অফিসের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় অশেষের ভেতরে উদ্বিগ্নতা বেড়ে গেল। এই সময়টাতে দু-একটি পাঠাও-এর মটর সাইকেল পাওয়া যায়। আজকে তা-ও খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কর্কশ ভাষা আর নিষ্ঠুর আচরণের কথা মনে হতেই বুকের ভেতর কম্পন শুরু হয়ে গেল।
অশেষের মতো আরো কয়েকজনও রয়েছেন এ যাত্রায়। তাঁদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তাঁরাও অশেষের মতো একই রকম বিপদগ্রস্ত। যতোটা দ্রুত হাঁটা সম্ভব তার চেয়েও বেশি জোরে হাঁটতে চেষ্টা করছেন অশেষ এবং সহ যোদ্ধারা। দেখা যাক আজকে ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা। মনে মনে সৃষ্টিকর্তর সাহায্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর উপায় কি!

আচমকা দৃষ্টি আটকে গেলো। কয়েকজন শিশু-কিশোর একত্রে বসে পরিত্যাক্ত পলিথিনের ব্যাগের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে বেলুনের মতো করে ফোলাতে ব্যস্ত রয়েছেন। বেশ লাগলো দেখতে। ছোট বেলায় এভাবে কতো রঙ-বেরঙের বেলুন ফুলিয়েছেন অশেষ।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন বললেন,
-দেখছেন ভাই সাহেব, এঁরা কিভাবে নেশা করছেন?
লোকটির কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারলেন না অশেষ। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন লোকটির দিকে। লোকটি পুনরায় বললেন,
-বুঝলেন না ভাই, এঁরা বেলুন ফুলিয়ে খেলা করছেন না। নেশা করছেন। এই নেশার নাম ডান্ডি।
-কি বলেন ভাই!
-জী ভাই। এটা এক নতুন ধরনের নেশা। ওঁরা নিশ্বাসের সঙ্গে পলিথিনের ভেতরের গন্ধ শুষে নিচ্ছে। এতে দারুণ নেশা হয়। টোকাইরা এটার উপর খুব ঝুঁকেছে্ন আজকাল। টাকা পয়সা লাগেনা। কুড়িয়ে নিয়েই নেশা করা যায়।

লোকটির কথা শুনে অশেষ আকাশ পাতাল ভেবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। এ কি করে সম্ভব! এমন নিষ্পাপ শিশগুলো কেন এই মরণ নেশা বেছে নিয়েছেন! কাছাকাছি কয়েক জন নারী-পুরুষ ঘুমে আচ্ছন্ন রয়েছেন। কাছা কাছি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাঁরাও দেখছেন শিশুদের এই মরণ নেশার খেলা। কিন্তুু তাঁরা বাঁধা দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে হয়তো এতো আয়েশ করে শিশুগুলো এই মরণ নেশায়, এতোটা নির্ভয়ে ডুবে যেতে পারতেন না।

নেশায় মগ্ন নিষ্পাপ শিশুগুলোর দুই পাশের প্রসস্ত রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করছে দামী দামী গাড়ি এবং গারির মালিক পুঁজি পতি মহাধীরাজগণ। তাদের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই পরে, এই সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের যাপিত জীবনের করুণ চিত্র। তাঁদের কাছে এতো এতো অর্থ সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা আছে, তা বোধ করি এক জনমে ভোগ করা তাঁদের পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব হবে না। তাঁরা কি পারেন না, এই অসহায় শিশুদের জন্য তাঁদের হাতটি বাড়িয়ে দিতে? যদি দিতেন, তাহলে এতো এতো ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদের জীবন ডান্ডি নামক মাদকের করাল থাবায় অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে যেতে পারতো? পারতো না। এভাবে আর কতদিন চলবে? আহা! কি কষ্ট এঁদের!

সব কিছু মিলে আজকে মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। মোবাইল ফোনে রিং বাজছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেবই কল করেছেন। অশেষ মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে শুরু করলেন। কলটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে যে কথাগুলো শুনতে পেলেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত। কোন প্রতি উত্তর না শুনেই তিনি লাইনটি কেটে দিলেন। অশেষ হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়ালেন। অন্যরা ছুটে চলছেন পূর্বের মতোই। একজন পেছন ফিরে জানতে চাইলেন,
-কি ভাই, থামলেন যে, অফিসে যাবেন না?

অশেষ কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না, কি বলবেন লোকটিকে। চুপ করেই রইলেন। লোকটি কি ভাবলেন তা অশেষের জানার দরকার নেই। যা ইচ্ছে তা-ই ভাবুক। কিন্তু অশেষ চোখের সামনে খাঁ খাঁ তপ্ত মরু সাগর দেখতে পেলেন। এই কভিড-১৯ এর বানের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে অশেষও হতাশার কাফনে নিজেকে মুরিয়ে ভাসতে লাগলেন মরু সাগরে নিরুদ্দেশের পথে। আসছে দিনগুলোর ভয়াবহতার কথা মনে হতেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন গুলো ফিনিশ পাখির রূপ ধারণ করে দূরে কোথাও উড়াল দিলেন মুহূর্তেই। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাসার দিকে ফের যাত্রা শুরু করলেন অশেষ।
(চলবে)।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন