ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন অশেষ। সেদিনের দেখা হাসপাতালের নারীটির জন্য মনটা কেমন করছে। বুকের বাম পাশটা চিনচিন করছে। মানুষের এতো কষ্টের কছে নিজের কষ্টগুলো প্রতিক্ষণ চাপা পড়ে যাচ্ছে।
একদিন ঘর ভর্তি সুখ ছিলো। মা-বাবা, বোন আরও কতো কে ছিলো! কতো কিছু ছিলো! এখনতো কিছুই নেই। কেউ নেই। শুধুমাত্র নারানী অম্লান হয়ে আছে মনের ভীতরের অন্ধকার গহীনে। ড্রয়ার খুলে নারানীর লেখা চিঠিটা বের করলেন। বেশ কদিন হয়ে গেলো, অথচ নারানীর লেখা চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি। নারানীকে লেখা জরুরী। কি জানি, নারানী হয়তো প্রতিদিন ডাকপিয়নের কাছে আমার চিঠির খোঁজ নিচ্ছেন কি-না! চিঠি না পেয়ে হয়তো ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পরছেন। অশেষ আলো জ্বেলে টেবিলে বসে নারানীকে লিখতে শুরু করলেন।
১৪.০১.২০২২ইং
নারানী, তোর চিঠির জবাব দিতে দেরি হওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবেই দুঃখ প্রকাশ করছি। অফিসের কাজ এবং বিভিন্ন অযাচিত ঝামেলাই এই বিলম্বের কারণ। তুই ভালো আছিস জানি। এতো ভালো যার বর, তাঁর খারাপ থাকার মতো কোন কারণ থাকতে নেই। তুই যে প্রতিটি শিবরাত্রিতে, শিবের মাথায় জল ঢালতি ভক্তি এবং শ্রদ্ধা ভরে। এটা হয়ত সেই কর্মেরই ফল। দোয়া করি জন্ম-জন্মান্তর তোর মাথার সিঁদুর অক্ষয় থাকুক। ভালো থাকার জন্য মানুষের খুব বেশি কিছুর দরকার হয়না। নিখাঁদ ভালোবাসা এবং বিশ্বাস থাকলেই হয়। যা এখন খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমার বিশ্বাস এই বিশেষ দুটো জিনিস তোদের মধ্যে অঢেল রয়েছে এবং অনন্তকালের জন্য দীর্ঘায়িত হবে। সব সময় চেষ্টা করবি এটা ধরে রাখতে। তাহলে আর খুব বেশি কিছুর দরকার হবেনা।
কতোদিন হয়ে গেলো তোঁদের সঙ্গে দেখা নেই। মা মারা যাওয়ার পর ভীষণ একলা হয়ে গেছি। একদিন যাঁদের খুব আপন ভেবেছি, তাঁরা আসলে কেউই আমার আপনার কেউ নয়। কতো চেনা মুখ! কতো প্রিয় মুখ! কোথায় হাড়ালো, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। মানুষ এখন মূল্যায়িত হয় শুধুমাত্র অর্থ বিত্তবৈভবের দ্বারা। যাবতীয় সবকিছুই এসবের কাছে মূল্যহীন।
কাগজের কিছু বান্ডিল ভর্তি
টাকার কাছে মানুষের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-আনন্দ এবং ভালোবাসাগুলো খুবই অসহায়। মানুষ বড়ো অসহায়। আর সমস্ত মানুষের সঙ্গে আমিও অসহায় হয়ে গেছি। এই কাগুজে টাকার ক্ষমতা সম্পর্কে বলার জন্য আমি একজন সামান্য মানুষ। তবে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে, টাকাই সব এবং সব ক্ষমতার কেন্দ্রীয় উপকরণ।
গ্রামে যখন বেড়াতে গিয়েছি। তোর সঙ্গে আমার ছেলেবেলায় কাটানো মুহূর্তগুলোই আমার কাছে টাকার চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান মনে হয়েছে। তখন হয়তো পার্থিব এসব কিছুর মূল্য বোঝার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে আজও সেইসব দিনই আমার কাছে অশেষ মূল্যবান এবং এখন পর্যন্ত তেমনই রয়ে গেছে। থাকবে চিরন্তন হয়ে।
তোর মনে আছে, একবার আমরা পদ্মায় গোসল করতে গিয়েছিলাম? সেদিন আমাদের সঙ্গে আরো অনেকেই ছিলেন। প্রমত্ত পদ্মা, পদ্মার পাড়ের মানুষের সারল্যে ভরা জীবন। গাঁয়ের মেয়েরা গোসল সেরে মাটির কলসিতে করে পানি নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলো? সত্যিই সবকিছুই মনোমুগ্ধকর ছিলো! আমরা কতো কি করে সময় কাটিয়েছি! গামছায় ছেঁকে ছোট মাছ ধরেছি। পদ্মার ঘোলা পানিতে সাঁতার কেটে কেটে চোখ দুটি রক্ত জবার মতো লাল করে ফেলেছি। তবুও ক্লান্তি আসেনি। আর গ্রামের প্রতিটি মানুষই যেনো সত্যিকারের মানুষ ছিলো। হয়তো এখনও রয়ে গেছে। আমার-তো আর যাওয়া হয়নি গ্রামে। আর হবে কিনা জানিনা। তবে আমি সারাটাদিন, সারাটারাত পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কায় হারিয়ে যাওয়া সেই সময়ের, সেই দিনগুলোর জন্যই প্রতিক্ষায় বসে থাকি। আমার জন্য গাঁয়ের সেই দিনগুলোই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কিছু ছিলো। আজও শ্রেষ্ঠতম রয়ে গেছে। আমি এখনও অবসরে গাঁয়ের মেঠো পথ। সবুজ দীগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। নির্মল বিশুদ্ধ বাতাস আর পাখির কূজনের মায়াজালে হাড়িয়ে যাই। কি-যে ভালো লাগে তা, বলে বোঝানোর মতো নয়!
তোকে আবল-তাবল অনেক কিছু লিখে ফেলেছি। হাসবি না কিন্তুু! বেশ রাত হয়েছে। ঘুম পাচ্ছে। তোর বরকে আমার শুভকামনা দিবি। তোর শাশুড়ি মায়ের জন্য রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম। ভালো থাকবি সব সময়। আমার জন্য দোয়া করবি। আর কিছু না হতে পারি, অনন্ত ভালো মানুষ যেনো হতে পারি। আমার কাছে থেকে একজন মানুষও যেনো কখনও কোন কষ্ট না পান। চিঠি পেয়ে জবাব লিখবি। আমি প্রতীক্ষায় থাকবো।
তোর শৈশবের খেলার সাথী,
অশেষ,
চান্দনা চৌরাস্তা,
গাজীপুর।
(চলবে)
শ্রদ্ধেয় হাফিজুর রহমান ভাইয়ের কাছে আমার ক্রিতজ্ঞতার শেষ নেই। পরবাসী ব্লগ পত্রিকায় আমাকে সাহিত্য পাতায় লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং আমি খুঁজে পেয়েছি একটি প্রশান্তিময় আশ্রয়। যদিও বই পড়ার পাঠকের সংখ্যা এখন খুবই কম। তবুও এঁর পরিবর্তন হবে ইনশাআল্লাহ্। আমার শ্রদ্ধেয় বোন ফারজানা নাজ শম্পা আপার কাছেও আমিও অশেষ কৃতজ্ঞ।