একটা উপন্যাস আমার। তবে আজ রাতে উপন্যাসটা পড়তে পড়তে চমকে যাচ্ছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে অসম্ভব প্রিয় কিছু লাইন থাকে, ছোট থাকতে আমি সেসব লাইনের নিচে দাগ দিয়ে রাখতাম। কৃষ্ণপক্ষ পড়ার সময় দেখি আমি হলে যেসব লাইনের নিচে দাগ দিয়ে রাখতাম, ঠিক সেই সেই লাইনের নিচে পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়া!
এই বইগুলো টরোন্টো লাইব্রেরি কীভাবে কোথা থেকে জোগাড় করে কে জানে! খুব ইচ্ছে করছে এই বইয়ের লাইনগুলি যে দাগ দিয়ে রেখেছে তার সাথে গল্প করতে। এখন তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। এক মাগ কফি হাতে ডাউনটাউনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে গল্পও করা যেত। প্রিয় ঔপন্যাসিককে নিয়ে টুকটাক গল্প; চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি নিয়ে হালকা আলাপ, কুশল বিনিময়।
এখানে সবকিছু খুব গোছানো। চাইলে এই বই আমার আগে কে কে ধার করেছে বের করে ফেলা যায়, আমি নিশ্চিত খুব বেশী কেউ নেয়নি, যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে অসম্ভব রূপবতী রূপাও নিশ্চয় বেশী কেউ থাকবে না!
বাইরে দারুণ বাতাস। গা কেঁপে কেঁপে ওঠা ঠান্ডা। ভীষণ উজ্জ্বল চাঁদটা ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে। হুমায়ূনপ্রেমী সেই রূপবতী রাজকন্যাকে খুঁজে বের করার ইচ্ছাকে বইয়ের পাতায় রেখে দিলাম। ভয়ংকর সুন্দর সবকিছুর মুখোমুখি সবসময় হতে নেই। প্রিয় কিছু ইচ্ছা নিজের মধ্যে পুষে রাখতে হয়…একান্তে…
#কৃষ্ণপক্ষ #হুমায়ুন_আহমেদ #ShamimAJitu2017 #স্মৃতিকথা
অনেক ধন্যবাদ শামীম ভাই আপনার লেখার জন্য. সাধারণ অনুভূতিকে অসাধারণ করে ফুটিয়ে তোলার অদ্ভুত এক দক্ষতা আপনার. আশা করবো মাঝে মাঝে পরবাসীব্লগের পাঠকদের মুগ্ধ করে রাখার বিষয় নিয়ে উপস্হিত হবেন. ভালো থাকুন.
হাসান ভাই, মানুষ হিসেবে আপনার অবস্থান আমার কাছে অনেক উপরে। আপনার উৎসাহেই এখানে লেখা। লিখব আশা করি 🙂
” খুব ইচ্ছে করছে এই বইয়ের লাইনগুলি যে দাগ দিয়ে রেখেছে তার সাথে গল্প করতে। এখন তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। এক মাগ কফি হাতে ডাউনটাউনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে গল্পও করা যেত। প্রিয় ঔপন্যাসিককে নিয়ে টুকটাক গল্প; চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি নিয়ে হালকা আলাপ, কুশল বিনিময়।”
শামীম আহমেদ ভাই, হুমায়ুন আহমেদের কৃষ্ণপক্ষের ওই নিদৃষ্ট কপিটি ছাড়াও অনেক কপিতে অনেকেই দাগ কেটে রেখেছে, আর সে কারণেই তো কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ। আমি তো আপনার লেখাতেই কিছু ভার্চুয়াল দাগ কেটে ফেললাম। এইতো কিছুক্ষন আপনার সাথে সাথে হাটলাম, আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে, তবে কফি পান করতে করতে নয়, আনারস খেতে খেতে। আমি ওই বিশেষ বইটিতে দাগ কাটিনি ভাই, তবে বইয়ে দাগ কাটার অভ্যাস আমারও আছে, হয়তোবা মিলে যাবে কোথাও।
আপনি যে ভাল একজন পাঠক তা আপনার এই ছোট্ট লেখাটাই থেকে বোঝা যায়। আপনি লিখতে থাকুন, বাস্তবে না হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার লেখা পড়বো ততক্ষন পর্যন্ত আপনার সাথে সাথেই থাকবো।
ভালো লেগেছে ভাইয়া।
অনেক ধন্যবাদ।
মুকুল ভাই, অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনার কেটে দেয়া দাগগুলো রাস্তার দুপাশের দিকনির্দেশক হিসেবে মেনে নিলাম। এই অচেনা ভালোবাসায় এগিয়ে চলুউক আমাদের সবার একসাথে পথচলা।