মায়ের মৃত্যুর পর সবকিছু যেন সাহারা মরুভূমির মতো হ’য়ে গেছে। চারপাশ শূন্যতায় ঢেকে আছে। অহর্নিশি মায়ের মুখচ্ছবি। মা- হীন এ- জীবন বয়ে বেড়ানো বড়ো বেদনার।

কতোদিন হয়ে গেলো চিঠির বাক্স খোলা হয়নি। নারানী ছাড়া আর কেউ অবশ্য লেখার মতো নেই। আর এই ইন্টারনেটের যুগে চিঠি লেখার সময় কোথায়! নারানী বরাবরই বলতো,
-অশেষ দা, তুমি আমাকে বড়ো বড়ো চিঠি লিখবে। কাগজে লেখা চিঠির চেয়ে মন ভরানোর আর কোন উপাদান আছে কিনা আমার জানা নেই। চিঠি পড়ার সময় যিনি লেখেন তাঁর স্পর্শ অনুভূত হয় প্রাণের গভীরে। প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি নিখাঁদ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

বাক্স খুলে একটি চিঠির খাম পাওয়া গেলো। নারানীই লিখেছেন। অশেষ খামটির এক প্রান্ত খুব সাবধানে খুলে চিঠিটা পড়তে লাগলেন।

তাং ০৫.১০.২০২১ইং

অশেষ দা, প্রনাম নিও। মাসিমা ইহলোক ছেড়ে ওপারে চলে গেছেন। যদিও এটাই চিরন্তন। তবুও এখন পর্যন্ত আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, মাসিমা নেই। এ-তো ভালো একজন মা ছিলেন তিনি। প্রকৃত ধার্মিক ছিলেন। কুসংস্কার কখনোই মাসিমাকে ছুঁতে পারেননি। তোমার মনের অবস্থা আমি শুধু উপলব্ধিই করতে পারছিনা তোমার মতো আমার ভেতরেও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তোমাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা আমার জানা নেই। তবুও তোমাকে ভুলে গেলে চলবেনা যে, বেঁচে থাকাটাই হচ্চে পার্থিব। আর মৃত্যুই হচ্ছে চিরন্তন। একদিন আমাদের সব্বাইকেই এই অল্প দিনের পৃথিবী ছেড়ে যেতেই হবে।

তুমি মনে রেখো মাসিমা তোমার নিজের মা না হলেও তিনিই ছিলেন তোমার সত্যিকারের মা। পেটে না ধরেও একজন খাঁটি মা কিভাবে হওয়া যায়, তা আমি মাসিমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কাগুজে সার্টিফিকেট হয়তো মাসিমার ছিলোনা। কিন্তু মাসিমা ছিলেন, আসল সুশিক্ষিত একজন মানুষ। কোনটা রেখে কোনটা বলবো বুঝতে পারছিনা। মাসিমার প্রতিটি আচরণই ছিল যথার্থ একজন মানুষের মতো। আর তুমি দীর্ঘ সময় এমন একজন মায়ের স্নেহ মমতা পেয়েছো সর্বোক্ষণ। এরচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর কিছু কি হতে পারে? পারেনা। নামাজ পড়ে মাসিমার জন্য দোয়া করবে, সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই মাসিমাকে উত্তম স্থানে রেখেছেন।

চোখের পানিতে বুক ভিজবে চিরকালই। তবুও বেঁচে থাকার জন্য এই শোক কাটিয়ে উঠতে হবে। নইলে একজীবন তুমি পারি দিবে কেমন করে! ভুলে থাকতে বলবোনা। কারণ মাসিমাকে ভুলে থাকা সত্যিই অসম্ভব। তবুও তুমি ভালো থাকবে। সময় মতো খাবে আর ভালো থাকতে চেষ্টা করবে। মাসিমা সবসময়,
-নারানী, সবসময় চেষ্টা করবি ভালো মানুষ হতে। একজন ভালো মানুষের বিকল্প আর কিছুই নেই। আর কখনও যেন, তোর কোন প্রকার আচরণে কেউ যেন কষ্ট না পায়। মানুষের অন্তরে ব্যাথা দেওয়া অনেক বড়ো পাপ। শুধুমাত্র নিখাদ ভালোবাসাই পারে সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে।

মাসিমার কথাগুলো এখনও পিয়ানোর মোলায়েম সুরের মতো আমার চাশপাশে ঘুরপাক খায়। তিনি আমার মা ছিলেননা ঠিকই, তবে মায়ের চেয়েও কোন দিক দিয়ে কম ছিলেননা। অনেক অনেক দোয়া এবং প্রনাম মাসিমার জন্য।

তোমার জন্য অফুরন্ত শুভকামনা এবং ভালোবাসা থাকলো। চিঠি পেলে জবাব দিবে। আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবো।

নারানী
কুমার ভোগ, লৌহজং,
মুন্সিগঞ্জ।

(চলবে)।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন