মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। কল করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেব। অশেষের বুকের ভিতরে আচমকা অগ্নিগিরির অগ্নুৎপাত আরম্ভ হয়ে গেলো। কম্পিত হাতে মোবাইল ফোনটি কানের কাছে ধরে, যতটা আন্তরিকতা এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করা সম্ভব তার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। আপনি ভালো আছেন?
অপর প্রান্ত থেকে অশেষের সালামের জবাব না দিয়ে, কর্কশ কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
-তুমি কখন এসেছো?
– সকাল পোনে নয়টায় স্যার।
-পোনে নয়টায় কেন? তোমাকে না আমি সকাল আটটার আগে অফিসে আসতে বলেছি?
-জী স্যার।আমার অফিসের সময় তো সকাল সাড়ে নয়টায়। আমি, আমার সময়ের আগেই অফিসে এসেছি।
-এখন থেকে এসব চলবে না। তোমাকে সকাল আটটার আগেই অফিসে আসতে হবে।
-জী স্যার।তবে এখন তো কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সাধারণ ছুটি চলছে। সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পায়ে হেঁটে, ইঞ্জিন চালিতো রিক্সায় চড়ে অনেক কষ্ট করে আসতে হয়। পথে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী বাঁধা দেন। তাঁদের বুঝিয়ে এবং বিভিন্ন অসুবিধা থাকা স্বত্বেও আমি যথা সময়ে অফিসে আসি স্যার!
-এসব বলে তুমি আমাকে বোঝাতে পারবে না। তোমাকে সকাল আটটায়ই অফিসে আসতে হবে। নইলে তুমি জব ছেড়ে দাও। এটা আমার শেষ কথা। তুমি বুঝতে পারছো?
-জী স্যার। আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি ভালো থাকবেন।

অশেষ কোনরকমে মোবাইল ফোনটি টেবিলে রাখলেন। এ.সি. চলছে। তারপরও অশেষ ঘামে ভিজে যাচ্ছেন। প্রতিদিন একই রকমের নিপীড়ণ, অশেষ আর মেনে নিতে পারছেন না। কোন কথাই শুনছেন না ব্যবস্থাপণা পরিচালক সাহেব। প্রতিদিন সকালটা এভাবেই শুরু হয় অশেষের। এরপর কাজ আর কাজ। বিরতিহীন ব্যস্ততা। সব কিছু মিলিয়ে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে অশেষকে, কভিড-১৯ এঁর দুঃসময়ের প্রতিটিক্ষণ।

যখন সমস্ত পৃথিবীর মানুষ, একই কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সবাই যখন, যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব মানবিক হওয়ার প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি মানবিক হচ্ছেন। যখন সরকারী ভাবে সাধারণ ছুটি চলছে। গণপরিবহন এবং সকল প্রকারের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তখন একজন প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ার পরও এই করোনাকালীণ দুঃসময়ে অশেষের সঙ্গে তিনি কেন এতো অমানবিক আচরণ করছেন, তা অশেষের বোধগম্য নয়। এ কেমন নিষ্ঠুরতা! কেমন অমানবিকতা! অশেষের সঙ্গে তিনি এমন করবেন কেন? অশেষ, তাঁর কাজের স্বীকৃত স্বরূপ বেষ্ট ইমপ্লোইর এওয়ার্ড জিতেছেন। অথচ এই মহা ক্রান্তিলগ্নে অশেষকে প্রতিদিন অপমানে, অসন্মানে, ভেঙ্গে চুরমার হতে হচ্ছে। কিন্তু কেন?

অশেষ হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছেন। বাংলাদেশের শ্রম আইনের প্রায় সবকিছুই অশেষের জানা আছে। প্রতিষ্ঠান মালিক আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের শ্রম আইনকে অবজ্ঞা করে। অমান্য করে, নিজের মনগড়া, অনেকটা স্বেচ্ছাচারিতা করেই কারখানা পরিচালনা করছেন। তারপরও কোন শ্রমিকেরই প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। নেই সাহস। প্রতিবাদ মানেই চাকুরীচ্যুত হওয়া। চাকুরী হাড়ালে, জীবনের প্রয়োজন পূরণের সব কিছুই হাড়িয়ে যাবে। এসব মাথায় রেখেই কারখানা মালিকের করা যাবতীয় অন্যায়-অনাচার, সমস্ত শ্রমিকের মতো
অশেষকেও নিরবে মেনে নিতে হচ্ছে। না নিয়ে উপায় কি? কারখানা মালিকদের এই নিষ্ঠুর পৈশাচিক আচরণ করার ধৃষ্টতা কে দিয়েছেন? রাষ্ট্র দিয়েছেন?

অফিস থেকে ফিরে অশেষ পার্কের সেই বেঞ্চিতে এসে বসলেন। পকেট থেকে রুমাল বেড় করে মুখ মুছলেন। ব্যাগে পানির বোতল রয়েছে। পানি বেড় করে খেলেন। ফেরার পথে দোকান থেকে ফালানের জন্যে চকোলেট, রঙ পেন্সিলের বাক্স এবং কয়েকটি সুন্দর সুন্দর ছবি সম্বলিত শিশুদের বই কিনে এনেছেন। আজকে সেদিনের দেখা, সেই ফুটফুটে শিশু ফালানকে এগুলো দিবেন।

চলবে-

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন