অশেষ পানির বোতল ব্যাগে ঢুকিয়ে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ফালানদের ছোট নৌকার মতো ছাউনি দেওয়া ঘরটির দিকে হাঁটতে লাগলেন। ঘরটির সামনে এসে দেখলেন, একটি ছোট রিক্সার পরিত্যক্ত শিকলের সঙ্গে একটি মরিচা ধরা পুরোনো তালা ঝুলছে। তালা দিয়ে ঘরটি বন্ধ করা রয়েছে।

অশেষ এদিক-ওদিক তাকালেন। পাশের ঘর থেকে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়িয়ে এলেন একজন মধ্য বয়সী নারী। অশেষের কাছে এসে মহিলা জানতে চাইলেন,
-কাউরে খুঁজছেন বাপ-জান?
-জী মা, ফালানকে খুঁজছি। ফালানরা নেই?
-হেরা-তো গ্রামের বাড়ীতে চইল্লা গেছে। ফালানের বাবায় আইয়া, লইয়া গেছে হে-গোরে।

অশেষের ভিতরে একটা ঢেউ এসে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা দিলো। আসার সময় সমস্ত পথই ফালানকে নিয়ে  ভেবেছেন। তবে ফালান তাঁর বাবার কাছে ফিরে গেছেন, এটাও কম কিছু নয। এক ধরনের স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেলো।

মহিলাটি অশেষের চোখে মুখে চিন্তার রেখা দেখতে পেয়ে, বললেন,
-কিছু ভাবতাছেন বাপ-জান?
-জী-না, মা। আজকে খুব ভালো লাগছে। সেদিন ফালানকে দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আজকে আর সেই কষ্ট নেই।
-হ, বাপ-জান, ফালানের বাপে একটা বিয়া করছিলো। হের লাইগ্গা ফালানের মায়, রাগ কইরা ফালানরে লইয়া আামার কাছে আইছিলো। হে আমার বইন-ঝি লাগে। আমি এ-ই ঘরটা ভাড়া কইরা দিছিলাম। অনেক কাজ খুইজ্জা বেড়াইছে, পায় নাই।  কি এক রোগ আইলো দুনিয়ায়! বাসাবাড়িতেও কেউ কাজ দেয় না। কেউ কেউ আইয়া চাইল, ডাইল, তেল, এগুলান দিয়া যাইতো।  অনেক কষ্টে পুলাডারে লইয়া কোনরকমে মাথা গুইজ্জা পইরা আছিলো এইহানে।

মহিলাটি কথা শেষ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। মনে হলো, অনেক ভারী একটা পাথর বুকের ওপর থেকে নেমে গেলো। অশেষ বললেন,
-ফালানদের গ্রামের বাড়ী আপনি চেনেন?
-হ বাপ-জান, চিনি।
-আমাকে একদিন নিয়ে যাবেন সেখানে?
-যামু, বাপ-জান।  আপনি সময় কইরা আইয়েন। আমি আপনেরে নিয়া যামু।
-জী আচ্ছা।  আমি একদিন সময় করে আসবো।
-আইচ্ছা।

অশেষ দেখতে পেলেন, একটি তিন-চার বছরের মেয়ে শিশু মহিলাটিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ভুত দেখার মতো করে চুপিচুপি অশেষকে দেখছেন। অশেষ শিশুটিকে ডাকলেন। শিশুটি লজ্জা পেয়ে মহিলাটির পেছনে মুখ লুকালেন। অশেষ বললেন,
-এসো, আমার কাছে এসো। ভয় পেয়োছো? ভয় কি?
শিশুটি আরো বেশি করে নিজেকে আড়াল করতে চাইলেন। মহিলাটি, শিশুটিকে কোলো নিয়ে বললেন,
-সাহেব তরে ডাকতাছে। লজ্জা কি? যা, সাহেবের কাছে।
শিশুটি অশেষের কাছে এসে দাঁড়ালেন। অশেষ হাঁটু গেড়ে বসে শিশুটিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে  ধরলেন। শিশুটির গালে, কপালে চুমু দিলেন। অপ্রত্যাশিত স্নেহময় ভালোবাসা পেয়ে শিশুটিও অশেষের বুকের সঙ্গে মিশে থাকলেন। অশেষ শিশুটির পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমার নাম কি সোনামণি?
-টুনি।
-বাহ! খুব সুন্দর নাম তোমার!

ফালানের জন্য, অশেষ যে জিনিসগুলো কিনে এনেছিলেন, সেগুলো টুনির হাতে দিয়ে বললেন,
-এখানে যা কিছু আছে, তার সবকিছুই তোমার। না-ও, এটা ধরো।  অশেষ ব্যাগটা টুনির হাতে ধরিয়ে দিলেন। টুনি একটু লজ্জা পেলেও ভীষণ খুশি হয়েছেন, তা নিশ্চিত বোঝা গেলো। শিশুটির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক খেলা করছে। সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো টুনির নিষ্পাপ হাসি ভরা মুখটি দেখতে ভীষণ লাগলো অশেষের কাছে।

এক একটি শিশু যেনো, এক একটি ফেরেস্তা, পরী! শিশুদের কাছে এলে এক ধরনের বিশুদ্ধ শান্তিতে প্রাণ ভরে যায়। অশেষের অন্তরেও এক পশলা স্নিগ্ধ প্রশান্তির প্লাবন বয়ে যেতে থাকলো।

মহিলাটি বললেন,
-ও-আমার মাইয়ার ঘরের নাতিন।  ওর মায়ে গার্মেন্টস-এ কাম করে।  হারাদিন আমার কাছেই থাকে।  কোন জ্বালতন করে না। খুব শান্ত।

পৃথিবীর সকল শিশুদের মুখ যদি এমনি করে খুশির ঝিলিক দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারা যেতো? সবাই যদি তাদের প্রসারিত হাত, এ-ই সব অনাথ এবং সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য বাড়িয়ে দিতেন! তাহলে, আর যাই হোক, শিশুদের অন্তত কষ্ট ভরা মুখ দেখতে হতো না। শিশুদের বেদনার কালো মেঘের বিষাদে ঢেকে দেওয়া মুখ দেখতে ভালো লাগে না।  পৃথিবীর সব শিশুরাই হাসি-খুশিতে মেতে থাকবে। অশেষ প্রতিনিয়ত এমনটাই প্রত্যাশা করেন।

মহিলাটি, অশেষের এমন আন্তরিকতা দেখে বিস্মিত হলেন। আজ-কালকার যুগে এমন মানুষও আছেন! মহিলাটি বললেন,
-আপনি খুব ভালো বাপ-জান!
-আমার জন্য দোয়া করবেন মা।
-অনেক অনেক দোয়া আপনের লাইগ্গা বাপ-জান। আল্লায় আপনেরে অনেক অনেক বড়ো করবেন।
-জী, মা। আমি অনেক বড়ো হতে চাই না। এ-ই যে, আপনাদের পাশে থাকার ক্ষমতা থাকলেই চলবে।

অশেষ নোটবুক বের করে, মহিলার ঠিকানা লিখে নিলেন। আম্বিয়া খাতুন, গ্রামঃ বেহেত্তরী, ডাকঘর ও থানাঃ আঠারো বাড়ী, জেলাঃ ময়মনসিংহ। নিজের ঠিকানা সমেত একটি ছোট কাগজ এবং দুটি একশো টাকার নোট মহিলার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,
-এটা রাখুন মা। কখনো দরকার হলে আমাকে জানাবেন। কোনরকম দ্বিধা করবেন না। এতে আমার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লেখা আছে। যত্ন করে রাখবেন। নষ্ট বা হারিয়ে যেনো না যায়।
-আইচ্ছা, বাপ-জান।
-তাহলে আজকে যাই?
-যাওন নাই। আবার আইবেন।
-ঠিক আছে, আসবো।
মহিলা আঁচলে চোখ মুছলেন। বিদায় নিয়ে অশেষ, বাসায় ফেরার জন্য পথে পা বাড়ালেন।
(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন