পর্যালোচনায় —অধ্যাপক মানবর্ধন পাল
কবি শফিকুল ইসলাম পেশায় বিসিএস ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা হলেও অন্তর্গত চরিত্রে তিনি কবি । তাঁর নিওরণে শিল্পের, লোহিত কণিকায় কবিতার ঘ্রাণ এবং হৃদয়ে ছন্দের কল্লোলিত ঝংকার। তার শিল্পিত মানসে শৈশব থেকে কাব্য বোধের অঙ্কুরোদগমনের যে জাগরণ তিনি অনুভব করেছেন, উপলব্দি করেছেন হৃদয়াবেগের তাড়নাকে শৈল্পিক শব্দে আত্মপ্রকাশের, তা-ই তাকে ধাবিত করেছে কবিতার কুসুমিত ও কন্টকাকীর্ণ পথে ।
কবিতা অধরা, কবিতা ছলনাময়ী,কবিতা মরীচিকা,মায়ামৃগ-প্রতারক বললেও বড় বেশী ভূল হবে বলে মনে হয়না। কারণ কবিতা অনেকেই লিখতে চেষ্টা করেন এমনকি লেখেন ও কিন্তু কাব্য-লক্ষ্মী স্বপ্নলোকের সম্রাজ্ঞীর মত অস্পর্শিতই থেকে যান। তাইতো জীবনানন্দ বলেছেন, সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি। তবে স্পর্শের অযোগ্য এবং অনাঘ্রাত সেই কাব্য-লক্ষ্মী যার মনে দোলা দিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তার বক্ষে বেদনা অপার।
হৃদয়-সঞ্জাত এই বেদনাবোধই কবি শফিকুল ইসলামের কবিতার নির্যাস। বেদনার বহুধা অনুভূতি, বহুমাত্রিক বিস্তার, এর প্রতি শব্দ ও অনেক। দুঃখের অনেক রূপ ,কষ্টের অনেক শেকড়, বেদনার অনেক বিমূর্ত ও ভাষাহীন আকুতি । কিন্তু দুঃখ কষ্ট ,বেদনা যাই বলিনা কেন সব কিছুর রঙই বোধকরি কালো আর এ সবের পরিনতি বিরহবোধে নিমজ্জন ।
পৃথিবীর সব কবিরাই মনে হয় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসেন । তাই পূর্বাপর আদিগন্ত বাংলা কাব্যে উৎস থেকে অদ্যাবধি বিরহেরই জয়জয়কার । বিরহবোধ নামক এই শব্দটি প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ও প্রাণধার। মহাকবি কালিদাস থেকে কবীন্দ্র পরমেশ্বর,চন্ডিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রনাথ থেকে সুধীন্দ্রনাথ বেদনা ও বিরহবোধেই আবক্ষ আক্রান্ত। কালিদাসের মেঘদূত আছে যক্ষপ্রিয়ার জন্যে বিরহের উত্তুঙ্গ অনুভব। আমার বধূয়া আন-বাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া- চন্ডীদাস এভাবেই দুঃখের কাব্যসৌধ বিনির্মাণ করেছেন। অন্তিমে রাবিন্দ্রীক অনুভূতি হলো ঃ আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন । আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তো আরো স্পষ্ট করে বলেছেনঃ মৃত্যু শুধূ মৃত্যুই ধ্রুব সখা/যাতনা শুধুই যাতনা সূচির সাথী।
পূর্বজ কবিদের দ্বারা বাহিত মানব জীবনের এসব চিরকালীন ট্র্যাজিক অনুভবের সীমিত অর্থে হলেও উত্তরসাধক কবি শফিকুল ইসলাম । তাঁর কাব্যগ্রন্থ একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি (২০০৪) বিবেচনায় এনে কবি চরিত্রের বিষয়-আশয় অনুধাবন করার চেষ্টা করবো। মানব জীবনের মহৎ সত্য এবং শিল্প সৌন্দর্যের প্রতি আস্থাবান কবি শফিকুল ইসলাম। মানুষই শিল্পের স্র্ষ্টা এবং সাধক। তাই জীবন ও জগত ছাড়া শিল্পের আর কোন দ্বিতীয় অবলম্বন নেই। জীবনের সদর্থকতার প্রতি আস্থাশীল বলেই কবি শফিকুল ইসলাম আলোচ্য কাব্যের উৎসর্গ পত্রে লিখেছেনঃ–
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা।
কবি শফিকুল ইসলাম ষাটটি কবিতা দুই মলাটে বন্দি করেছেন, একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি কাব্যগ্রন্থে। সবগুলো কবিতারই মৌলচেতনা প্রেমের বিচিত্রবিধ রূপের প্রকাশ । বাংলা কবিতায় প্রাচীন লীলাভূমি বলে প্রেম চেতনা রূপায়নের প্রধান অনুষঙ্গ নিসর্গ। প্রেম এবং প্রকৃতির মূলাধার সুন্দরের প্রতি মানব মনের চিরকালীন আকর্ষণ। কবির ভাষায় ঃ-
যখন একটি গোলাপ দেখি বাগানে
আপন সৌন্দর্যের মহিমায় ফুটে আছে
তখন আমি আসলেই তোমাকে দেখি
তুমিই তো রক্ত-গোলাপ এই হৃদয়ের উদ্যানে।
(কবিতাঃ যখন একটি গোলাপ দেখি)
