পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে দিব্যেন্দুর জীবনে নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়। তখন ওর সতেরো বছর বয়স। হেসে খেলে আনন্দ করার বয়স। জীবন জোয়ারে ভেসে বেড়ানোর বয়স। কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বণায় অপরিণত বয়সে সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যের ভার বজ্রাঘাতের মতো এসে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিব্যেন্দুর ঘাঁড়ে। তাতে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়লেও কখনো ওর জীবন নদীর প্রবাহ থেমে থাকেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিতার শূন্যস্থানে সরাসরি শিক্ষকতা করার দায়িত্ব নিয়ে সংসার নামের তড়ীখানা ভাসিয়ে দেয় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। এর পাশাপাশি নিয়মিত নাইট কলেজ করে নিজের পড়াশোনাও অব্যাহত রাখে। একাগ্রহে প্রায় সাতবছর নিরলস সাধনায় নিমগ্ন থেকে শুধু ডিগ্রিই নয়, হাসিল করে নেয় নিজের সক্ষমতা, পূর্ণতা। যখন ওর একটানা সংসারের ঘানি টানতে টানতে নিরবসর, নিঃসঙ্গ, নিরু্ছাস, নিস্প্রেম ও নিরানন্দের জীবনে বিনা নোটিশে ধূমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়েই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ওর স্বপ্নপরী কিশোরী কন্যা লাবণী। যার কারণ অনুসন্ধানে মনের শক্তি যখন হারিয়ে গেল, ঠিক তখনিই ঘুরে গেল ওর ভাগ্যের চাকা। যা নিজেও কল্পনা করতে পারেনি। একেবারে মিরাকলের মতো প্রথম প্রয়াসেই আশাতীত সাফল্যের চরম স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যায়। কিš‘ দুর্ভাগ্য, ওর মাতা সুরমা দেবী তা দেখে যেতে পারেনি। একজন দক্ষ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এবং গ্রাফ ডিজাইনার দিব্যেন্দু স্বদেশ ছেড়ে সরাসরি টরন্টো শহরে পোষ্টিং হয়ে জীবনের রঙই বদলে যায় ওর। বদলে যায় প্রাত্যহিক জীবনের কর্মসূচী, জীবনধারা। তারপর পিছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি।
কিন্তু শত চেষ্টা করেও দিব্যেন্দু পারেনি ওর মনের রঙ বদলাতে। পারেনি জীবনকে নতুন করে সাজাতে। আর পারেনি বলেই অর্থ-ঐশ্বর্য্যে পরিপূর্ণ জীবনে প্রতিনিয়ত একটা শূন্যতা, অভাববোধ অনুভব করে। একমাত্র বোন জয়ন্তীকে সুপাত্রস্থ’ করে আজ একলা ঘরে খাঁ খাঁ করে ওর বুক।
অহেতুক টেনশনে সিগারেটের নেশাও ধরেছে। কিš‘ কেন? কিসের জন্য? কিসের অভাব ওর? চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করে আজ ওর শান্দার আলিশান বাড়ি. গাড়ি, অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্য, ফ্যাশানাবল ফার্ণিচার সব পরিপূর্ণ। অথচ সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ঔদাসিন্যতায় ওর দিন যায়, রাত পোহায়।
দিব্যেন্দু বরাবরই ধীরস্থির-গম্ভীর, শান্ত প্রকৃতির। ঢোল পিটিয়ে মনের ভাব কখনো প্রকাশ করেনা। প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলেনা। একটু চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে। যেমন বিদ্যান-বুদ্ধিমান, তেমনি অত্যন্ত ভদ্র-নম্র, মার্জিত পুরুষ। পেশায় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দেওয়া, রসিকতা করা, নেশাদ্রব্য সেবন করা, মেয়ে মানুষের গা-ঘেষা এসব ওর ধাতে নেই। কোনকালেও ছিল না। লোকে ব্যঙ্গ করে “বালক ব্রহ্মাচারী” বলে ক্ষ্যাপাতো। কেউ কেউ বলতো,-“কলিকালের বিদ্যাসাগর।”
আজও অতীত মোটেই পিছু ছাড়েনা দিব্যেন্দুর। ভুলতে চাইলেও কিছুতেই হৃদয় থেকে অপসারিত করতে পারেনা। ছায়ার মতো সারাক্ষণ ওকে অনুসরণ করে। পিছে পিছে ধাওয়া করে। সদ্য প্রাপ্ত উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন্ প্রতিষ্ঠিত জীবনে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা আর কোলাহলের পর একাকী নির্জন রাতে ফিরে চলে যায় অতীতের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের দুঃখ-দীনতার দিনগুলিতে। যখন অ¯ি’তিশীল হৃদয়পটভূমির প্রচন্ড ঝড়ে বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, কেইবা রাখে ওর সেখবর। জীবন যার কাছে দূরপাল্লর দৌড়। মাথার ওপর বিধাব মা আর বোনের গুরু দায়িত্বের বোঝা। যেখানে দুঃখ-দীনতা, অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। এমতবস্থায় জীবনকে উপভোগ করা তার ফুরসৎইবা কোথায়! কিন্তু ওর অবাধ্য মন ভ্রমরের মতো কখন যে সুরভীত ফুলের উপর গিয়ে বসে, তা নিজেও টের পায়নি। যেদিন কলেজে নবাগতা ষোড়শী কন্যা লাবণীর আগমনে মিরাকলের মতো ওর মন-মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। রোপণ করেছিল ভালোবাসার বীজ। দৃঢ়ভাবে বাসা বাঁধে, ইচ্ছা-আবেগ আর অনুভূতি। যার অপার মহিমায় চুম্বকের মতো হৃদয়াকর্ষণে দিব্যেন্দুর কল্পনা শক্তিকে প্রচন্ডভাবে উদ্দীপ্ত করে। সচেতন করে তোলে। যখন সুখের অণ্বেষণে গভীরভাবে কল্পনায় ডুবে গিয়ে জাগ্রত হয়, আবেগাপ্লুত অনুরাগের মধুর আবেশ। সে এক ব্যাখ্যাতীত অভিনব অনুভূতি। যখন রক্তের স্রোতের মতো শরীরের প্রতিটি অনু-পরমানুতে সঞ্চালিত হয়ে হৃদয়কে সজেত ও সজীব করে তোলে। সঞ্চার হয় প্রেম রসের। যেদিন অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের শখের মতো আচমকা একটা ঝটকা লেগেছিল, আবেগ-অনুভূতিহীন দিব্যেন্দুর দেহে, মনে। যেদিন হৃদয়ের কোণে ঘুমিয়ে থাকা ভালোলাগা আর ভালোবাসার ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতির তীব্র জাগরণে ওর অন্ধকার জীবনে দেখতে পেয়েছিল, একফালি উজ্জ্বল আলোর রেখা। যেদিন শরতের শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের প’রে মায়াবিণী স্বপ্নপরীর মতো রক্তে-মাংসের মানবীয় কন্যা লাবণীর উ”ছলতা, সজীবতা, চঞ্চলতা ও প্রাণবন্ত পদচারণায় মোহিত দিব্যেন্দুর নতুন করে জেগে ওঠেছিল বেঁচে থাকার সাধ। খুঁজে পেয়েছিল ক্রমাণ্বয়ে জীবন যুদ্ধে পথ চলার প্রেরণা শক্তি, মনের শক্তি। বেঁচে থাকার উপকরণ। যেদিন ওর ধূসর হৃদয়পটভূমিতে চির অ¤øান ও শান্ত স্নিগ্ধ-কোমনীয় এক উদ্বিগ্ন যৌবনা অনন্যা, লাবণ্যময়ী সুদর্শণা লাবণীকে প্রথম আবিস্কার করেছিল। আবিস্কার করেছিল পৃথিবী কেন এতো বেশী সুন্দর। কেন এতো প্রাণবন্ত ও আনন্দোৎ”ছলসমারোহে পরিপূর্ণ! সেদিন দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিল, পৃথিবীর সমগ্র নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই একে অপরের পরিপূরক, অনুপ্রেরণা শক্তি, শক্তির উৎস।
দিব্যেন্দু দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মনে-প্রাণে লাবণীকেই জীবন সঙ্গিনী করতে চেয়েছিল। স্ত্রীরূপে পেতে চেয়েছিল। চেয়েছিল ওর হৃদয়পদ্মে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে। যেদিন হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে জীবনে প্রথম অনুভব করেছিল লাবণীকে সত্যিই সে ভালোবেসে ফেলেছে।
কিন্তু বিধি বাম। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ ওর হৃদয়পটভূমির মহাঘূর্ণির প্রলয় মাতনে প্রচন্ড অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। পারেনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। পারেনি হৃদয়গহŸরে রোপণ করা ভালোবাসার বীজ ধারণ করতে। যা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেদিন তীরের মতো বিদ্ধ হয়ে ওর হৃদয়ের গভীরে একটা কঠিন আঘাত এসে লেগেছিল। যা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি। ভাবতে পারেনি, ওর একান্ত ভালোবাসার ফুল প্রস্ফূটিত হওয়ার আগেই অনাদরে ঝোরে যাবে।
এ কেমন বিধাতার দু’টি মানব-মানবীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে দেওয়ার নিষ্ঠুর প্রয়াস? মরীচিকার মতো মিছে মায়াজালে কেন নিজেকে ধরা দিয়েছিল দিব্যেন্দু? কেনইবা রামধনুর মতো হৃদয়াকাশে আর্বিভূত হয়ে ওর কাক্সিক্ষত স্বপ্নপরী লাবণী একেবারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সবটাই কি ওর ছলনা, অভিনয়! কিš‘ সত্যিই কি তাই ঘটেছিল!
হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে জর্জরিত দিব্যেন্দু আজ এতিমের মতো ওর নীরব ভালোবাসার যোগ-বিয়োগের কোনো উত্তরই খুঁজে পায়না। অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্যসম্পন্ন ধনী বড়লোক বাপের একমাত্র কন্যা লাবণীর অপ্রীতিকর-বিহেইভ মনকে ওর তিক্ত করে দিয়েছিল। ফলে শুধুমাত্র নারীজাতির সংস্পর্শই নয়, পৃথিবীর সকল মায়া-মোহ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল ওর অতীতকে। ভুলে গিয়েছিল ওর প্রাণপ্রতিমা লাবণীকেও। যেদিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নিজের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরের পৃথিবীতে। এগিয়ে গিয়েছিল নিজস্ব গতীতে। তারপর ওর ব্যক্তিগত জীবনে কত ঝড়-তুফান বয়ে গিয়েছে, কত উত্থান পতন, কত পরিবর্তন ঘটেছে। কিš‘ আদৌ কি লাবণীকে ভুলতে পেরেছে দিব্যেন্দু?
(চলবে)