কভিড-১৯ -এ আক্রান্ত মানুষগুলোর বেদনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আজকে আচমকা অফিসে একজন অটিজমে আক্রান্ত মধ্য বয়সী লোক প্রবেশ করে নিজের সম্পর্কে যা বললেন। তা দেখে এবং শূনে অশেষের প্রায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পরার উপক্রম হয়ে যাচ্ছিলো।
লোকটির বয়স চল্লিশের কিছুটা বেশি হতে পারে বা চল্লিশই হবে। ভালো করে কথা বলতে পারছিলেন না। তবুও তিনি যেটা বললেন তার মর্মার্থ হলো এই,
-আমি অসুস্থ না। আমার শরীরে যথেষ্ট শক্তি রয়েছে। আমি কাজ করতে পারবো। আমার বাড়ি নরশিংদী জেলার অজো পাড়া-গাঁয়ে। সংসারে ভীষণ অভাব। মা-বাবা, স্ত্রী ছেলে-মেয়েরা অভুক্ত রয়েছেন। আমি কাজ খুঁজছিলাম। পাচ্ছিলাম না। একজন অপরিচিত লোক কাজ দিবেন বলে গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায় এনে বসিয়ে রেখে চলে গেছেন। আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো। তা দিয়ে আমি কভিড-১৯-এর ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কিছু মাস্ক কিনেছি, বিক্রি করার জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে সেগুলো অফিসের সবার সামনে উপস্থাপন করলেন। লোকটির চোখ দিয়ে অশ্রুনদীর বান বয়ে যাচ্ছিলো। একটি হাত দিয়ে বার-বার তা মুছে বাঁধ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছিলেন।
অশেষের অফিসের একজন কর্মকর্তা উঠে এসে পকেট থেকে একটি একশত টাকার নোট বের করে লোকটির হাতে গুঁজে দিতেই লোকটি বললেন,
– আমি ভিক্ষুক না। আমি দান নিতে চাই না। আমাকে একটা কাজ যদি দিতেন। আমি যে কোন কাজ করতে পারবো। আমার শরীরে কাজ করার মতো যথেষ্ট শক্তি রয়েছে।
অশেষ কিছু একটা বলতে যেয়ে থেমে গেলেন। কেননা কভিড-১৯ এর কারণে জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জবটি অশেষ হারিয়েছেন। হারিয়েছেন এক জীবনের যাবতীয় সবকিছু। বর্তমান জবটির মাসিক বেতন ষোল হাজার টাকা মাত্র। প্রয়োজনের তুলনায় এই বেতন খুবই সামান্য। তবুও কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গেই করতে হচ্ছে। একটি ভালো জব পাওয়া এখন শুধু স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্নই বটে । অনেক খুঁজে খুঁজে এই কাজটি পেয়েছেন। প্রতিনিয়ত ভালো একটি কাজ খুঁজছেন। হয়তবা পাবেন বা পাবেন না। তবুও ভালো কিছু করার অদম্য প্রচেষ্টা থামিয়ে রাখেননি অশেষ। এই বিশাল জনসংখ্যার দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই অগণিত। সেখানে একজন শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থ মানুষ কি করে একটি ভালো কাজ পাবে? ভালো কাজ-তো দূরের বিষয় কাজই পাবেন কি করে? ততোক্ষণে একজন কর্মচারীকে দিয়ে আগত লোকটিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। লোকটির জন্য বাড়ীতে বেঁচে থাকার কতোটা রসদ রয়েছে, অশেষের তা জানা নেই। তারপরও অশেষ এই ভেবে মনে মনে স্বস্তি পেলেন যে, এই অসহায় লোকটি তার স্বজনদের কাছে পোঁছতে পারবেন, এ-ও কম কী!
পথ চলতে গেলে এখানে সেখানে বেওয়ারিশ কুকুর, বিড়ালও অভূক্ত পরে থাকতে দেখা যায়। অফিসের প্রাঙ্গণের ভেতরে একটি কুকুর এবং একটি বিড়াল বাস করেন। প্রাণী দু’টি অশেষকে দেখা মাত্রই এমন আচরণ করতে থাকেন, যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাঁরা বোবা। তাঁদের চাহনি দিয়ে এবং অভিব্যক্তি এমন ভাবে প্রকাশ করে যে, অশেষ নিশ্চিত ভাবেই বুঝতে পারে তাঁদের করুণ আর্তি। একটি ছোট্ট শিশু যেভাবে ক্ষুধা লাগলে খদ্যের জন্যে কান্না করে তার চাহিদার কথা জানান দেয়। ঠিক একই ভাবে এই কুকুর এবং বিড়ালটিও খাদ্যের জন্য অশেষের কাছে আকুল করা আকুতি জানায়।
অশেষ সামান্য একজন মানুষ। ইচ্ছার চেয়ে ক্ষমতা অনেকের চেয়েও অনেক কম। এছাড়াও মা-বাবা, ভাই-বোনহীন একজন অনাথ। তা-না হলে পৃথিবীর সমস্ত অভূক্ত প্রাণের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় করে দিতেন। পথের পাশের ছোট টং দোকান থেকে অল্প মূল্যের খাবার কিনে দেওয়া ছাড়া ক্ষুধার্ত অসহায় বোবা প্রাণী দু’টির জন্য অশেষ আর কিছুই করতে পারেন না।
দুদিন পূর্বেই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ছিলো। এটা সম্ভবত সমস্ত দূনিয়ার প্রেমিক যুগলদের জন্যই নির্ধারিত। এতো এতো ফুল এবং মূল্যবান উপহার সামগ্রী ক্রয়ে তাঁরা নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিলেন, যা বর্ণনা করার মতো ভাষা অশেষের জানা নেই। আর পথের পাশের অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, পথ শিশু ,বৃদ্ধ মা-বাবা ভালোবাসাহীন ভাবে বেঁচে আছেন অর্ধ-মৃতের মতো। তাঁদের জন্য কারোই কিছু করার নেই। যদি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, সমস্ত অভূক্ত অসহায় বোবা প্রানী, পথ শিশু, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ এবং বৃদ্ধ মা-বাবাদের জন্য হতো। তাহলে এঁর চেয়ে ভালো এবং মানবিক আর কিছুই হতে পারতো না। কিন্তু তা-কি কখনও হবে? বা হতে পারে?
এসব ভাবতে ভাবতে মনটা বেদনায় আরো ভারী হয়ে গেলো। রোজ এতগুলো প্রাণের, এতো এতো কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগে না। তবুও দেখতে হচ্ছে। এটাই এখন বাস্তবতা। একদিন হয়ত সুন্দর একটি দিন আসবে। সবাই তাঁদের প্রসারিত হাত দু’টি এসব অসহায় প্রাণের জন্য বাড়িয়ে দিবেন। সেই দিনটির জন্যই অশেষ অপেক্ষায় রয়েছেন। দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালেন। কাটাটি প্রায় রাত বারোটার কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে। এখন না ঘুমালে সকালে অফিসে যেতে দেরী হয়ে যাবে। আলো নিভিয়ে অশেষ ঘুমাতে চেষ্টা করতে থাকলেন।
(চলবে)
শ্রদ্ধেয় হাফিজুর রহমান ভাইয়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত মানুষ এবং প্রাণের বেদনার গল্প এটি। যদি এখন মানুষ বেশী বই পড়তে চায়না। তবুও আমি লিখছি, যারা পড়তে ভালোবাসেন তাঁদের জন্যে।