যেমন করে বিশাল আকাশ সারাক্ষণ
ঢেকে রাখে এ পৃথিবীকে তার পক্ষপুটে,
যেমন করে একটি নদীর দু’তীর
স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে বুকের মধ্যে
আগলে রাখে তরঙ্গমালাকে-
প্রিয়তমা তেমনি করে
তুমি আমাকে আগলে রাখো
তোমার ভালবাসার ছায়া-অঞ্চলে।
(কবিতাঃ যেমন করে বিশাল আকাশ)
তুমি সন্ধ্যাতারা
যখন সমূদ্র অন্ধকারে ডুবে যায় পৃথিবী,
তুমি দূর উর্ধ্ব গগনে
অকলংক নিষ্পলক জ্বল জ্বল করে
জ্বলো অনির্বাণ দীপশিখা হয়ে
জেগে থাকো আমার মনের আকাশে–
(কবিতাঃ তুমি সন্ধ্যাতারা)
এভাবেই মানবীয় প্রেম ও প্রকৃতি শফিকুল ইসলামের একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি কাব্যগ্রন্থে একাকার এবং একাত্ম-অণ্বিষ্ট হয়ে আছে। কখনো কখনো প্রকৃতিতে নরত্বারোপ করেছেন তিনি। আকাশ, সমূদ্র, ফুল, মেঘ, বৃষ্টি-এসবের মধ্যে মানবী রূপের চিত্রকল্প বিনির্মাণ করেছেন।তাঁর প্রেম জীবন্ত থাকলে প্রকৃতি সুষমামন্ডিত হয় আর অনুরাগ আহত হলে প্রকৃতিতে ও পড়ে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া-হারিয়ে যায় রুপের জৌলূস, কলঙ্কিত হয় সুনির্মল সৌন্দর্য, অমানিশায় আক্রান্ত হয় প্রেমের শিল্পিত ভূবন । কবির ভাষায় ঃ-
তুমি চলে গেলে
আমার ভূবনে নেমে আসে
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার।
নিজেকে আমি আবিষ্কার করি
এক জনশূন্য প্রান্তরে।
তোমার কথা থেমে গেলে
প্রস্তুরীভূত প্রাচীন সভ্যতার
ধ্বংসাবশেষের মত এক অনন্ত নীরবতা
আমার চারিপার্শ্ব গ্রাস করে।
(কবিতাঃ-তুমি চলে গেলে)
সন্দেহ নেই কবি শফিকুলের প্রেম চেতনা একান্ত মানবীয় এবং নিতান্তই জীবন ঘনিষ্ঠ । বাংলা গীতি কবিতা সম্পর্কে একদা আপ্তবাক্য ছিল যে,কানু বিনা গীত নেই, ঠিক তেমনি বাংলা কবিতা সম্পর্কে আরো পরম সত্য হলো- প্রেমের নিটোল প্রকাশ ছাড়া কবিতা নেই। তবে প্রেম সর্বদা সুখের আধার নয় ; প্রেম বেদনা বিধুরতার গভীর মহাসমূদ্র ও বটে। ব্যর্থতার নিমজ্জনে বিরহের সাত-আসমান শূন্যতা ।
শফিকুল ইসলামের একটি আকাশ অনেক বৃষ্টি কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই বিরহ ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত । একে আবার সুখের অসুখ বলেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে । তুমি-আমিএবং আমি-তুমি এর অনুভূতি বাংলা কবিতায় চিরন্তন। সেই বৈঞ্চবীয় যুগের রাধাকৃঞ্চ থেকে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের লায়লা-মজনু, শিরি-ফরহাদ, এবং জনপ্রিয় লোকগাথা রহিম-রূপবান থেকে আধুনিক কালের জসীম উদ্দিনের সাজু-রূপাই পর্যন্ত এই তুমি-আমি এর মিলনাকাংখার ইতিহাস বিস্তৃত। শফিকুল ইসলামের কবিতা এই ধারাই উত্তরসাধক এবং একুশ শতকী আধূনিক সংস্করণ । তার কবিতা প্রেমাম্পদের প্রতি এতখানি নিবেদিত যে আমিত্ব বিলোপে তিনি নিঃশর্ত দ্বিধাহীন। তাই তিনি লেখেনঃ-
তুমি আমার সমৃদ্ধ অতীত
চলমান বর্তমান
সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ-
তোমাকে বাদ দিলে আমার থাকে কি ?
তোমার চোখে চোখ রেখে
আমি আমার বিশ্ব পৃথিবী দেখি
তোমার ভালবাসা আমার প্রেরণা-
তুমিই আমার স্মৃতি-
রাতের স্বপ্নœ, দিবসের কল্পনা-
তোমাকে বাদ দিলে আমার থাকে কি ?
স্মৃতি বলে আর কিছু থাকে কি ?
তোমাকে বাদ দিলে
আমি স্মৃতি ভ্রষ্ট মানুষ হয়ে যাই-
(কবিতা্ঃ- তুমি আমার সমৃদ্ধ অতীত)
এই আমিত্ব বিলোপের মাধ্যমে প্রেমাস্পদের কাছে মন-প্রাণ-দেহ আপাদশির নিবেদন করেও শেষ পর্যন্ত শফিকুল ইসলামের কবি-স্বভাব বিরহ চেতনার মহাসাগরেই সমর্পিত ।
[প্রকাশকঃ আমীর প্রকাশন, ৩১/৩২ বাংলাবাজার, পুস্তক ভবন, ঢাকা ১১০০ ফোন – ৭১৭৫১৫১, মোবাইল ০১৭২০৬০৮২৫। প্রাপ্তিস্থানঃ বুক মার্ট, ১৮৫ গভঃ মার্কেট, ঢাকা –১২০৫] এছাড়া www.rokomari.com থেকে অনলাইনে সরাসরি বইটি সংগ্রহ করা যাবে।