বাইরে প্রচন্ড বেগে ঝড় বইছে। সেই সঙ্গে ভারী বর্ষণ। বাতাসের তোরে বৃষ্টির পানি এসে অশেষকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। অশেষ রাতে জানালা খোলা রেখে শুয়ে ছিলেন। উঠে জানালার কাচ টেনে, জানালা বন্ধ করে দিলেন। ছেলেবেলা থেকেই অশেষের আলো নিভিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস। সমস্ত ঘর নিকশ কালো আঁধারে ডুবে রয়েছে। বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়ের একটানা শব্দ গোঙ্গানির মতো শোনাচ্ছে।
অশেষ চোখ বন্ধ করলেন। এমন পরিস্থিতিতে ভয় ভয় লাগার কথা। কিন্তু অশেষের একটুও ভয় লাগছেনা। ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছে। ঝড় আর বৃষ্টির আওয়াজ অনেকটা কান্নার মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, আকাশ বেদনায় কান্না করছে। বাইরে আকাশের বুকফাটা কান্না আর ভেতরে অশেষের চোখের পানি বুক ভিজিয়ে দিতে লাগলো।
শৈশব থেকেই অশেষ অপমান, অনাচার নিষ্ঠুরতা সইতে সইতে কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছেন। তারপরও মাঝে মাঝে ভীষন কান্না পায়। বোবা কান্না। পাথরের মতো। পাথরের কান্না বোধহয় এমনই হয়। কেউ শুনতে পায়না। প্রিয়জনের স্নেহ- মমতার আবেশ কে- না পেতে চায়! অশেষও চেয়েছিলেন। কিন্তু অশেষের এই চাওয়া শুধুমাত্র অমূলকই নয়, দুঃস্বপ্নও বৈকি। একজন অনাথের জীবনের চাওয়ার ব্যপ্তি এর থেকে বেশি বোধহয় হতে পারেনা।
মাঝে মাঝে শৈশবের বন্ধুদের কথা এবং ফেলে আসা স্মৃতিগুলো অশেষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। শৈশবের সবকিছুই ভীষণ রোমাঞ্চকর! আর খেলার সাথীদেরতো একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকা যায়নি। কতো বছর কেটে গেলো, অথচ মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা! ছেলেবলার সব বন্ধুরা আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে আছে অনন্তের জন্য। সবাই একই রকমের ছিলেন। হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, কোন কিছুরই উপস্থিতিই ছিলোনা তাঁদের মধ্যে। ছিলো শুধু বিশুদ্ধ ভালোবাসা। এঁদের মধ্যে নারানীর সঙ্গে অশেষের একটা গভীর আত্মীক সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে নিবিড়ভাবে। একটি শিশু মেয়ের ভেতরে আপনা হতেই এতোটা মানবিক বোধ বিরাজমান কি করে থাকে, সে কথা মনে হলে এখন বিস্ময়কর লাগে।
নারানী, অশেষের চাওয়া পাওয়া কেন যেন আপনা হতেই বুঝতে পারতেন। নারানীর এই জাদুকরী ক্ষমতাকে অশেষ বরাবরই ভীষণ শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেন। আর তাইতো নারানীর জন্য অশেষের আর দশজনের থেকে একটু আলাদা ভালোবাসা এখনও বিদ্যমাণ রয়েছ। আজ এই বৃষ্টি এবং ঝড়ের রাতে এই একলা অবসরে, প্রাণের গভীরে নারানীর জন্য অদ্ভুত এক চোরাটান অনুভব করছেন। ভীষণ মনে পড়ছে নারানীকে, নারানীর সঙ্গে কাটানো সেই ফেলে আসা মুহূর্তেগুলোকে।
