তখন কি চরম বিপর্যয় দিব্যেন্দুর। অক্টোপাশের মতো অজানা বিভীষিকায় ওকে চারিধারে আঁকড়ে ধরে। অপর দিকে আচমকা জীবনে অনাকাঙ্খিত বিপদের সম্মুখীন হয়ে পঙ্গুত্বের গ্লানিতে শারিরীক ও মানসিকভাবে মালবিকা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তন্মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো সর্বস্বান্ত নিঃশ্ব হয়ে বিকৃতি চেহারা আর বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে নিথর নির্জীব প্রাণীর মতো সারাদিন উদাসীন্যতায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে। জীবনে আশা, আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস, ভরসা কিছুই আর নেই। নেই ইচ্ছে, আবেগ, অনুভূতি, বেঁচে থাকার সাধ। অবসন্ন ব্যাথাতুর শরীরটা বহন করবার মতোও শক্তি নেই। বুকের ভিতরের সমস্ত ব্যাথা, কষ্টগুলি বার বার বুক ফেটে দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে। কিছুতেই সম্বরণ করতে পারেনা। দিব্যেন্দু কাছে এসে দাঁড়ালে শোকে বিহ্বলে ওকে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে ওঠে।
বেদনাহত বিমূঢ়-ম্লান দিব্যেন্দু, পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রিয়তমা মালবিকাকে শান্ত করার মতো একটা শব্দও আর উচ্চারিত হয়না। কি বলে ওকে শান্তনা দেবে! কিছুই তো আর অবশিষ্ঠ নেই। কখনো কি ভাবতে পেরেছিল, জীবনে আনন্দের মুহূর্তগুলি এতো শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে! কখনো কি ভাবতে পেরেছিল, জীবন জোয়ারে সুখের তড়ীতে ভাসতে গিয়ে তড়ীখানা আচমকা একেবারে অতল তলে তলিয়ে যাবে! যেখানে কূল নেই, কিনারা নেই, বেঁচে থাকারও কোনো অবলম্বণ নেই।
পরবর্তীতে রায় চৌধুরী দম্পতীর জীবননদীর খেয়া পুনরায় বাইতে শুরু করলেও প্রাণবন্ত মালবিকার চোখের তারাদু’টিতে খুশীর ঝিলিক কখনো কি আর দেখতে পাবে? ওর উচ্ছাসিত হাসির ফোয়ারা কখনো কি আর শুনতে পাবে? ওর সুস্থ সবল পরিপূর্ণ শরীর ফিরিয়ে দিতে পারবে কোনদিন? হুইল-চেয়ার থেকে আর কি উঠে দাঁড়াতে পারবে কোনদিন? পারবে দিব্যেন্দু সব ফিরিয়ে দিতে? না পারবে না। কোনদিন আর ফিরে আসবে না। শুধু নীরব নির্বিকারে বুকের মাঝারে জমে থাকবে একরাশ ব্যথা-বেদনা। না বলা কিছু কথা। কথার আলাপন। আর অহরহ কানে বাজবে, খুশীর বন্যায় প্লাবিত করে ভ্রমরের মতো ভেসে বেড়ানো মালবিকার গুন গুন গুঞ্জরণে অপূর্ব সুরের মূছর্ণা।
মনে মনে বিড় বিড় করে ওঠে দিব্যেন্দু,-কিচ্ছু ভেবো না মলি, আমি অঙ্গীকার বদ্ধ। আমার অকুণ্ঠ হ্রদয়ের উজার করা নীরব ভালোবাসায় তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দৃঢ় অঙ্গীকারে আমার বুকের সমস্ত কষ্টগুলি যতোই বেদনাময় হোক, সর্বদা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবো শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতিবিজরিত তোমার লাবণ্যময়ী মুখের সেই উদ্ভাসিত একছটাক অনিন্দ্য সুন্দর হাসির শব্দ তরঙ্গে। যা আমরণ গেঁথে রাখবো আমার হ্রদয়কোটরে, এক অদৃশ্য অনুভূতিতে।
স্ত্রীর অলক্ষ্যে পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে দিব্যেন্দু লক্ষ্য করে, মন-প্রাণ সারাশরীর বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে মালবিকার। কয়েক মাসেই অনেক বুড়িয়ে গেছে। চোখমুখও শুকিয়ে মলিন হয়ে ওকে পুতুলের মতো দেখাচ্ছে। কি যেন ভাবছে মালবিকা।
হঠাৎ ওর গভীর সংবেদনশীল দৃষ্টি বিনিময় হতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো দিব্যেন্দুর। ভারাক্রন্ত হৃদয়ে সেদিনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ঙ্কর রাত্রির হ্রদয়বিদারক, যন্ত্রণাদায়ক গহীন বেদানুভূতির তীব্র দংশণে মস্তিস্কের সমস্ত স্নায়ূকোষগুলিকে বাব বার কুঁরে কুঁরে খেতে লাগলো। অত্যন্ত পীড়া দিতে লাগল ওর মুমূর্ষ্য হৃদয়কে। হতাশ আর মূন্যতায় বুকটা হাহাকার করে ওঠে। অনুতাপ আর অনুশোচনার অন্ত নেই। দায়ী করে নিজেকে। মাথাকূটে মরে, সেদিন কেন বাড়ি ছেড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে ছিল? কেন বেড়াতে বেরিয়ে ছিল? আজ একটু একটু করে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ওর মনের শক্তি। বুকের পাঁজরখানাও ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গিয়েছে। গুঁড়ো হয়ে গেছে। মালবিকার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকানো যাচ্ছে না। এ কেমন বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাস, বিড়ম্বণা, ছলনা, প্রবঞ্চনা!
প্রিয়তমা পত্নী, অর্ধাঙ্গিনী, মালবিকাই যে ছিল, চির অম্লান, চির সজীব, শান্ত-স্নিগ্ধ-কোমনীয় এক উদ্বিগ্ন যৌবনা অনন্যা, লাবণ্যা, প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত মমতাময়ী এক বিদূষী নারী, হৃদয়হরিনী। যে ছিল দিব্যেন্দুর নিবেদিত প্রাণ, শক্তির উৎস, প্রেরণা, ভাই-বন্ধু-প্রেয়সী সব। যেকথা আজও বলা হয়নি। বলতে পারেনি দিব্যেন্দু। হয়তো বলাও হবে না কোনদিন। যা মালবিকা কোনদিন আর জানবে না। শুধু যন্ত্রের মতোই রয়ে যাবে দুজনে।
কিন্তু মানুষের জীবন নদীর প্রবাহ কখনো একই স্থানে থেমে থাকে না। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে আপন ঠিকানায়। তদ্রুপ সময়ের নির্মমতা কাঁধে চেপে বিকলাঙ্গ স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দিব্যেন্দুও শুরু করে নতুন জীবন ধারা। বদলে যায় প্রাত্যহিক জীবনের কর্মসূচী, অচেনা অজানা জায়গা। নিত্য নতুন অপরিচিত মানুষের আনাগোনা। যেখানকার পারিপার্শ্বিকতার সাথে খাপ খাইয়ে চলা তাদের পক্ষে ছিল অত্যন্ত দুস্কর। যেন প্রাণহীন সংসার। সুখ নেই, আনন্দ নেই, রূপ নেই, রঙ নেই। কেমন নিরস, নিস্প্রেম, নিরুচ্ছাস দাম্পত্য জীবন। তবু জীবন ও জীবিকার তাগিদে পুনরায় বাসা বাঁধে। বাসার এককোণায় ছোট্ট একটা ক্লিনিক ওপেন করে। সেখানেই সকাল বিকাল দুইবেলা রুগী দ্যাখে দিব্যেন্দু। তাতে যা উপার্জন হয়, বাড়ি ভাড়া দিয়ে একরকম দিন কেটে যাচ্ছিল।
হঠাৎ একদিন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক কাশতে কাশতে দিব্যেন্দুর ক্লিনিকে এসে উপস্থিত হয়।-‘আসতে পারি ডাক্তার বাবু?’ বলে ভদ্রলোক নিজেই সরাসরি দিব্যেন্দুর চেম্বারে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ভদ্রলোকটির একগাল পাকা দাড়ি। মাথার চুল এলোমেলো। পড়নের জামা কাপড়ের অবস্থাও তদ্রুপ। মলিনতার ছাপ প্রকট। খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছে।
খানিকটা বিস্ময় নিয়ে ওর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দিব্যেন্দু বলল,-‘আপনি বসুন। আমি এখুনিই আসছি।’ বলে ঘরের ভিতর চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর এসে দ্যাখে, ভদ্রলোকটি চেম্বারে নেই। সামনে টেবিলের উপর একটি লাল রঙের বাইন্ডার পড়ে আছে। তাতে কিছু কাগজপত্র দড়ি দিয়ে বাঁধা। আশ্চর্য্য, ভদ্রলোক এসে গেল কোথায়? ওয়েটিং রুমেও নেই। ভেরী ইন্টারেষ্টটিং!
দিব্যেন্দু নিজের মনে বিড় বিড় করতে করতে বাইন্ডারটা হাতে নিয়ে খুলে দ্যাখে, ঐ বাইন্ডারে ওর অধিকার চ্যুত শান্তি কুটিরের দলিলপত্র সহ ওর বিষয় সম্পত্তির বৈধ মালিকানার সব প্রমাণপত্র। সেই সাথে একটি লম্বা চিঠি। তাতে লেখা, প্রিয় বন্ধুবরেষু দেব, কি বলে যে নিজের পরিচয় দেবো আমার জানা নেই। চেয়েছিলাম, নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থী হয়ে তোর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াবো। কিন্তু সেই স্পর্ধা আজ আর আমার নেই। ক্ষমার অযোগ্য জেনেও না লিখে পারলাম না। যেদিন জানলাম তোরা দুজনেই জীবিত এবং সশরীরে ফিরে এসেছিস, সেদিন থেকেই অনুতাপ অনুশোচনায় ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো ছটফট করেছি শুধু তোর বিষয় সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার জন্যে। যেদিন লোভ লালসায় নানান প্রলোভনের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে নিজের সততা এবং সত্যকে বিসর্জন দিয়ে মিথ্যার কাছে আত্মবিক্রয়, লোভের কাছে নতিস্বীকার এবং ভোগের কাছে বশ্যতা স্বীকার হয়ে আমায় সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল, সেদিন একটিবারও মনে হয়নি যে, আমার বন্ধুবরেষু দিব্যেন্দু ও তার স্ত্রী জীবিত। কখনো ভাবিনি ওর অমায়িক আন্তরিকতার অনবদ্য সান্নিধ্য আবার ফিরে পাবো। তোর বিষয় সম্পত্তি কিছুই নড় চড় হয়নি। বাড়ির নক্সা খানিকটা বদলে গেলেও নামের সংশোধন করা হয়েছে। তোর ‘শান্তি কুটির’ নামকরণটির পূর্ণজনম হয়েছে।
ভবানী চরণ দাস অন্য কেউই নয়, সে আমার ভগ্নিপতীর বড়ভাই। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। মৃত্যু শয্যায়। অস্তাচলে ডুবে যাওয়া সূর্য্যের মতো জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাসের প্রহর গুনছেন। কিন্তু মাসিমার সেবা-শুশ্রুষা এবং ওনার তত্ত্বাবধানে কোনো ক্রুটিই আমি রাখিনি। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও উনি আজও জীবিত এবং কৃষ্ণনগরে বৃদ্ধাশ্রমে সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। তোদের সুখ শান্তি, আনন্দ সম্পূর্ণ ফিরিয়ে দিতে পারলে অন্তত কিছুটা হলেও পাপ কর্ম থেকে মুক্ত হতে পারবো। যদি সম্ভব হয়, আমায় ক্ষমা করিস।
ইতি-ভাস্কর
চিঠিটা পড়া মাত্র মরিয়া হয়ে উর্দ্ধঃশ্বাসে মায়ের কাছে ছুটে যায় দিব্যেন্দু। গিয়ে দ্যাখে, আরাম কেদারায় বসে বসে দিব্যি পান চিবোচ্ছেন রমলা দেবী। পিছনের বারান্দার রেলিংএ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ভাস্কর। আচমকা দিব্যেন্দুর গলার আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই চমকে ওঠে। এখন মুখ দেখাবে কেমন করে! পালাবার আর রাস্তা নেই। লজ্জায় অপমানে মুখ লুকোবার চেষ্টা করে। ওকে দেখতে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে দিব্যেন্দু। অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল,-‘দেখা না করেই চলে এলি ইডি্যেট। চেহারার এ কি হাল করে রেখেছিস? তোকে তো চেনাই যাচ্ছেনা। লজ্জা পাচ্ছিস কেন! একটু কষ্ট পেলেও আজ আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। আসলে সব আমাদের অদৃষ্ট। তা না হলে হঠাৎ সমুদ্র-সৈকতেই বা যাবো কেন বল! কপালে দুর্ভোগ থাকলে ঠেকাবার সাধ্য কার! শুধু দুঃখ এইটুকুই, পঙ্গুত্ব নিয়ে মালবিকা আজ হুইল-চেয়ারে পড়ে আছে। ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় পা-দুটো হারিয়ে সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে। মুখে কথা নেই, হাসি নেই। নেই জীবনে নতুন কোনো স্বপ্ন, ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি, কিছুই নেই। কি করে যে বাকী জীবনটা কাটাবো, বুঝতে পারছি না।’
ভাস্কর তখনও নিরুত্তর। বলবার মতো কোনো শব্দই আর খুঁজে পায় না। ক্ষমা প্রার্থীর ন্যায় অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা হেট করে থাকে। দিব্যেন্দু ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,-‘ষ্টুপিড, আমায় কি তোর পায়ে ধরতে হবে?’
তক্ষুণি দিব্যেন্দুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে ভাস্কর।
সমাপ্ত
যুথিকা বড়ুয়া-টরোন্ট প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।