বাইরে মেঘের গর্জন, বিজলির ক্ষণে ক্ষনে আকাশ চেরা ঝলকানি, পলিথিনের উপরে বড় বড় বৃষ্টি ফোঁটার শব্দ, প্রতি মুহুর্তে মনে হয় এই বুঝি পলিথিন ছিঁড়ে সবসুদ্ধ গায়ের উপর এসে পড়বে। পলিথিন না পড়লেও, বৃষ্টির ছাঁট এসে সব ভিজিয়ে দিচ্ছে । বাইরে শোঁ শোঁ বাতাস, গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা।
দুচোখ বন্ধ করে নিথর হয়ে শুয়ে আছে পারুলি। সামান্য নড়াচড়াও করে না সে। আগে সে নড়তো, পাশ ফিরতো, ডঃ এর কথা মত উঠে বসার চেস্টা করত, গত ১৫/২০ দিন আগে যখন সে – সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারল, তখন থেকে আর সে কোন কিছুই করে না । ইচ্ছে করেই সে নড়ে না, চড়ে না, কথা বলে না এমনকি মশা, মাছি, পিপড়া কিছুই আর তাড়ায় না। এমন কি শরীরের কোথাও চুলকালে সে হাত নাড়িয়ে চুলকায়ও না। আশ্চার্য আজকাল আর কোথাও চুলকায়ও না, ব্যথা মনে হয় করে কিন্তু সেও আর আমলে নেয় না পারুলি। পুরো শরীর কাটা কলা গাছের মত, মাছি ভনভন করা মরা মানুষের মত মাটিতে বিছানো পলিথিনে নিথর হয়ে পরে থাকে।
মাথার মাত্র ৩/৪ হাত উপরে পলিথিন, শরীরের নিচেও ছেঁড়া পলিথিন। কিছুদিন আগে একটা চাঁটাই ছিল, চাঁটাইয়ের উপরে কাঁথা বিছানো ছিল, পরে সব কিছু এত নোংড়া আর দুর্গন্ধময় হয়ে গিয়েছিল যে, পাশের ঝুপড়ির সালমা খালারে অনুরোধ করে, বলে কয়ে, সব ফেলে দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়েছে। এই ভাবে সালমা খালা কয়েকবার সব কিছু পরিষ্কার করে দিয়েছে। ওই খালাই মাঝে মধ্যে খাবার টাবার দেয়, টাকা নিয়ে ওষুধ- টষুধ এনে দেয়। পারুলির মেয়েটারেও খালা দেখে শুনে রাখে।
খালা সাহেবদের বাসায় কাম কাজ করে যা খাবার টাবার আনে, পারুলির মেয়েটারে দিয়ে থুয়ে নিজে খায় পারুলিকেও দেয়। আগে পারুলি খেত, এখন আর হাজার বলে কয়েও সালমা খালা ওকে খাওয়াতে পারে না।
সালমা খাতুন কত গজগজ করে-
-না খালি পরে শইল বালা হইব ক্যামনে ? শইলে শক্তি পাবি কোনথন ? ডাঃ সাব না তরে বেশি বেশি খাইতে কইছে, সুস্থ্য হবার জন্যি খাওন দরকার, এই খাওনের লাইগাই দ্যাশ গেরাম, আপনজন ছাইড়া এই ঢাহা শহরে আইছিরে… ওই পারুলি, নে এট্টু মুখে দেরে মা, কতা শোন এই মাইয়া কতা না শুনলে আমি আর কি কইতাম …।
আগে পারুলি উঠত, সামান্য একটু খেত, আজকাল আর কথাই শোনেনা । আগের মত ‘খাব না খালা’, ‘আইচ্ছা তুমি থুইয়া দাও পরে খামুনে’, বা ‘খালা একদম খাতি ইচ্চে করে না’ – এসব কিছুই বলেনা। খালাও আজকাল প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে । আর কাঁহাতক, বছর ঘুড়ে এল- নিত্য মরার কান্দে কে! এই বেরামিরে টানে কে!
মাইনকা হকার সাত সকালে সকলের দুয়ারে পেপার বিলি করে সে সেদিন সকালে চিৎকার করে – অই পাল্লু আফা- তোমাগো ফুটাফুটির আজ পুরা এক বছর হইল। আবার তোমরা টেহাটুহা পাইবা। সাম্বাদিকরা আবার তোমাগো ফটু তুলবে, পেপারে ফটু দিব… তোমাগোরেই দিন আফা… হালার বোম ফুটাও বালা…
পারুলি গত একমাস ধরে কথা বলে না, নড়েনা চড়েনা, এবং দুই চোখের মত কান দুটোও বন্ধ রাখতে চায়। কিন্তু শরীর নিথর রাখা যায়, চোখ বন্ধ রাখা যায়, কান তো রাখা যায় না।
না চাইলেও সব শুনতে হয়, শোনা হয়ে যায়। মাইনকার এই কথা শুনে পারুলি চমকে উঠে, জলের অতল থেকে উপরে আসতে সময় লাগে – নির্জিব শরীর মনকে জীবিতের কাতারে আনতে কষ্ট হয়। তারপরও মরা মন পুনরায় জীবিত হয়, নিথর শরীর আবার চাঙ্গা হয়। এক বছর হয়ে গেল! পুরো একটা বছর চলে গেল! পুরো একটা বছর সে এই ভাবে পঙ্গু, লুলা, অসুস্থ্য হয়ে নোংড়া, পুঁতিগন্ধ হয়ে মাটির সাথে মিশে আছে! কেবল বুকের ভেতর প্রাণটা ধুকপুক করে। আর সীমাহীন, অসহ্য কষ্ট, দুঃখ, উপোষে অসহায় হয়ে মরণ কামনা করে। অনুভুতির দুয়ারে স্মৃতিরা এসে উথাল-পাথাল ঢেউ তোলে। মাইনকা না বললে- পারুলি বুঝতই না এখন দিনের শুরু নাকি দিন শেষ হতে চলেছে। পারুলির মনে চলে স্মৃতির বায়োস্কোপ…
পারুলির দেশের বাড়ি ময়মনসিং এর ভালুকা ত্রিশালের মাঝখানে কইতর বাড়ি গ্রামে। গ্রামের আর সব মেয়ের মত ওরও অল্প বয়সেই বিয়ে হয়, একই গ্রামের ছেলে শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে। শাহাবুদ্দিন ভ্যান চালায় ঢাকার এক ময়দার মিলে। ময়দার মিলের মালিকের বাড়িও ভালুকাতেই । মালিক, শাহাবুদ্দিন কে স্নেহের চোখে দেখে। বিয়ের পর মালিকের কথাতেই পারুলিকে নিয়ে শাহাবুদ্দিন ঢাকায় আসে।
রেলের ফাঁকা জমিতে ছাপড়া তুলে তুলে স্থানীয় পাতি মাস্তানরা ভাড়া দিয়ে রেখেছে। তারই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ওরা সংসার পাতে। ভ্যানের আয়ে মোটামুটি দুজনের চলে যায়, ২ বছরের মাথায় পারুলির কোলে আসে ওদের প্রথম সন্তান আম্বিয়া। ধীরে ধীরে মেয়ে বড় হয়, তিনজনের সংসারে নানা চাহিদা বাড়ে। খাওয়া, কাপড়-চোপড়, মাঝে মাঝে ডাঃ দেখানো, ঘর ভাড়া, নানা রকম প্রয়োজন, একার আয়ে আর কুলাতে পারে না। দিন আর একেবারেই চলেনা। স্বামী – স্ত্রী দুজনে ঠিক করে মাইয়াটা বড় হচ্ছে, স্কুলে যাওয়ার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, স্কুলে ভর্তি করান দরকার।
নানা কথা বার্তার পর ঠিক হয় গার্মেন্টস এ কাজ নিবে পারুলি। শাহাবুদ্দিন মালিকের সাথে কথা বলে পারুলিকে গার্মেন্টস এ ঢুকিয়ে দেয়। পারুলি বেশ চালাক, জীবনী শক্তিতে ভরপুর, কমবয়সী কর্মঠ মেয়ে, কিছুদিনের মধ্যেই গার্মেন্টস এর কাজ শিখে নেয় সে। এখন দুজনের আয় দিয়ে ভালই চলে যায় ওদের দিনকাল।
আম্বিয়াকে স্কুলে দিয়েছে সেও ২/৩ ক্লাস পার করল। শাহাবুদ্দিন- পারুলি, একটি পুত্রের আশায় আবার সন্তান নেয়। আশ্চার্য ওদের মনস্কামনা পুর্ণ হয়। একটি ছেলে আসে ওদের ছোট্ট ঘড়ে। ছেলে হওয়ার আগে পরে মাত্র অল্প কিছুদিন ছুটি নিয়েছিল পারুলি। সেসময় বাড়ি থেকে ওর ছোট বোন, বা মা এসে ছিল পারুলির কাছে। আম্বিয়া এখন সংসারের ছোট খাটো কাজ, পিচ্চি ভাইয়ের টুকটাক দেখাশোনার কাজ করতে পারে। তারপরও মাঝে মাঝে আলোচনা হয় যে- পিচ্চিটারে পারুলির মা-বোন দেশে নিয়ে যাবে।
এইসবের মধ্য দিয়ে দিন চলছিল- এত অল্পেই যে ওরা শান্তিতে, হাসি খুশীর সাথে দিন টেনে নিয়ে যেতে পারে এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আকস্মিক এক মর্মান্তিক, ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। চার চারটি জীবনের উপরে নেমে আসে এক গহীন অন্ধকার। পারুলি চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল ‘পয়লা বৈশাখ’ উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এইদিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশের সকল সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু নাকি সূর্যোদয় থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদন্ধ থাকলেও ঐতিহ্যগতভাবে সুর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি। সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল, ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পরের দিন ভূমির মালিকেরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পয়লা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের গান দিয়ে শুরু হয়। পয়লা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানট এর শিল্পীরা সম্মিলিত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরী হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ।
ঢাকায় বৈশাখ উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখের উৎসব- এখন দুই ঈদ, পূজোকে ছাপিয়ে গেছে। ঈদ বা পূজো একেকটি সম্প্রদায়ের, আর বৈশাখ সকলের, সার্বজনীজ। সকল স্তরের সকল শ্রেণির মানুষ এখন বৈশাখ পালন করে। পুরো দেশ লাল সাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। পারুলিরাও করে। আজকাল যারা বাসা বাড়িতে কাজ করে তাদেরকে বৈশাখে, ঈদের মত আলাদা বখশিশ ও বৈশাখী জামা কাপড় দিতে হয়। এটা তাদের দাবী। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার ঈদ পুজোর মত বৈশাখী ‘বোনাস’ চালু করেছে। দেশের মানুষ সরকারের উপর মহাখুশি।
সারা বছর সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে, নানা রকম সংগ্রাম করে দিন টেনে নিয়ে যায় পারুলি। আনন্দ বিনোদনের কোন সুযোগ নাই জীবনে। বছরে দুইটি ঈদ তাও নমো নমো করে কোনমতে সারা হয়। এ বছর ওরা ঠিক করেছিল ৩ জনে মিলে আর সবার মত বৈশাখ পালন করবে। কোনদিন তো করেনি। কোলের ছেলেটাও কাছে নাই ওরা ৩ জনে মিলে রমনার বটমূলে যাবে দেখবে রমনায় গিয়ে মানুষজন কি করে! সেখানে কি কি মজা হয়! আর যেতে তো ওদের যানবাহন লাগবেনা, ওদের নিজেদেরই ভ্যান আছে।
পয়লা বৈশাখের দিন ভোর বেলা পারুলি ওর মেয়ে আম্বিয়া সহ লাল সাদায় সেজে আম্বিয়ার বাবার ভ্যানে চড়ে চলে যায় রমনার বটমূলে। পারুলি মেয়েটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। হাতে লাল কাঁচের চুড়ি, লাল ফিতায় চুলে ঝুটি, ছোট্ট লাল শাড়ী পরে মেয়েটাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে! সাজিয়ে গুজিয়ে পারুলি মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে আর বলে- দেখ, দেখ আমাদের আম্বিয়াটা একদম পরীর লাহান হইছে…
পারুলি ঠিক করেছে, নিত্যদিনের পান্তা আজ ওরা সবার মত রমনায় খাবে। ইলিশ থাকুক নাগালের বাইরে, ভর্তা, পেয়াজ, মরিচ দিয়েই ওরা পান্তা খাবে। খুশি আনন্দে ৩ জনেই ঝলমল করতে থাকে। আম্বিয়া তো লাফাতে থাকে, ভয়ে পারুলি মাইয়ার হাত শক্ত করে ধরে রাখে কোথায় কোনদিকে আবার হারিয়ে যাবে! বাবারে এত মানুষ! এত রঙ বেরঙের সাজ তাদের! আর তারা দেখতেও এত সুন্দর! পারুলি দেখে শেষ করতে পারে কিন্তু তার আগেই বটতলায় নেমে এল যেন ৪৫ সালের সেই অমানবিক বীভৎসতা। হিরোশিমা নাগাসাকির নাম পারুলি জীবনে শোনেনি, কিন্তু কেয়ামতের ভয়াবহতার বর্নণা শুনেছে ওয়াজ মাহফিলের মাইকে। তবে আজই কি সেই কেয়ামত! অনেকদিন থেকে আশা করে, শখ করে, সেজেগুজে যেদিন ওরা রমনায় এল, সেদিনই কেয়ামত হল! কেয়ামত হবার আর দিন পেলনা! তাহলে সত্যিই কি পারুলিদের কপালে লেখা থাকে- জন্মের অপয়া!
বোমা এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় মানুষের আনন্দ, হাসি, গান, এবং অনেক প্রাণ। বহু মানুষের সাথে উড়ে যায় পারুলির শরীরের অর্ধাংশ।
ঘটনার পর প্রথম প্রথম চিকিৎসা, সেবা, যত্ন ভালই হয়। সরকারী ভাবেও হয়, সাধারন মানুষরাও অনেক করে। প্রথম কয়েকমাস হাসপাতালে ছিল সে। প্রথম দিকে সরকার, পেপার-টিভির লোকজনের মনে দয়া মায়ার বদ্বীপ জেগে উঠেছিল, তারা অনেক দিয়ে থুয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, কিন্তু কতদিন! খুব সাধারণ মানুষেরা যা করেছে তা বলার মত না। অতি গোপণে কেউ কেউ চোখের পানির সাথে সাধ্যাতীত ভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারাই বা আর কতদিন করবে!
কমাস পরেই হাসপাতাল কতৃপক্ষ ওকে ছেড়ে দেয়, শাহাবুদ্দিন পারুলিকে বাসায় নিয়ে আসে।
প্রথম তারা তাদের আগের বাসাতেই উঠেছিল। সেখানেই কমাস ছিল। শাহাবুদ্দিন পারুলির পিছনে যা কিছু ছিল, সব শেষ করে দিয়েছে, অনেকের কাছে ধার দেনাও হয়েছে প্রচুর। পারুলিকে খাওয়ানো, উঠানো, বসানো, পরিষ্কার করা সব শাহাবুদ্দিন নিজ হাতেই করেছে সারাদিন ভ্যান চালানো তো আছেই।
শাহাবুদ্দিনের হাত, মন একেবারেই শুন্য হয়ে আসে। শরীর ভেঙ্গে পরে, আর কোন ভাবেই সে টানতে পারে না। এই বাসার ভাড়া দিতে না পেরে একসময় ওরা চলে আসে রেল লাইনের পাশে পলিথিনের ঝুপড়ির ভিতরে। সরকারি বিল্ডিঙ্গের গায়ে পলিথিন লাগিয়ে তাবুর এক চালের মত ছোট খুপড়ি। না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে এখানে মানুষ বাস করে। গরু ছাগল থাকার ঝুপড়িও এর থেকে বড় হয়।
