মাঘ মাস। কনকনে ঠান্ডা। হাঁড় কাঁপানো শীত। অথচ ঘেমে চুপসে যাচ্ছে লাবণী। রাত পোহাতেই সকাল থেকে উদাস মনে বসেছিল। সময় যতো বাড়ছে, হৃদষ্পন্দনের গতীও ততো বাড়ছে। বিকেল হতেই জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালায় মাথাটা ঠেকান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, দূর-নীলিমার প্রান্তরে উড়ে যাওয়া একঝাঁক মুক্ত বিহঙ্গের দিকে। আর জলছবির মতো মনঃচক্ষে ভেসে ওঠে, সুদীর্ঘ সাতবছর পর অপ্রত্যাশিত হঠাৎ দিব্যেন্দুর দর্শণ, ওর আবির্ভাব, উপস্থিতি । দু’দিন আগেও যা কল্পনা করতে পারেনি। ইতিমধ্যে গাড়ির শব্দে চমকে ওঠে। গলা টেনে দ্যাখে, একজন বয়োঃজ্যাষ্ঠ ব্যক্তি সহ একঝাঁক যুবকের দল, একে একে গাড়ি থেকে নামছে। তন্মধ্যে একজন উজ্জ্বল সুঠাম সুদর্শণ তরুণ যুবকের পরিহিত চটকদারি পোষাষ-আষাকে একটু ব্যতিক্রম মনে হোলো। সে একেবারে ফিল্মি হিরোর মতো জিন্সের প্যান্ট-শার্ট, চোখে দামী ফ্রেমের সানগøাস, চরণে চমকপ্রদ হাইহিল শু-এর বাহার চোখে তাক লেগে যাওয়ার মতো। অন্যদের চাইতে একটু স্প্যাশালই লাগছে ওকে। একেবারে ভি.আই.পি-র মতো নামছে গাড়ি থেকে। স্বয়ং পাত্রই হবে নিশ্চয়ই। স্বগতোক্তি করে ওঠে লাবণী।
ইত্যবসরে পিতা অমলেন্দু আগন্তক অতিথিবর্গকে স্বাগতম জানাতে দ্রুত এগিয়ে আসতেই সদর দরজার গোঁড়ায় থমকে দাঁড়ায়। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,-‘আরে দিব্যেন্দু, রবীণ, অজয় তোমরা? তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না দিব্যেন্দু! তোমরা এলে কোথা থেকে!’
একগাল হেসে অমলেন্দুর বিগ্ বস সত্যেন মিত্র বললেন,-‘অমল, ওইতো আমাদের শ্রীমান মুখপাত্র। তোমার হবু জামাতা। সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বলো তো! ভালো পাত্রের সন্ধান চেয়েছিলে, আজ সঙ্গেই নিয়ে এসেছি। অফিসে তোমার জুনিয়ার, এ্যাসিসটেণ্ট। ইউ নো হীম বেটার দ্যান মী। আই এ্যাম হানড্রেড পার্সেট সিওর, তুমি রিফিইজ করবে না। তাছাড়া দিব্যেন্দু আমার নেইভার। আমরা একই কন্ডোতে থাকি।’
এতক্ষণ পর সবিস্ময়ে অমলেন্দু বললেন,-‘এ্যাঁ! বলো কি, আমাদের দেব! হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! ভাবতেই পিচ্ছিনা। এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! যে কাজ আমি করতে পারিনি…….!’ একটু থেমে বললেন,-‘কিন্তু কাজটা কেমন হোলো বলো তো! কন্যার পিতা আমি, অথচ পাত্রটি কে, তাই-ই জানিনা। অন্তত আমায় একবার ইনফর্ম করতে পারতে!’
সত্যেন মিত্র বললেন,-‘এতো ফর্মালিটির কি আছে! অফিসে তুমিই ওর বস্। তোমার বিশ্ব’ এবং সজ্জন। তুমিই বেশী জানো ওকে। শুধু তাই নয়, ওকে তুমি ভালোবাসো,স্নেহ করো। আর সেই হিন্টটা পেয়েই তো..!’ বলতে বলতে সানন্দে হেসে ফেললেন সত্যেন মিত্র। সগৌরবে দৃঢ় আশ্বাস দিয়ে বললেন,-‘হিরের টুকরো ছেলে। একদম হান্ডেড পার্সেন্ট পিওর। আই এ্যম শির্ও, টরন্টো শহরে কোথাও খুঁজে পাবেনা। সো, শুভষ্য শীঘ্রম! ’
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে অমলেন্দু বললেন,-‘সবই তাঁর ইচ্ছা। কপালে লেখা থাকলে ঠেকাবার সাধ্য কার! এসো, এসো, তোমরা ভিতরে এসো, কথা হবে!‘
অন্দর মহলের দিকে নজর বুলিয়ে বললেন,-‘কই গো, শুনছো, মা’মণিকে নিয়ে এসো শিগগির। ওরা এসে গিয়েছে।’
ওদিকে গতিশীলতায় হৃদয়পটভূমি তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে লাবণীর। হৃদস্পন্দন আরো দ্রুত গতীতে চলতে থাকে। মনস্থির করতে পারেনা কি করবে, কিভাবে পাত্রপক্ষকে বিদায় করবে।
ততক্ষণে একে একে আগন্তক অতিথিবর্গের কুশল বিনিময়, দিব্যেন্দুর বাপ-ঠাকুরদার পরিচয়, মত বিনিময় সব শেষ। এবার লাবণীর পালা। মাতা রমলাদেবী দ্রুত এসে বললেন,-‘আয় খুকু, কিচেনরুমে চা-জল-খাবার ট্রে-তে সাজানো আছে। নিয়ে চল আমার সাথে!’
অগত্যা, ভারাক্রান্ত হয়ে মায়ের পিছু পিছু বৈঠকখানায় পা রাখতেই চমকে ওঠে লাবণী। থমকে দাঁড়ায়। বুক ধুক্ ধুক্ করে কেঁপে ওঠে। এ কি, দিব্যেন্দু এখানে! ও মাই গড্! ও এখানে এলো কোত্থেকে! চোখে একেবারে তাক লেগে যায়। নজর ফেরাতে পারেনা। আজ যেন নতুন করে দিব্যেন্দুর পুরুষোচিত চেহারা আর মিশ্রব্যক্তিত্বের মুগ্ধ আকর্ষণে দৃষ্টি ¯ি’র হয়ে যায়। পড়ে যায় বিস্ময়ের ঘোরে। চিনতে ভুল করছে না তো! বড় বড় চোখ পাকিয়ে দ্যাখে লাবণী। মনে মনে বলে, হ্যাঁ, দিব্যেন্দুই তো! চেনাই যাচ্ছেনা ওকে। কিন্তু কি আশ্চর্য্য, রায়চৌধুরী পরিবারে ওর আগমন ঘটলো কিকরে! এ তো আনবিলিভয়েবল! আনথিঙ্কেবল!’
চকিতে অব্যক্ত আনন্দ আর ভালোবাসার জোয়ারে হৃদয়ের দুকূল জুড়ে কানায় কানায় ভরে ওঠে। মেঘের আড়াল থেকে উদ্ভাসিত সূর্য্যরে উজ্জ্বল আলো মতো মুখখানা ওর চকিতে দ্বীপ্তিময় হয়ে ওঠে। ভিতরে ভিতরে পুলকে বিকশিত হয় ওর মন-প্রাণ, সারাশরীর। এক অদ্ভুদ শিহরণে দোলা দিয়ে ওঠে।
একেই বলে বরাত, সংযোগ। আবেগে অভিভূত লাবণী স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। চোখের পলক পড়ে না। জল-খাবারের ট্রে-টা টি-টেবিলে রেখে দ্রুত চলে যা”িছল। অমলেন্দু বললেন,-‘যাচ্ছিস কোথায় মা! আয়, বোস আমার পাশে। লজ্জা পাবার কি আছে। দিব্যেন্দু আমার ছেলের মতো। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে আছি। ও’ আমার এ্যাসিসটেন্ট। বড় ভালো ছেলে। ওর মতো..!’
কথা শেষ না হতেই একটা ফোন কল্ আসে। অমলেন্দু এক্সকিউজ মী বলে ফোনটা রিসিভ করতে দ্রæত পাশের রুমে চলে যায়। ইতিমধ্যে পাত্রীর মুখদর্শণে যেন আকাশ থেকে পড়ে দিব্যেন্দু। বিস্ময়ে এতোটাই অভিভূত হয়ে পড়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে শ্বাশত লজ্জায় নূয়ে পড়া লাবণীর রাঙা মুখমালার দিকে। রুদ্ধ হয়ে যায় ওর কণ্ঠস্বর। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে না তো! এ তো স্বপ্নেরও অতীত। অবিশ্বাস্যকর ঘটনা। বিধাতার লীলা বোঝা ভার।
ভিতরে ভিতরে হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে হৃদয় সমুদ্র তখন উথাল-পাথাল হয়ে যা”েছ দুজনের। কিš‘ তা কাউকে বুঝতে দিলো না। আগুš‘ক অতিথিগণও কেউ টের পেলো না। স্বপ্নের মতো মনে হয় লাবণীর। কিছুতেই বিশ্বাস হয়না। ভেবে কূল পায়না, এসব সম্ভব হোলো কেমন করে! ঘেমে অ¯ি’র। সারাশরীর ওর ঘর্মসিক্ত হয়ে ওঠে। ওর ঐ ব্যতিক্রম চেহারা লক্ষ্য করে অমলেন্দু বললেন,-‘হোয়াট হ্যাপেন্ড মামণি? আর ইউ ও.কে?’
লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে ফ্যালে লাবণী। জড়িয়ে ধরে মাতা রমলাদেবীকে। আকস্মিক অপ্রত্যাশিত একরাশ আনন্দ আর আবেগের সংমিশ্রণে মুক্তোর মতো অশ্রুকণায় চোখদু’টো ওর চিক্ চিক্ করে ওঠে। সাশ্রুনয়নে দিব্যেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,-‘নাথিং ড্যাড, আই এ্যাম এ্যাবসুলোটলি ও.কে।’
সত্যেন মিত্র বললেন,-‘ও.কে অমল, এভ্রিথিং ইস ফাইনাল। নাও উই আর গোইং আউট এক্সেপ্ট দিব্যেন্দু এ্যান্ড লাবণী। দে মাষ্ট নীড টু নো ইচ্ আদার।’
বৈঠকখানা ছেড়ে সবাই বেরিয়ে যেতেই কি যেন বলতে চাইছিল লাবণী। ইতিপূর্বে ওর হাতদুটো চেপে ধরে দিব্যেন্দু। সাবেগে বলল,-‘নো নীড টু সে এনিথিং বণী! আমি কর্মে বিশ্বাসী। আজ আর কি”ছু শুনতে চাই না।’
ওর কপালে একটা আলতো চুম্বন করে বলল,-‘উইল ইউ ম্যারী মী মাই লাভ? মাই সুইট হার্ট!’
সলজ্জে মুচকি হেসে ক্ষীণ মৃদুস্বরে দিব্যেন্দুর কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে লাবণী বলল,-‘ইয়েস। মী টু, আই লাভ ইউ!’
বলতেই ওকে সজোরে প্রেমালিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে দিব্যেন্দু।
সমাপ্ত
(যুথিকা বড়ূয়া: কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।)