আজকে এই ঝড়ের রাতে অশেষের চোখের সামনে নারানীর মায়াবী মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো। সেই কবেকার কথা! অশেষের এবং নারানীর বয়স নয় কি দশ বছর হবে হয়ত ছিল। সেদিন ছিল দিওয়ালির রাত। সন্ধার পরে হাঁপাতে হাঁপাতে নারানী ছুটে এসেছিলেন অশেষদের বাড়িতে। নারানী দ্রুত ল’য়ে শ্বাস নিতে নিতে বলেছিলেন ,
-অশেষ, আমার সঙ্গে যাবি? আজকে দিওয়ালি। বাবা অনেকগুলো ফানুস কিনে এনেছেন। তোকে সঙ্গে নিয়ে ফানুস ওড়াতে বলেছেন। তুই যাবি আমার সঙ্গে?খুব মজা হবে। তাড়া করে চল। আমারা দুজনে মিলে একসঙ্গে ফানুস ওড়াবো।
নারানীর কথা শোনে অশেষের কি-যে আনন্দ হচ্ছিল, তা ব’লে বোঝানোর মতো নয়। কতোদিনের স্বাধ, আকাশে কিছু ফানুস ওড়াবে। ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু বাদ দিয়ে দৌড়ে নারানীর সঙ্গে ফানুস ওড়াতে যেতে। অশেষের একদম ত্বর সইছে না। কিছু একটা ভেবে বললেন,
-কিন্তু মা’কে তো বলতে হবে। তা-না হলে মা খুব চিন্তা করবেন এবং কষ্ট পাবেন।
নারানী বললেন,
– মা’কে নিয়ে তোর এতো আকাশ পাতাল ভাবতে হবেনা। আমি, মাসি-মা-কে বলছি। মাসি-মা নিশ্চয়ই বারন করবেননা।
কথা শেষ করেই নারানী ভেতরের ঘরে ঢুকলেন। অশেষের মা শুয়ে ছিলেন। মাসি-মা শুয়ে রয়েছেন। মাসি-মার যাতে ঘুমের ব্যঘাত না ঘটেন, এই ভাবে স্থির হয়ে থামলেন নারানী। কিন্তু নারানীর চঞ্চল দু’পায়ের আওয়াজে অশেষের মা চোখ মেলে নারানীর দিকে তাকালেন। নারানীকে দেখে তিনি ভীষণ খুশি হলেন। বললেন,
-কিরে, কিছু বলবি? এদিকে আয়। কতোদিন পরে এলি! আয়, আমার কাছে।
নারানী অশেষের মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাসি মায়ের চুলে কচি কোমল হাত দুটি দিয়ে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন,
-মাসি মা, আজকে দিওয়ালি। অশেষকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই? বাবা অনেকগুলো ফানুস কিনে এনেছেন, আমার এবং অশেষের জন্যে। তুমি কিন্তু মানা করতে পারবেনা!
-মানা করবো কেন, অবশ্যই অশেষ তোর সঙ্গে যাবে।
-তাহলে তুমি বলে দাও। নইলে অশেষ কিছুতেই যাবেনা।
-ঠিক আছে। অশেষকে আমার কাছে ডেকে দে, আমি বলে দিচ্ছি।
অল্প সময় পরে অশেষ এবং নারানী মায়ের ঘরে ফিরে এলেন। মা বললেন,
-অশেষ, নারানীর সঙ্গে যা তবে বেশি রাত করবিনা। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি, কেমন!
-জি মা, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।
তাহলে আমি যাই মা?
-আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে যাবি, কেমন!
জি, মা, কোন সমস্যা হবেনা। আচ্ছা, যা তাহলে।
তারপর নারানীকে বললেন,
-সাবধানে যাবি।
– জি মাসি মা, তুমি চিন্তা করো-না।
-আচ্ছা।
অশেষ আর নারানী মিলে, নিয়ন আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে রংবেরঙের অনেকগুলো ফানুস একসঙ্গে সুতা দিয়ে বেঁধে উড়িয়ে দিলেন তাঁরায় তাঁরায় খচিত আকাশের বুকে। আশ্চর্য আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে ছড়িয়ে ফানুসগুলো আকাশের গহীনের পাণে ছুটে চললেন । আর অপূর্ব নিষ্পাপ দুটি শিশু তাকিয়ে থাকলেন, সমস্ত বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে ফানুশের অবারিত সৌন্দর্যের দিকে।