বাইরে বৃষ্টির একঘেয়েমি শব্দ, কান্নার মতো বেদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। অশেষ জানালা খুলে দিলেন। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে মিশে শরীরে এক ঝটকা হিমশীতল পরশ বুলিয়ে দিলো।

সেদিন এমনি অবিরাম বর্ষণ হচ্ছিল। বাড়ী ফেরার জন্য অশেষকে তিনবার গাড়ী বদলাতে হয়। প্রথম মাইল খানেক পথ রিক্সায়। তারপর বাসে দীর্ঘ পথ শেষ হলে আবার রিক্সায় বাসা অবধি ফেরা সম্ভব হয়। কভিড-১৯ এর করাল থাবায় সমস্ত পৃথিবী আজকে থমকে দাঁড়িয়েছে। চারদিক জনমানব শূন্য। চিরচেনা পৃথিবীর স্বরূপ পাল্টে, যেন অন্য এক পৃথিবী আবির্ভূত হয়েছেন!

রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় সমস্ত দোকানপাট, যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। শুধু মাত্র খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জন্য ছোট কিছু যান চলাচল করে। অবিরাম বৃষ্টির কারণে আজকে তা-ও নেই।

অশেষের মতো আরো কয়েকজন যাত্রী ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, বাড়ী ফেরার তাড়নায়। অশেষ এদিকে ওদিকে তাকালেন। বাড়ী ফেরায় অপেক্ষারত সবার মুখই শুকনো। চোখেমুখে দুঃশ্চিতার কালো আভায় সবাইকেই ভীষণ বিষন্ন দেখাচ্ছে। হয়তো রোজা রেখেছেন। আযান শোনা গেলে পথেই ইফতার সেরে নিতে হয়। অশেষ ব্যাগে পানি এবং ফলের জুস রেখেছেন। এই দিয়েই ইফতার সারতে হবে।

অনকক্ষণ বাদে একটি ছোট যান এলো। যানটির নাম অটো বইক। খুবই হালকা ধরনের যান এটি। বিদ্যুতের চার্জে চলে। পেছনে চারজনের সিটে চাপাচাপি করে মুখোমুখি হয়ে ছয়জনকে বসতে হয়। আর সামনে চালকের দুই পাশে দু’জন বসতে পারেন।

অটো বইকটি আসা মাত্রই বাড়ী ফেরার অপেক্ষমান সবাই-ই হুর মুর করে যানটিতে ওঠলেন। অশেষও ওঠে বসলেন। বৃষ্টির পানিতে সমস্ত শরীরই ভিজে রয়েছে। কভিড-১৯ প্রতিরোধী মাস্কটিও ভেজা। সেটি খুলে বাইরে ফেলে দিলেন। ব্যাগে একটি হাল্কা ঘিয়ে রঙের তোয়ালে রাখা আছে। সেটি বের করে মুখ, চশমার কাচ এবং মাথার চুল মুছে নিলেন। এখন একটু স্বস্তি বোধ করছেন।

যানটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুজন নারী যাত্রী খানিকটা জোর করেই গাড়ীটি থামালেন। কিন্তুু যানটিতে কোন সিট ফাঁকা নেই। বাইরের বিরামহীন বৃষ্টির ধারায় দুজন নারীই কাক ভেজা ভিজেছেন। অভুক্ত শুকনো মুখ, হতাশা আর উৎকন্ঠা, তাঁদেরকে আরো বেশি বিষাদগ্রস্হ করে রেখেছেন। অশেষ ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতে থাকলেন, কভিড-১৯ এর করালগ্রাসের যাঁতাকলে পিষ্ট অসহায় মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের বাস্তব চিত্র। আহ! বুকের ভেতর ভীষণ বেদনা অনুভূত হচ্ছে।

নারী যাত্রী দুজনেই কাইকে কিছু না বলে খানিকটা জোর করেই যানটিকে ওঠালেন। ঘাড় ও মাথা নিচু করে কোনরকমে দাঁড়ালেন। অন্য যাত্রীরা সবাই-ই নির্বক। বসে থাকা নারী তিনজন নিজেরা নিজেদের কষ্ট ভাগাভাগি করে নিয়ে নারী যাত্রী দুজনকেই তাঁদের হাঁটুর উপর ভর করে বসতে দিলেন।

বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই মানবতার এক বিরল দৃষ্টান্ত, এই বিপদগ্রস্ত বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত নারীদের মধ্যে দেখে অশেষ বিমোহিত হয়ে গেলেন। অশেষ প্রাণ থেকে তাঁদেরকে শ্রদ্ধা জানালেন। যানটি বৃষ্টির ধারা কেটে কেটে চলতে শুরু করলো গন্তব্যের উদ্দেশে।
(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন