স্বপ্নটা আরেকটু বড় দেখবে তেমনই আশা ছিলো রজবের। না, বড়ো মানে দীর্ঘ নয়, শুধু আরেকটু জমজমাট, আরেকটু সম্পন্ন, আরেকটু…
দিবা স্বপ্ন তো নয়, ঘুমের ঘোরে—
সুতরাং আরেকটু বেশী সুখকর হলে সমস্যা কি হতো?
যেমন—
পারু আর তাদের চার বছরের ছেলেটাকে নিয়ে তারা ফ্যান্টাসি পার্কে গেছে। ছেলের হাতে রং বেরংয়ের বেলুন, সবাই তারা নাগর দোলায় চড়ে একেবারে উপরে উঠে গিয়ে নীচের মাটি দেখছে! পারু আর ছেলে একটু শিহরিত হয়ে ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে দুপাশ থেকে। আহ্—কি অনুভূতি!
তারপর—
রিক্সায় করে রাজকীয় ভাবে বাড়ী ফেরার পথে ওদের হাতে থাকবে পোলার আইসক্রিমের কাপ। শীত, রোদ, ঝড়, বৃষ্টি সবকিছুকে উপেক্ষা করে, যে রাস্তাটায় ও ঝালমুড়ি বিক্রি করে প্রতিদিন, তাকে ডেকে বলবে–
এই যে—
“দ্যাখছো আইজ আমার পা দুইখান আর তোমার শক্ত বুকের উপর দিয়া হাডে নাই!”
কিন্তু—
কোনভাবেই স্বপ্নটাকে সে ঐ পর্যন্ত নিতে পারলো না!
অথচ—
কোন এক বিশ্ব ডাকাত হয়তো একই সময়ে স্বপ্ন দেখছে—
‘আস্ত পৃথিবীটা শেয়ার বাজারে উঠে গেছে এবং গোটা পৃথিবীর এক শতাংশ শেয়ার সে কিনে নিয়েছে!’
আর সে কি-না দেখলো—
‘কারওয়ান বাজারের সিগনাল বাতির ওখানে আঁৎকা গাড়ীতে করে এসে এক সাহেব তার সবটা ঝালমুড়ি একবারে কিনে নিলো! আর তাতেই সে ভীষণ খুশী! খুশীর সেই ভাবটা মুখে ধরে ঝুপড়িতে ফিরতেই দেখে পারুলীর চেহারায় বৈশাখী মেঘের ঘনঘটা! কারণ সে ভেবেছে সবটা মুড়ি না বেচেই রজব ফিরে এসেছে?’
কাল রাতেই সে বলেছে—
“ঘরে আর এককোষ চাউল ও নাই!”
রজবের প্রায়শঃই মনে হয়,
এই “নাই” শব্দটা শুধুমাত্র তাদের জীবনের সাথে সেঁটে থাকার জন্যেই জন্ম নিয়েছে!
পারুলী কাল আরও বলছিলো—
“অহন ও ঘুমের মধ্যেও নাহি হোনে জুম্মন কইতাছে—
মা ক্ষিদা পাইছে খাওন দেও—
মা—, ওমা কতা কওনা ক্যান? খিদা লাগছে খাইতে দাও! ভর দুপুরে চিলের ডাহের মতো ঘুমের মধ্যেই তার বুকটারে ফালা কইরা দিয়া যায় খিদার লাইগা জুম্মনের এই কান্দন!”
দিনভর ছেলে জুম্মনের এই আবদার শুনতে শুনতে পারুলীর ভেতরটা খাঁক হয়ে যায়। জুম্মন তার কোলের মধ্যে দলাই-মোচরাই করতে করতে একই আবদার অনর্গল করে যায় আর সে তখন ভাষাহীন হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পারুলীর বিশ্বাস ওখানে তার ঈশ্বর থাকেন। বুড়ো ঈশ্বরের চোখে হয়তো ছানি পড়ে গেছে! তিনি তাই–
“পারুলীদের কখনো দেখতে পান না,
পৃথিবীর মানুষের কোন কষ্ট কখনো দেখতে পান না!”
রজবের মতো পারুলীর চোখেও এখন আর কোন সুখের স্বপ্ন ধরা দেয় না!
তার স্বপ্ন ও এখন ঐ শূণ্য হাঁড়ি অব্দি গিয়ে আটকে যায়!
রজব তাই বলে—
“পারুলী– আমরা যে অহন স্বপ্নেও শিকলে বান্দা পইরা থাহি, তাই আমাগোর স্বপ্ন আর বেশীদূর যাইবার পারে নারে–!”
## দ্যাখছো (দেখেছ), আইজ (আজ), হাডে (হাঁটে), নাহি (নাকি), হোনে (শোনে), কতা (কথা), খিদা (ক্ষুধা), ডাহের (ডাকের), অহন (এখন), বান্দা (বাঁধা), পইরা (পরে), থাহি (থাকি)।