অফিস থেকে ফেরার পথে একটি জায়গায় এসে অশেষ থামলেন। বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে আছেন।  উঁকি দিয়ে দেখতে পেলেন, হতদরিদ্রদের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। সববয়সী নারী-পুরুষ এসেছেন ত্রাণ নিতে। কিছু শিশুরাও এসেছেন।

সবাই ত্রাণ পেতে চেষ্টা করছেন। একজন বৃদ্ধা অশেষকে বললেন,
-বাপজান, আমাকে একটু ধরবেন?
বৃদ্ধা মহিলা জীর্ণ শীর্ণ দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। অশেষ বৃদ্ধা নারীটিকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর একটি ছোট চা-পানের দোকানের সামনে রাখা কাঠের বেঞ্চের উপর বসিয়ে দিলেন।
বৃদ্ধার শরীর কাঁপছে। অশেষ রুটি, কলা, পানি কিনে বৃদ্ধাকে খেতে দিলেন। প্রথমে বৃদ্ধা খানিকটা সংকোচ বোধ করছিলেন। অশেষ সেটা বুঝতে পেরে আরো আন্তরিকতার সহিত বললেন,
-কি ভাবছেন মা? নিন খান! আপনার জন্য কিনেছি। লজ্জা কি! আমি আপনার ছেলের মতো।
অশেষের কথায় বৃদ্ধার চোখে পানি চলে এলো। আঁচলে চোখের পানি মুছলেন। তারপর খেতে শুরু করলেন। অশেষকে জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনি খাবেন না বাপজান?
-না-মা। আমি পরে খাবো। আপনি খেয়ে নিন।
খেতে খেতে বৃদ্ধা বললেন,
-আজকে সারাদিন কিছু খাইনি। আমার মেয়েটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। কতোদিন হয়ে গেলো কাজ নেই। বেতন নেই। খুব কষ্টে আছি বাপজান। মেয়েটিও না খেয়ে আছেন।
-আমি জানি মা। আমিও অনেক কষ্টে আছি। আমরা সবাই অনেক কষ্টে আছি। এই কষ্টের শেষ কোথায়, আমরা কেউ জানিনা। শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তিনি যদি এর থেকে আমাদের মুক্তি দেন। একমাত্র তাঁর উপর ভরসা করে আছি মা!    মানুষের বেঁচে থাকার সবকিছু ফুরিয়ে যাচ্ছে। জানিনা এরপর কি হবে!

ত্রাণ বিতরণেে নিয়োজিত কর্মীদের কাছ থেকে অশেষ বৃদ্ধার জন্য একটি ত্রাণের ব্যাগ চেয়ে নিলেন। সেটি মহিলার হাতে দিয়ে বললেন,
-এটা নিন মা। ব্যাগ ভর্তি চাল, ডাল, লবন, তেল, আটা এই সমস্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী রয়েছেন। বর্তমান সরকার প্রধান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সবকিছুর ব্যবস্থা করেছেন। তিনি চেষ্টা করছেন, যেন একজন মানুষও না খেয়ে কষ্ট না পান।
-জি, বাপজান। আপনি ঠিক বলেছেন। শেখের বেটির অনেক মায়া। তিনি আমাদের দুঃখ কষ্ট বুঝতে পারেন। মহান আল্লাহ তাঁর উপর রহমত নাজিল করুক।

অশেষ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন বৃদ্ধার কথাগুলো। ভীষণ ভালো লাগছে।
বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
-আমি তাহলে যা-ই বাপজান!  মেয়েটাও না খেয়ে আছেন।
অশেষ বললেন,
-আর একটু অপেক্ষা করুন মা।
অশেষ আরো কয়েকটি কলা এবং  বড় এক প্যাকেট রুটি কিনে বৃদ্ধার হাতে দিলেন। একটি কাগজে নিজের ঠিকানা এবং মোবাইল ফোন নম্বরও লিখে দিলেন। সঙ্গে একশো টাকা।
-এটা রাখুন মা!  এতে আমার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লেখা আছে। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।
বৃদ্ধা অশেষকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
-আল্লাহ আপনাকে অনেক বড় করবেন বাপজান, অনেক বড়।
-আপনার কে কে আছেন বাপজান?
-কেউ নেই। আমি একজন অনাথ। একটি পড়িবারে বড় হয়েছি। সেই পড়িবারের যিনি মা, তিনি আমাকে লালন পালন করেছেন। অন্যরা আমাকে সারাদিন অপমান করেন।  তবুও আমি সেখানেই থাকছি। কারণ যাকে আমি মা ডাকি, তিনি এখন বৃদ্ধ এবং খুব অসুস্থ। তাঁর নিজের যে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে থাকেন তিনি    এখন তাঁকে ঘৃণা করেন এবং ভীষণ অবহেলা করেন। আমিই তাঁকে দেখাশোনা করি। এখন আমার উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এতো কষ্ট হয় মা! বৃদ্ধ মা’কে নিজের সন্তানেরা এতো অবহেলা করেন! আমাকেও করেন। কিন্তু আমি এই অসহায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও যেতে পারছিনা।

বৃদ্ধা অশেষের কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেলেন। কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে পরছেন। অশেষ বললেন,
-আপনি মন খারাপ করবেন না মা!চলুন, আপনাকে রিক্সায় তুলে দেই।
অশেষ একটি রিক্সা ভাড়া করে দিলেন। ভাড়াও দিয়ে দিলেন। বললেন,
-তাহলে বিদায় মা।
বৃদ্ধা মুখে আর কিছুই উচ্চারণ করতে পারলেন না। বিদ্যুৎ এর চার্জের শক্তি নিয়ে ঢিমে তালে রিক্সটি এগিয়ে চললো বৃদ্ধার গন্তব্যের দিক। অশেষ সে দিকেই বিমূর্ত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় রিক্সাটি চোখের আড়াল হয়ে মিলিয়ে গেলেন।
(চলবে)।

3 মন্তব্য

  1. হৃদয় স্পর্শী

    -কেউ নেই। আমি একজন অনাথ। একটি পড়িবারে বড় হয়েছি। সেই পড়িবারের যিনি মা, তিনি আমাকে লালন পালন করেছেন। অন্যরা আমাকে সারাদিন অপমান করেন। তবুও আমি সেখানেই থাকছি। কারণ যাকে আমি মা ডাকি, তিনি এখন বৃদ্ধ এবং খুব অসুস্থ। তাঁর নিজের যে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে থাকেন তিনি এখন তাঁকে ঘৃণা করেন এবং ভীষণ অবহেলা করেন। আমিই তাঁকে দেখাশোনা করি। এখন আমার উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এতো কষ্ট হয় মা! বৃদ্ধ মা’কে নিজের সন্তানেরা এতো অবহেলা করেন! আমাকেও করেন। কিন্তু আমি এই অসহায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও যেতে পারছিনা।

  2. অসাধারণ
    -কেউ নেই। আমি একজন অনাথ। একটি পড়িবারে বড় হয়েছি। সেই পড়িবারের যিনি মা, তিনি আমাকে লালন পালন করেছেন। অন্যরা আমাকে সারাদিন অপমান করেন। তবুও আমি সেখানেই থাকছি। কারণ যাকে আমি মা ডাকি, তিনি এখন বৃদ্ধ এবং খুব অসুস্থ। তাঁর নিজের যে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে থাকেন তিনি এখন তাঁকে ঘৃণা করেন এবং ভীষণ অবহেলা করেন। আমিই তাঁকে দেখাশোনা করি। এখন আমার উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এতো কষ্ট হয় মা! বৃদ্ধ মা’কে নিজের সন্তানেরা এতো অবহেলা করেন! আমাকেও করেন। কিন্তু আমি এই অসহায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও যেতে পারছিনা।

  3. আমার লেখা ধারাবাহিক উপন্যাস। লেখাটি প্রকাশ করে পাঠকদের পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পরবাসী ব্লগ পত্রিকা এবং হাফিজুর রহমান ভাইয়ের জন অফুরান ভালবাসা এবং শুভকামনা রইলো। একজন অশেষের মাঝে অগণিত অশেষের দুঃখ-গাথা রয়েছে, আমার লেখায়। সবাই পড়বেন, বিনীত অনুরোধ করছি। পরবাসী ব্লগ পত্রিকা হোক আপনাদের মনের খোরাক যোগানোর একান্ত সঙ্গী। সবার জন্য অবিরল ভালোবাসা এবং শুভকামনা।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন