একটি টোপলার কাহিনী
—————
রুপা তার প্রিয় বান্ধবী নীলুর সাথে ফোনে কথা বলার পরে একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়লো। সেলফোন হাতে নিয়ে হতবম্ব হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। মানুষ এত অতভুত হয় কি করে! রুপা ফোনে ইনিয়ে বিনিয়ে জানিয়ে দিলো তার লাগেজে মোটেই জায়গা নেই । তাদের নিজেদের জিনিসপত্র দিয়ে লাগেজ ভোরে গিয়েছে । তার উপর আবার, স্বামীর এক বন্ধু তার বাবার জন্য কি সব ব্যাথার ঔষুধ, কোলেস্টোরল কমানের ঔষুধ পত্র সহ একটি ছোট ব্যাগ দিয়ে গেছে, আরেক বন্ধু আবার তার মায়ের জন্য ডায়পার আর ব্লাড প্রেসার মাপার মেশিন দিয়েছে, তার বেজমেন্টের বাংলাদেশী টেনেন্ট তার মায়ের ইউরিন ইনফেকশনের জন্য ক্রানবেরির জুসের একটি ঢাউস সাইজের যার দিয়েছে, এসব কিছু মিলে লাগেজ একেবারে টইটুম্বুর অবস্থা, তাই দেশে যাওয়ার সময় রুপার টোপলা সে কিছুতেই নিতে পারবে না।

অথচ, শুরুর দিকে কিন্তু এরকম কথা ছিল না। নীলু আগবাড়িয়েই ফোন করে বলেছিলো, ‘রুপা, আমরা সামনের মাসে সাত তারিখে দেশে যাচ্ছি, দেশে পাঠানোর জন্য তুই যদি কিছু দিতে চাস টাস, তোর জন্য দুই কেজি পরিমান বরাদ্দ থাকলো।’

রুপা ফোন পেয়েই দেশে মা রাবেয়া খাতুনকে বলে দিলো, ‘ মা, তোমাদের কার কি লাগবে, মন্টুকে বোলো আমাকে ছোটোখাটো একটি লিষ্ট পাঠাতে, আমার এক বান্ধবী সামনের মাসে দেশে যাচ্ছে। রুপা ফোন পেয়ে দেশে রুপার পরিবারের সবাই নিজ নিজ জিনিসপত্রের লিষ্ট তৈরী নিয়ে মহা ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। শনিবার রাতের এসার নামাজের পরে রূপকে পাঠানো লিষ্টের ফাইনাল করার জন্য জরুরি মিটিং বসানো হলো। রুপার নিরিহ টাইপের বাবা জনাব শমসের উদ্দিন সাহেব জানালেন, ‘ রুপাদের ঠান্ডার দেশ, ওখানে শীতের জন্য সুন্দর সুন্দর সব লেপ/কম্বল পাওয়া যায়, আমাদের জন্য একটি ভালো লেপ টাইপের কিছু পাঠাতে বল। দিন দিন যা ঠান্ডা পড়ছে মনে হচ্ছে যেন এন্টারটিকায় আছি, পেংগুইন পাখিদের সাথে খেলা ধুলা করছি’। শমসের উদ্দিনের কথা শেষ না হতেই স্ত্রী রাবিয়া খাতুন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,’তোমার আক্কেল সাক্কেল কি কোনো দিনই হবে না, আমাদের মেয়ে কি নিজে আসছে? ও অন্য মানুষের হাতে তোমার জন্য লেপ পাঠাবে, এ কেমন বেকুবের মতো কথা বলছো? শমসের সাহেব কাচুমাচু করে বললেন, ‘তাইতো, আমি সেটা ভেবে বলিনি, তার চেয়ে বরং কিছু ফ্রেস ফল/টল পাঠাক, আমাদের এখানে তো আবার সব বিষ দেয়া ফল বিক্রি করে।’ সেজো বোন তুলি জানালো ‘আমার কোনো ভালো হ্যান্ড ব্যাগ নেই, আমার জন্য গুচি ব্রান্ডের মেয়েদের হ্যান্ড ব্যাগ পাঠাতে বল।’। বড় ভাই সেলিম জানালো এবার তার জন্য কোনো আফটার সেভ/টেভ বা রেজার/ফেজার পাঠানো চলবে না, তার জন্য একটি লেটেস্ট মডেলের মোবাইল ফোন পাঠাতে হবে। যমজ বোন চিনু/মিনু জানালো তাদের জন্য যেন কোনো ডলার স্টোর থেকে না কিনে একেবারে ভালো দোকান থেকে রেভলন ব্রান্ডের লিপস্টিক, দামি ব্রান্ডের শ্যাম্পু ও ময়েশ্চরাইজিং ক্রিম পাঠানো হয়। মা রাবেয়া খাতুন মিন মিন করে বললেন , ‘একবার রুপা ছোট ছোট প্যাকেট করা ফলের গুড়ার সাথে মেশানো ওটমিল পাঠিয়ে ছিল, অরকম কিছু প্যাকেট পাঠাতে বলিস।’ তোর বাবার কোষ্টকাঠিন্নের সমস্যা। সকালে অটমিল খেলে খুব কাজে দেয়। এসব শুনে মন্টু গম্ভীর হয়ে বললো, তোমরা কি জানো রুপা আপা বলেছে লিস্ট এমন হতে হবে সব মিলে যেন কিছুতেই দুই কেজির বেশি না হয়। আমি সহ সবাই আমরা ছয় জন। দুই কেজি মানে হচ্ছে, দুই হাজার গ্রাম, এখন, একে ছয় দিয়ে ভাগ দিলে মাথাপিছু পরে ৩০০ গ্রামের কিছু বেশি।’

যাহোক, এদিক ওদিক করে মন্টু রুপার কাছে ফাইনাল লিষ্ট পাঠিয়েছিল। রুপা আবার কাটছাট করে এবং নতুন করে কিছু আইটেম যেমন মাল্টি ভিটামিন, বাবার জন্য ছোট এক বয়াম কফি ইত্যাদি মিলে একটি টোপলা তৈরী করে স্কচ টেপ দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে আকারে কিছুটা ছোট বানিয়ে ওজন করে দেখলো দুই কেজি থেকে সামান্য কিছু কম হয়। রুপা ইচ্ছা করলে কিছু চকলেট/টকলেটও দিতে পারতো, কিন্তু নীলু আবার কি মনে করে সেটা ভেবে আর দেয়নি। রুপা দেশে ফোন করে আবার কনফার্ম করেছিল কার জন্য কি পাঠিয়েছে। কিন্তু নীলুর এক ফোনে সব উল্টা/পাল্টা হয়ে গেলো।

ওদিকে নীলু বেচার আরো খারাপ অবস্থা। তার স্বামী যে তার সাথে এমন ছোটলোকি করবে সে ভাবতেও পারেনি। একেবারে মুখের উপর সাফসুফ জানিয়ে দিলো ‘দেখো, আমাদের লাগেজ কিন্তু একেবারে ফুল, পুরা লাগেজে একছটাক জায়গাও নেই, আমি কিন্তু আর কোনোকিছু লাগেজে ভরতে পারবোনা, তোমার বান্ধবীকে জানিয়ে দাও, এবারের মতো মাফ চাই। স্বামীর কোথায় নীলু একেবারে কেঁদেই ফেললো।

নীলুরা এবার দেশে যাচ্ছে প্রায় বছর সাতেক পরে। ছোট ভাই মজনুর বিয়ে। বিয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা অনেকদিন থেকে করে রেখেছিলো। নীলুরা যে শুধু বিয়ে খেতেই যাচ্ছে, ঠিক তা না, নীলুর বাবার অনেক বয়স হয়েছে। শরীর বার্ধক্যজনিত অনেক কারণে একেবারে যায় যায় অবস্থা। নীলুর বাবার ইচ্ছা তার মারা যাওয়ার আগে ছেলেকে বিয়ে দেয়া এবং তার জায়গা জমি যা আছে সব লেখা পড়া করে সবার মাঝে বন্টন করে দেয়া। ইত্যাদি কারণে নীলুরা এই কোভিড মহামারীর মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে দেশে যাচ্ছে। সম্পত্তির লোভ মানুষকে ঝুঁকি নিতে শেখায়। সুতরাং নিলুরা দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।এতদিন পরে দেশে যাচ্ছে, তার উপর আবার বিয়ে বাড়ির কেনা কাটায় লাগেজের অবস্থা আসলেই ঠাসাঠাসি।

নীলু বুদ্ধি করে একটি শেষ চেষ্টা করলো। তার গোপন তহবিল থেকে একটি একশত ডলারের নোট বের করে স্বামীর হাতে দিয়ে বললো, ‘এই, আমরাতো কাতার এয়ার ওয়েজে যাচ্ছি, শুনেছি, ওদের কাউন্টারে কিছু এক্সট্রা পেমেন্ট করলে বাড়তি লাগেজ এলাও করে, আমার বান্ধবীর জন্য এটা কর না প্লিজ।’ ফলাফল আরো উল্টা হলো। নীলুর স্বামী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে চিৎকার করে বললো, ‘তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো ? এমনি এতো টাকা/পয়সা দিয়ে টিকেট কাটা হয়েছে, তার উপর আবার বিয়ের বাজার, ব্যাংকের চেকিং একাউন্ট অলরেডি মাইনাস, ক্রেডিট কার্ডের উপর চলছি, ক্রেডিট কার্ড আলারা তো আমার শশুর হয় না যে সব বিল টিল মাফ করে দিবে, দেশ থেকে এসে এতো এতো টাকা বিল কিভাবে দিবো কিছু হুস ভুস আছে ?’

অগত্যা নীলুর কান্নাকাটির চাপে স্বামীকে ঢেঁকি গিলতে হলো, নীলুর হাত থেকে ছোঁ মেরে টাকা নিয়ে বললো, যাও তোমার বান্ধবীকে বল তার টোপলা নিয়ে আসতে।’ স্বামীর মুখে অনুমতি পায়ে নিলু আনন্দে একেবারে আত্মহারা। একলাফে ফোন হাতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ রুপাকে পর পর দুই বার ফোন করলো, কিন্তু রুপার ফোন দুইবারিই বন্ধ পেলো। প্রায় ঘন্টা খানিক বিরতি দিয়ে আবারো ফোন করলো।
-‘রুপা, হ্যাভি খুশির খবর আছে , তুই শিগগিরই দেশে পাঠানোর তোর টোপলা নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে আয়। তোর ভাই মত দিয়েছে। বুঝিসিতো, দেশে যাওয়ার সময় কত কিছু সামলাতে হয়, মাথা/টাথা সবসময় ঠিক থাকে নারে, কি বলতে কি বোলেছি। সব কথা বাদ দে। দেশে কি পাঠাবি নিয়ে এক্ষুনি চলে আয় বোন আমার।’

রুপা রাগী গলায় ওদিক থেকে বললো:
‘তোকে আর ন্যাকামি করতে হবে না। তোর ফোন পেয়ে আমার বর অলরেডি কানাডা পোষ্টে যেয়ে আমার টোপলা কারটুনের বক্সে ভরে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। তোকে আমার জন্য আর কষ্ট করতে হবে নারে। তুই আসলেই অনেক চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিস। কি করে কথা দিয়ে আবার কত সহজেই ঘুরিয়ে নিলি। আসলে, আমারিই ভুল। তোকে ঠিক চিনতে পারিনি।’ কথা গুলি বোলতে যেয়ে রুপার কিছুটা গলা ধরে এলো। ফোন রেখে সরাসরি ওয়াস রুমে দজা বন্ধ কোরে হাউমাউ কোরে কাদঁতে লাগলো।

ওদিকে নিলু বেচারারও একি অবস্থা। স্বামীকে সব বলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো অঝোর ধারায় কাঁদছে। জানুয়ারি মাস অথচ, টরেন্টোতে তেমন ঠান্ডা নেই। তাপমাত্রা এমনকি প্লাসে চলছে । অন্য বছর হলে লোকজন সব রাস্তা ঘাটে শপিংমলে, কফি শপে দাপিয়ে বেড়াতো। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কোভিড -১৯ এর কারনে এবার আর তা হবার উপায় নেই। নীলুর আর রুপার কান্নার শব্দাবলী তাই মুক্ত বাতাসে ইথারে ইথারে  তরঙ্গায়িত না হয়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে আবদ্ধ হয়েই থাকলো।

________________

প্রবাসে হরেকরকম চ্যালেঞ্জ এর মধ্যে অভিবাসীদের থাকতে হয়। একেকটি মানুষের সাথে আরেকটি মানুষের সুখ/দুখ হাসি কান্না একেবারে গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকে। তাই, ভাল/,মন্দ সব ভাগাভাগি করে অনেক দোষ /গুন মানিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কিন্তু একটি সামান্য টোপলা বা আমাদের সামান্য কিছু ভুল ভ্রান্তি অনেক সময় আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আপন মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে আমাদেরকে নিলু বা রুপাদের মত ভিতরে ভিতরে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠতে হয়। আমাদের মধ্যে অনেকে আবার কাঁদতে না পেরে নিজেদেরকে ডিপ্রেশনের রুগী বানিয়ে ফেলে। অথচ, আমরা কি একটু সজাগ হয়ে সচেতন হয়ে আমাদের নিজেদের এসব ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারিনা???

দেশ থেকে ফিরে এসে নিলু আর আর রুপাদের সম্পর্কের কি হোলো সেটা আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট না। তারচেয়ে বরং চলুন নিজের নিজের যায়গায় থেকে নিজেদেরকে উপরের প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার জন্যে নিজেদেরকে শুধরিয়ে সবার সাথে মিলেমিশে এই বিদেশ বিভুঁয়ে চলাফেরা করি।

———–

জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, জানুয়ারি ২০২১

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্বিতীয় সারি কর্ণার চেয়ার
পরবর্তী নিবন্ধবিরহী কুহু
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন