আকাশে একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। দেখে ভালো লাগার কথা। কিন্তুু তা লাগলোনা। চারপাশটা দেখে মনে হচ্ছে শোকের শহর।
কভিড-১৯, দীর্ঘ দিন ধরে তাদের ধরণ পরিবর্তন করে পর্যায়ক্রমে আরো বেশি ধ্বংসাত্মক হ’য়ে উঠছে। সেই সঙ্গে চক্রাকারে ঘুরছে লকডাউনও। খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের জীবন দিনকে দিন অনিশ্চিত পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কতোদিন হ’য়ে গেলো, অথচ পৃথিবীর মানুষ কোন ভাবেই কভিড-১৯’ কে মোকাবেলা করতে পারছেন না! এ-ই ভয়াবহতা আর কতোদিন চলবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারবেন! তারপরও ক্ষুদ্র অথচ ভয়ানক এই মরনঘাতি ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের লড়াই বিরতিহীন ভাবে অব্যাহত রয়েছে।
অশেষ টিভির সুইচ অন করলেন। একটি চ্যানেলে সরাসরি খবর প্রচারিত হচ্ছে। সেদিকে তাকানো মাত্রই সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে রক্ত চলাচল বন্ধ হ’য়ে যাবে এখনই। একটি স্বনামধন্য ফুড ও বেভারেজ কারখানা আগুনে দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আটকা পড়েছে অসংখ্য নারী এবং শিশু শ্রমিক।
ফায়ার সার্ভিসের আঠারটি টিম একসঙ্গে প্রানান্ত চেষ্টা করছেন আগুন নেভাতে। কিন্তুু আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। কুন্ডলী পাকানো কালো রঙের ধোঁয়া জানান দিচ্ছে, ধ্বংসই তার আজকের এই জ্বলে ওঠা। সাদা রঙের লাশবাহী গড়ীতে, লাশের ব্যাগে জড়িয়ে অসংখ্য নারী এবং শিশুদের পুড়ে যাওয়া কয়লাসম শব দেহগুলো রাখতে ব্যস্ত রয়েছেন উদ্ধার কর্মীদের একাংশ।
আগুন লাগার খবর পেয়ে আশেপাশের মানুষজন এবং আটকে পড়া শ্রমিকদের স্বজনেরা ভিড় করেছেন কারখানাটির মূল ফটকের কাছাকাছি। স্বজনদের আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ করা বিলাপে গভীরভাবে বেদনাবিধুর করে তুলছে চারপাশের পরিবেশকে।
একটি দশ এগারো বছরের বালক, হাতে একজন নারী শ্রমিকের ছবি ধরে, চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন,
-আমার মায়রে আইন্না দেন। অহনও আমার মায় বাড়িত যায় নাই। আমার ছোট বইনডা মায় না গেলে খায়না। হেয় না খাইয়া রইছে। মায়রে ছাড়া আমরা বাঁচুমনা। মায়রে খুইজ্জা দেন। মাগো,তুমি কই আছো? ফিরা আহো! ফিরা আহো!
আরেকজন মাঝবয়সী লোক, অনবরত ক্রন্দন করছেন আর বলছেন,
-আমার দুইডা মাইয়া আর একটা পোলা ওইহানে আটকা পড়ছে। হেগোরে বাঁচান। আপনেগো পায়ে ধরি। হেগোরে ছাড়া আমি ফিরুমনা। হেগোরে আইন্না দেন। হেরা তিনজনেই না খাইয়া কামে আাইছিলো। হেগোরে আইন্না দেন! হেগোরে আইন্না দেন!
অন্য একজন অল্প বয়সী লোক বলছেন,
-আমার বউডায় দুধের মাইয়াডারে থুইয়া কামে আইছে। মাইয়াডা গতকাইল থিক্কা না খাইয়া রইছে। দুধ খাইতে না পাইয়া মাইয়াডায় খালি কানতাছে। আমার বউডারে খুইজ্জা দেন। নইলে আমার দুধের মাইয়াডা না- খাইয়া মইরা যাইবো। আমি অহন কি করুমরে আল্লাহ! আপনেরা কইয়া দেন! আমি অহন কি করুম?
একজন বৃদ্ধা বুক থাপড়াচ্ছেন আর বলছেন,
-আমার পোলাডারে না- পাইলে, হের একটা হাড্ডি আমারে আইন্না দেন। তবুও আমি শান্তনা পামু। বাপজানগো তুমি কই আছো? তোমারে ছাড়া আমি ঘরে ফিরুমনা বাপজান! তুমি ফিরা আহো!
কভিড-১৯ এর প্রকোপ ঠেকাতে কঠোর লকডাউন এবং শাটডাউন চলছিলো। সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনিয়মতান্রিক ভাবে সম্পদ লোভী এবং পুঁজিপতি কারখানার মালিক, কারখানা চালু রেখেছেন । এ-সব দেখভাল করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থাকা সত্বেও এমন বিভৎস ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বারবার। কিন্তুু কেন?
আপন দায়িত্বে নিয়োজিত একজন সাংবাদিক সরাসরি দেখাচ্ছিলেন অনুষ্ঠানটি। ভেতরের অবস্থা দেখেই অনুমেয় যে এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক কতোটা অনিয়ম করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন! তারপরও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলছেন,
এর দায় আমার না এবং এই দায় আমি নিবো না। এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। দুর্ঘটনার জন্য কেউই দায়ী থাকেননা। দুর্ঘটনা যে কোন সময় এবং যে কোন কারখানাতেই হতে পারে।
অশেষ টিভির সুইচ অফ করে দিলেন। এ-সব দেখতে আর ভালো লাগেনা। আগুনের লেলিহান শিখা, উদ্ধার কর্মীদের নিরলস লড়াই এবং স্বজনদের কষ্টগুলো যেনো অশেষের মধ্যেও হতে থাকলো। রক্তগুলো হিম হয়ে যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছে বুকের ভেতরে। চোখ বন্ধ করে সোফাতেই এলিয়ে পড়লেন।
( চলবে)
পরবাসী ব্লগ, শ্রদ্ধেয় হাফিজুর রহমান ভাই এবং ফারজানা নাজ শম্পা এঁদের কাছে আমি আজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ। আর আমার লেখার পাঠকেরাই হচ্ছেন আমার লেখার একমাত্র উপকরণ। পরবাসী ব্লগ পত্রিকার সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে আছেন, তাদের জন্য অবিরল ভালোবাসাতো আছেই। তোমাকে অভিবাদন পুরবাসী ব্লগ ডট কম।