রাতে ডিনারের পর সবাই ড্রয়িং রুমে টেলিভিশনের সামনে বসেছে। হাসু সবার জন্য চা দিয়ে ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে তার রোজকার কাজ শেষ করে খেয়ে এসে সবার সঙ্গে বসে টেলিভশন দেখছে। দিনা রেবেকার কাছে গিয়ে বলে দাদু তুমি কেমন আছো?
আমি ভালো আছি । রেনু বলে দাদুকে একটু আদর করে দাও। সে একজনকে আদর করবে না, রহমান সাহেবকে ও আদর করে সাকিলার কাছে গিয়ে বলে আমি তোমার টেবিলে বসে ড্রয়িং করবো। সাকিলা উঠে গিয়ে তার টেবিল পরিষ্কার করে বলে তোমার ব্যাগ নিয়ে এসে নিজের মন থেকে ড্রয়িং করো। সে নিজের মন থেকে কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ত। রেনু বলে দিনা নিজ থেকে-ই কাজ করে। ওকে কিছু বলতে হয় না। মজিদ রেবেকার কাছে বসে বলে আম্মু তুমি চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যাবে। রেবেকা বলে সবাই আমাকে সান্তনা দেয়। আমি কি ভালো হবো?
কেন হবে না আম্মু, তোমার সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে। তুমি মনে সাহস রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাও । তোর আব্বু একটু কিছু হলেই আজকাল পীর সাহেবের নিকট গিয়ে দোআ কালাম নিয়ে আসে । কালকে আমার জন্য পানি পড়া নিয়ে এসেছে এবং বলে তুমি পানিতে মিশিয়ে খাবে । সাকিলা ঘুমে দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদে ও চিৎকার করে । ওর জন্য গিয়ে তদবির করিয়েছে । আজকাল ওর রাতের ঘুম ভালোই হয় । তবে জানিনা ওটা পীর সাহেবের তদবিরের জোরে কি ?
মজিদ বলে আম্মু এ সব ব্যাপার নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। চট্টগ্রাম ১২ আউলিয়ার জায়গা, লোকজন সব সময় দরগায় ভিড় জমায় । জানিনা কে কি পায়, তবে এটা একটা ব্যাবসাও ।
পরদিন সকালে মজিদ ও রহমান সাহেব রেবেকাকে নিয়ে শাহবাগ পোস্ট গ্রাজুয়েট হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে যান । ডাক্তার মনোয়ারা ওই হাসপাতালের একজন প্রফেসর যার লিখা চিঠি ও রিপোর্ট গুলি দেখে রেবেকাকে ভর্তি করিয়ে নিয়ে কেবিনের জন্য ওয়েটিং লিস্টে রাখে । তাকে অস্থায়ী একটা বেড দিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে চিকিৎসা শুরু করে, ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করেছে রোগীর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে এবং কেমোথেরাপি অত্যাবশ্যক।
মজিদ চেষ্টা করে একটা কেবিন নিয়েছে এবং রেবেকাকে কেবিনে স্থানান্তরিত করেছে । মজিদ সমস্ত কাগজ পত্র নিয়ে ওর অফিস থেকে অনুমোদন করেছে, রেবেকার চিকিৎসা খরচ অফিস পরিশোধ করবে। বিকেলে সাকিলা কাজ থেকে বাসায় এসে কিছু খাওয়া নিয়ে রেবেকাকে দেখতে এসেছে ।
আবিদ কাজ থেকে বের হয়ে হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখে রেবেকা কেমন আছে। সে কেবিনের ভিতরে না গিয়ে বাহির থেকে দেখে সাকিলা রুমের সামনে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেছে এবং কথা শেষ করে ক্যাবিনের ভিতরে চলে যায় । আবিদ কেবিনের পার্শে দাঁড়িয়ে ডাকে, সাকিলা, সাকিলা ! রেবেকা বলে কে তোকে ডাকে?
সে বলে আম্মু আবিদ এসেছে তোমাকে দেখতে। ওকে আসতে বল,দেখে যাক। সাকিলা বের হয়ে বলে আম্মুকে দেখতে এসেছেন?
হ্যাঁ, আসেন ভিতরে। ভিতরে এসে সালাম দিয়ে বলে আন্টি আপনার শরীর কেমন?
এইতো কাল থেকে কিমো দেয়া শুরু করবে। আবিদ একটা পেঁপে, কিছু কমলা ও আঙ্গুর নিয়ে টেবিলের উপর রেখেছে । রেবেকা বলে তুমি এত জিনিস কেন এনেছো?
আন্টি আপনি খাবেন। আমি এতগুলি খেতে পারবো না,তুমি কিছু নিয়ে যাও। না, আন্টি আপনার জন্য এনেছি, আস্তে আস্তে খাইবেন। পিছনে মজিদ, রেনু ও দিনা এসেছে। মজিদ আবিদকে দেখে বলে তুমি কেমন আছো? ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?
আমরা ভালো আছি। মজিদ কয়েক মিনিট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আবিদের সঙ্গে আলাপ করে বলে চলো নিচে গিয়ে চা খাবো। ওরা নিচে গিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে দুই জনে বসে চা খাচ্ছে । আবিদ বলে আপনি চিটাগাং থেকে কবে এসেছেন?
আমরা গত রাত এসেছি । ডাক্তার কি বলে, আন্টির কি অবস্থা?
কাল থেকে কিমো দেয়া শুরু হবে । আবিদ বলে কত দিন ঢাকা থাকবেন ?
এক সপ্তাহের ছুটি এনেছি, হয়তো রেনুকে কয়েক দিনের জন্য রেখে যাবো । আবিদ চলে গেলে মজিদ উপরে এসে বলে আমি ডাক্তারকে কিছু জিজ্ঞেস করবো?
রেবেকা বলে কিছুই বলার দরকার নেই, সাকিলা বলে আমি রাতে থাকবো, তোমরা চলে যাও । রেবেকা বলে এখানে ২৪ ঘন্টা নার্স থাকে, কারো থাকার দরকার নেই । মজিদ বলে আব্বু রাতে থাকবে বলে জানিয়েছে । সাকিলা বলে না, আব্বু রাতে না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে পড়বে । মজিদ বলে আমি যেহেতু এক সপ্তাহ ঢাকা আছি,রাতে থাকবো আম্মুর কাছে এবং ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করবো । কাল সকালে রেনু এসে থাকবে সারা দিন, আমি বাসায় গিয়ে ঘুমাইবো । সাকিলা তুমি রেনু ও দিনাকে নিয়ে বাসায় চলে যাও, রাতে ঘুমাবে দিনের বেলা কাজ আছে । মাগরিবের নামাজ পড়ে রহমান সাহেব রেবেকা ও মজিদের জন্য রাতের খাওয়া নিয়ে এসে কিছুক্ষন থেকে বলে তোমার ঘুমের অসুবিধা হলে আমি থাকবো । মজিদ বলে আব্বু আমি আম্মুর কাছে থাকবো, তুমি চলে যাও । তুমি সকালে আসবে,কাল আম্মুকে কিমো দেবে বলে জানিয়েছে । ঠিক আছে, আমি ফজর নামাজ পড়ে চলে আসবো । না, তুমি সকালে ব্রেকফাস্ট করে আসবে, আমার একটু দেরি হলে ও কোনো অসুবিধা হবে না ।
মজিদ রাতে রেবেকার কাছে বসে বলে আম্মু তুমি ঘুমাও । ডাক্তার রাউন্ডে এসে একবার দেখে গেছে রেবেকা ঘুমাচ্ছে । ও মাঝ রাতে একবার বাহিরে গিয়ে চা খেয়েছে এবং উঁকি মেরে দেখে ডাক্তার বসে ঝিমুচ্ছে । ডাক্তারের নিকট গিয়ে বলে কাল সকালে কটার দিকে কিমো দেবে?
সকাল ৮-৯ টার দিকে হয়তো দেবে । সে রাতে রেবেকার কাছে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে । মজিদের মনে পড়ে ইউনিভার্সিটি জীবনে অনেক সময় পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তো । এটা তার পুরানো অভ্যাস, সে এ ভাবে ঘুমাতে অসুবিধা মনে করে না । রেবেকা মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখে মজিদ টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, তুমি বাসায় চলে যাও, এ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে । আম্মু, তুমি আমার জন্য চিন্তা করবে না । এটা আমার আনন্দ তোমার কাছে থাকতে পারা ।
ভোর ৫টায় হাসু ঘুম থেকে উঠে রুটি, ভাজি ও চা করে টেবিলে দিয়ে বলে দাদা আপনি খেয়ে হাসপাতালে যান এবং দাদির জন্য টিফিন বক্সে খাওয়া দিয়েছি । রহমান সাহেব খেয়ে একটা রিক্সা নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে বলে মজিদ তুমি বাসায় যাও আমি আছি । মজিদ বলে ঠিক আছে । মজিদ ঘরে এসে সকালের নাস্তা করে ঘুমাতে যাবে, সাকিলা জিজ্ঞেস করে আম্মুর কি অবস্থা?
আম্মুর ঘুম হয়েছে এবং ডাক্তার এখনও ওয়ার্ডে আসে নি । আমি কি হাসপাতালে যাবো?
না, তোমার যাওয়ার দরকার নেই বরং স্কুলে যাও । সবাই একত্রে ডিউটি করে রোগী হওয়ার প্রয়োজন নেই ।
দিনের ৯টা ডাক্তার প্রথম কিমো দিয়েছে এবং সে থেকেই রেবেকার বমি বমি ভাব ও অস্বস্থি বোধ হচ্ছে । রহমান সাহেব ওর অবস্থা অবলোকন করে কাছেই বসে বার বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । দুপুরে রেনু দিনাকে নিয়ে এসে বলে বাবা আপনি বাসায় গিয়ে খেয়ে রেস্টে থাকেন ।আমি মজিদ না আসা পয্যন্ত থাকবো । দিনা বলে আমি দাদুর কাছে থাকবো । রেনু বলে তুমি এখানে লম্বা সময় থাকতে পারবে না । তুমি বরং দাদার সঙ্গে বাসায় চলে যাও এই বলে ওকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নার্সের সঙ্গে আলাপ করে কোনো কিছু প্রয়োজন আছে কি না । নার্স বলে কেবলই ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে । রেবেকার অবস্থা আজ অন্য রকম,সে ঘন ঘন বাথরুমে যায় কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য যে জন্য কষ্ট হচ্ছে । রেনু গিয়ে ডাক্তারকে বললে ওরা একটা মেডিসিন দেয়াতে একটু স্বস্তি পাচ্ছে ।
সাকিলা ক্লাস শেষ করে সরাসরি হাসপাতালে এসে দেখে রেবেকা একটু ঘুমাচ্ছে ।
রেনুকে জিজ্ঞেস করে আম্মুর কি অবস্থা?
রেনু বলে একটা ঔষুধ দেয়াতে এখন একটু ঘুমুচ্ছে । সাকিলা বলে তুমি বাসায় যাও আমি সন্ধ্যা পয্যন্ত আম্মুর কাছে থাকবো । তুমি সারা দিন ক্লাস নিয়ে এসেছো, বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও । আসতে হয় মজিদের সঙ্গে আসবে এবং দুই জনে একত্রে চলে যাবো । সে বলে না,আমি যাবো না, আমার বেশি খারাপ লাগে না , দুই জনে একত্রে যাবো । তুমি বাসায় একটা টেলিফোন করে দাও, নতুবা বাবা তোমাকে না দেখে দুঃশ্চিন্তা করবে । সাকিলা নিচে টেলিফোন করতে গিয়ে দেখে আবিদ এসে গেটে দাঁড়িয়ে আছে । আবিদ বলে আন্টির অবস্থা কেমন?
সাকিলা বলে আম্মু ঘুমাচ্ছে, রেনু উপরে আছে । আমি একটা টেলিফোন করবো নিচে অফিস থেকে । সাকিলা টেলিফোন করে বের হলে আবিদ বলে চলো তোমাকে চা খাওয়াবো । সাকিলা বলে আমি এখন চা খাবো না । আপনি কি উপরে যেতে চান?
না, খবর নেয়ার জন্য আসলাম । আমি বাসায় চলে যাবো । আবিদকে বিদায় দিয়ে সাকিলা উপরে এসে দেখে রেবেকা উঠে বসে আছে । আম্মু তোমার কেমন লাগে ?
রেবেকা বলে কেমন লাগে বুঝি না । তুমি কিছু খাবে?
না, কিছু খেতে ইচ্ছে করে না । সকাল থেকে আমার দুইবার বমি হয়েছে । সাকিলা বলে দেখি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে । রেনু বলে ডাক্তার এখন ওয়ার্ডে আসবে, তখনই জানা যাবে ।
সাকিলা বলে নিচে আবিদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল । ও উপরে আসতে চেয়ে ছিল, আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করে আন্টি কেমন আছেন ?
আমি বললাম আম্মু এখন ঘুমাচ্ছে ।
সে জন্য আর উপরে আসে নি এবং আমাকে চা খাওয়াইতে চেয়েছিলো ।
আমি বললাম ,এখন চা খাবো না ।
বলেছে কাল আসবে । রেনু হাঁসে এবং বলে আবিদ তোমার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়ে গিয়েছে । ও কেন ঘুরে আমার পিছিনে ?
ও তোমাকে ভালোবাসে । সাকিলা হেঁসে বলে আমি ওকে আশা দেই নি । তুমি আশা না দিলে কি হবে, সে তো আশা করে বসে আছে । তুমি আমার কথা শুনো,ওকে আর ঘুরাইও না । বিয়ে করে নাও, আম্মু, আব্বু এবং আমরা সবাই খুশি হবো ।
সাকিলা হেঁসে বলে সে দেখা যাক,আগে তো আম্মুকে সারিয়ে তুলি । সন্ধ্যার দিকে মজিদ এসে খোঁজ খবর নেয়, আম্মু তোমার শরীর কেমন?
রেবেকা বলে সারা দিন-ই বমি বমি লেগেছে এবং কিছু খাইতে ইচ্ছে করে না । হাসপাতালের খাওয়া ভালো লাগবে না, আমি বাসা থেকে খাওয়া এনেছি তুমি খেয়ে দেখো । কি এনেছো?
মাছ , ভাজি,ডাল সজনে ডাটা করা হয়েছে । মজিদ বলে লোক বেশি হয়ে গেছে , তোমরা বরং চলে যাও, আমি আম্মুর কাছে থেকে খাওয়াবো ।
সাকিলা ও রেনু বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েছে । পেছনে রেনুর আম্মু সাকিনা ও আব্বু আশরাফ এসে ঢুকেছে ,ওরা এসে ঢুকতেই রেনু বলে তোমরা কিছুক্ষন থাকো আমরা বাহিরে যাই । এখানে লোক বেশি হলে নার্স রাগ করে । ওরা ৫-১০ মিনিট বাহিরে থেকে মজিদকে উপরে পাঠিয়ে দিয়ে জানায় যে রেনু ও সাকিলা নিচে অপেক্ষা করছে । মজিদ উপরে এসে বলে আপনারা যেতে পারেন নিচে ওরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে । সাকিনা বলে, তুমি আমাদের জন্য ও সময়সূচি করবে যাতে আমরা ও মাঝে মধ্যে থাকতে পারি । মজিদ বলে, সে দেখা যাবে আপাততঃ আপনারা যান । ওরা গাড়ি নিয়ে এসেছে । সাকিলা,রেনু ও দিনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাবে । দিনা বলে নানু তোমরা বাসায় এস । ওরা গাড়ি থেকে নেমে ৫-১০ মিনিট বসে চলে যায় ।
রাত রেবেকা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, মজিদ হাতে ধরে বাথরুমে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এনে খাওয়া দিয়েছে । আম্মু তুমি ভাত খেয়ে চা খাও, আমি বাসা থেকে চা বানিয়ে এনেছি । রেবেকা মজিদকে বলে তুমি রাত জেগে এখানে কষ্ট করার প্রয়োজন নেই । এখানে ২৪ ঘন্টা নার্স থাকে,বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো । ও বলে আম্মু আমার কোনো অসুবিধা হয় না । তোমার সঙ্গে একটু বসে বসে কথা ও বলতে পারি ।
সকালে রহমান সাহেব বাসা থেকে ব্রেকফাস্ট করে রেবেকার জন্য খাওয়া নিয়ে এসে বলে মজিদ তুমি আর ডিউটি করবে না । তুমি বাকি কয়েকদিন বাসায় থাকবে, তোমার ঢাকা কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে যা রাতে ডিউটি করে করতে পারো না, সবাই অসুস্থ হওয়ার দরকার নেই । মজিদ কিছু না বলে বাসায় চলে যায় ।
খবর পেয়ে আবিদের আম্মু ও আব্বু হাসপাতালে এসে দেখে রহমান সাহেব কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । ওরা সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকে কিছু সময় রেবেকার সঙ্গে আলাপ করে চলে যায় । রহমান সাহেব ওদের পিছনে পিছনে হাসপাতালের গেট পয্যন্ত গিয়ে বিদায় দেয় ।
পুরা সপ্তাহ রেবেকাকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে । ডাক্তার আজমল ও ডাক্তার মনোয়ারা ডিপার্টমেন্টের ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য রহমান সাহেবকে বলেছে । রেবেকাকে বাসায় পাঠানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে । বাসায় রেবেকা আসার পর মজিদ বলে আম্মু আমি ঢাকা বদলি হয়ে আসার জন্য চেষ্টা করতেছি । রেবেকা বলে তোমরা তোমাদের ব্যাক্তিগত কাজ নিয়ে থাকো, আমার জন্য হুড়াহুড়ি করে ঢাকা আসার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না । তোমরা ঢাকা আসলে কি আমার কোনো আলাদা ট্রিটমেন্ট হবে?
মজিদ বলে ট্রিটমেন্ট না হলে ও কাছে থাকলে দুঃশ্চিন্তা মুক্ত থাকবো । দেখি যদি বদলি হতে পারি ভালো, আর না হতে পারলে চেষ্টা তো করে দেখলাম । রহমান সাহেব বলেন আমি অবসর নিয়ে ঘরে আছি, তা ছাড়া সাকিলা ও আছে, তোমাদের এত সব চিন্তা করার কিছুই নেই । তোমরা তোমাদের কাজ সেরে চলে যাও ।
রাত্রে ডাক্তার আজমল চেম্বার থেকে বাসায় ফেরার পথে গেটে নক করার সঙ্গে সঙ্গে সাকিলা ও দিনা এসে সালাম দিয়ে বলে ভিতরে আসেন । দিনাকে দেখে হেঁসে হেঁসে বলে ,’ দিনা তুমি কেমন আছো? ‘
দাদা আমি ভালো, তুমি কেমন?
আমিও ভালো আছি । চলো তোমার দাদুকে দেখে আসি এই বলে ভিতরে এসে মজিদ ও রেনুকে দেখে বলে তোমরা কবে ফেরত যাবে?
আমরা আরো দুই দিন থাকবো । তোমার আম্মু কোথায়?
আম্মু বেড রুমে আছেন , কি খবর ভাবি তোমার শরীর কেমন ?
ভাই, ক্লান্ত ও ঘুম ঘুম লাগে, হাসপাতালে ভালো ঘুম হয় নি । বাসায় নিরিবিলি ঘুমিয়ে থাকো । একটু দেখে বলে আমি যাই, আবার এসে দেখে যাবো । মজিদকে বলে তুমি দুশ্চিন্তা করবে না, আমরা এখানে সবাই আছি । আঙ্কেল ওটাই ভরসা, আপনি একটু দেখবেন । রেনু, মজিদ ও দিনা এগিয়ে দিয়ে গেট বন্ধ করে ঘরে চলে আসে ।
আজিজ গত কাল টেলিফোন করেছে এবং আজ হয়তো রাতে টেলিফোন করবে । সবাই ডাইনিং টেবিলে বসেছে, হাসু মাছ, লাল শাক ভাজি ও ডাল করেছে । রেবেকাকে একটু নরম ভাত রান্না করে দিয়েছে এবং সাকিলা গিয়ে বলে আম্মু একটু কিছু না খেলে তুমি দুর্বল হয়ে পড়বে । সে আস্তে আস্তে উঠে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে একটু খেয়ে বলে আমার খাবার ইচ্ছে হয় না । রহমান সাহেব বলেন না ইচ্ছে হলে একটু বসে থাকো সবার সঙ্গে, যখন ক্ষিদে লাগবে খাবে । তাছাড়া আজিজ এই সময় টেলিফোন করে খোঁজ নেয়, একটু বস যদি টেলিফোন করে, কথা বলবে । ১০-১৫ মিনিট বসার পর রেবেকা বলে আমার শরীর ভালো লাগে না । সাকিলা বলে ঠিক আছে চলো তোমাকে বেডে দিয়ে আসি । আজিজ টেলিফোন করলে আমাকে দিস,আমি কথা বলবো । ঠিক আছে আম্মু ।
রাত ১০ টার দিকে আজিজ শিকাগো থেকে টেলিফোন করেছে এবং সাকিলা টেলিফোন ধরে বলে ভাইয়া তুমি কেমন আছো?
আমি ভালো আছি । আম্মু কি বাসায় এসেছে?
হ্যাঁ, আসছে. কেমন আছে, কথা বলতে পারবো কি?
তুমি ধরে রাখো, আমি আম্মুকে টেলিফোন দিচ্ছি । রেবেকা টেলিফোন উঠিয়ে কান্না জড়ানো স্বরে বলে তুই কেমন আছিস?
আম্মু আমি ভালো আছি । তুমি কি কাঁদতেছো?
না, আমি কেন কান্না করবো?
তোর ওখানে এখন নিশ্চয়ই দিন । হ্যাঁ , আম্মু এখানে দিনের ১০টা বাজে । তুমি কি করো?
আমি বসে সবার সঙ্গে টেলিভশন দেখে এখন বেডে এসেছি । মজিদ,রেনু ও দিনা চিটাগাং থেকে এসেছে । আমি ঔষুধ নিতেছি । আমার জন্য চিন্তা করবি না । তুই মজিদের সঙ্গে কথা বল, আমি রেখে দিলাম, আচ্ছা দাও ।
টেলিফোন ধরেই মজিদ বলে তুই কেমন আছিস?
আমি ভালো আছি, আম্মুর জন্য চিন্তা করি ।
আম্মু বাসায় এসেছে এবং কিমো থেরাপি দেয়া শুরু করেছে, ডাক্তার বলে ভালো হয়ে যাবে। ১০ মিনিটের মতো কথা বলার পর আজিজ টেলিফোন রেখে দেয় । সাকিলা বলে আমরা সবাই এখানে আর আজিজ আমেরিকা ও নিশ্চয় আম্মুকে অনেক মিস করে । লং ডিসটেন্স কল করলে অনেক ডলার বিল আসে । এসিস্টেন্টশিপের সীমিত পয়সা দিয়ে কোনো রকমে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে থাকে ও পড়া শুনা করে । রেনু বলে আজিজ আমাকে বলেছে সপ্তাহে ১৫ ঘন্টা একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে । ৫ ঘন্টা শিফটে তিন দিন কাজ করে । তোমরা বেশি বললে ও পড়া শুনা না করে দেশে চলে আসবে । ওকে সাহস দেবে যেন পড়াশুনাটা শেষ করতে পারে । ও এখানে এসেই কি করবে, আমরা এখানে তোমার দেখা শুনা করছি । তাছাড়া আব্বু বাসায় থাকে এবং সব কিছু ঠিক ভাবে করতে পারে ।
পর দিন সকালে মজিদ রেনু ও দিনা বাহিরে কিছু কেনা কাটা করার জন্য যাওয়ার পূর্বে রহমত সাহেবকে বলে আব্বু তুমি আজ বাজারে যাবে না । আমরা বাহিরে যাইতেছি এবং আসার সময় বাজার করে আসবো । রেনু কাঁচা বাজার ও ঘরের জিনিস পত্র কেনার লিস্ট তৈরী করে নিয়েছে । সাকিলা সকালে ব্রেকফাস্ট করে স্কুলে গিয়ে দুপুরে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এসেছে এবং দুপুরে সকলে একত্রে লাঞ্চ করেছে । রেবেকার শরীর আজ একটু সুস্থের দিকে এবং সে বিকেলে বাগানে গিয়ে বসে আছে ।
সীমা অনেক দিন এদিকে আসে নি । বিকেলে রেবেকাকে দেখতে এসে গেটে দাঁড়াতেই সাকিলা গিয়ে সালাম দিয়ে বলে আন্টি আসেন, আম্মু বাহিরেই বসা । সেখানেই বসে রেবেকার সঙ্গে কথা বলে । সীমা বলে মাসুদ তোমাকে দেখার জন্য আসবে , সবার সঙ্গে চা খেয়ে বলে আমি আবার আসবো ।
ক্রমশ :