বেশ কমাস হল তারা এখানেই আছে । দিন রাত কিভাবে গেছে তার বর্নণা করা সত্যি বড় অসাধ্য কাজ। এখানে আসার কিছুদিন পরেই একদিন সকালে বের হয়ে শাহাবুদ্দিন কোথায় যেন চলে যায় আর ফিরে আসেনা। পারুলি এ নিয়ে একটি কথাও বলেনা। আগের দিন রাতে শাহাবুদ্দিন পারুলিকে তুলে বসিয়ে সারা শরীর অতি যত্নে পরিষ্কার করেছে, চুল আঁচড়ে বেণী করে দিয়েছে, খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছিয়ে, মুখে গায়ে পাউডার দিয়ে দিয়েছে। তারপর শুয়ে পড়েছে, কিন্তু সকালে চোখ মেলার পর পারুলি আর স্বামীকে দেখেনি। সারাদিন সারারাত যাওয়ার পরও যখন শাহাবুদ্দিন ফিরল না, পারুলি কোন কথা বলেনি। এত বছরের সঙ্গী, পারুলি বুঝেছিল যে আম্বিয়ার বাপ আর কোন দিন ফিরবে না। পারুলির ভিতরটা, কলজেটা ফেটে যাচ্ছিল, তবু সে কাঁদেনা, বিলাপ করেনা, কারো কাছে কোন অভিযোগ করেনা। মনে মনেও সে আম্বিয়ার বাপের কোন দোষ ধরতে পারে না, পারুলি বোঝে- মানুষের পারার সীমা আছে। আম্বিয়ার বাপে সীমার অধিক করেছে। টাকা নাই, পয়সা নাই, পঙ্গু শরীরে পচন ধরা এক রোগীকে নিয়ে আর কি করার আছে ? কিছু করতে না পেরে, কোন উপায় না দেখে, দুঃখ, কষ্ট, হতাশায়, লজ্জায় মানুষটা বিবাগী হয়ে কোথায় চলে গেল!
শরীরের কষ্ট, নিজের গায়ের দুর্গন্ধ,অসহ্য অবর্নণীয় অবস্থায়ও পারুলি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মনে মনে বলে- “হে খোদা, হে মাবুদ, মানুষটা যেখানেই গ্যাছে ভাল থাকুক, তারে তুমি ভাল রাইখো, হ্যায় বড্ড ভাল মানুষ”।
প্রচন্ড ভূমিকম্পের মত- আকাশ বাতাস, মাটি প্রকম্পিত করে পাশ দিয়ে ট্রেন যায়। প্রথম প্রথম পারুলির ভয় লাগত, আম্বিয়া ত ভয়ে দৌড়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরত। আজকাল পারুলির সকল অনুভুতিই চলে গেছে- আর ভয়!
আম্বিয়াও আর ভয় পায়না, বরং আজকাল যখন ট্রেন আসে, তখন অন্যদের দেখাদেখি সেও কিছু ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে হাতে নেয়, ঢিল মারার জন্য তারপর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চলন্ত এক দানব দেখে।
এখানে শুয়ে থাকতে থাকতে পারুলির মুখস্ত হয়ে গেছে, কখন কখন ট্রেন যায় আসে। সেতো সারারাত ঘুমায় না। মরার মত পড়ে থাকে। রাতে কত ট্রেন আসে যায়। ভোরের আজান যখন দেয়, তখন বেশ কয়েকটি ট্রেন যায় এবং আসে।
পারুলির কোন কিছু নিয়ে আর কোন আগ্রহ, কৌতুহল কিচ্ছু নেই আছে কেবল একটি সজাগ, পরিষ্কার পরিকল্পনা। এটা নিয়ে সে অনেক ভেবেছে। তারপর নিশ্চিত হয়েছে। ওর কোলের ছেলেটাকে ওর মা বোন নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে বলে বাঁচোয়া। তবে ছেলেটারে একটু দেখতে পেলে ভাল হত। আম্বিয়াকে রেখে গেছে, পারুলির সেবা করার জন্য।
কী সুন্দর তাদের নিটোল ছোট্ট সংসার এর ধবংস হওয়া, নিষ্ফল বাঁচার এই যুদ্ধ, আম্বিয়ার বাপের চলে যাওয়া, ঘেয়ো নেড়ি কুত্তার মত এক ঘেয়ে জীবন আর মানতে পারে না পারুলি।
এক রাতের শেষে পারুলি মেয়েটিকে জড়িয়ে নিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া চলন্ত দানব এর চাকার নিচেই আশ্রয় খুজে নেয়। বিকলাঙ্গ শরীরে মেয়েটিকে সাথে নিয়ে রেল লাইন পর্যন্ত আসাটা ছিল পারুলির জীবনের শেষ যুদ্ধ। সেসময় মসজিদে মসজিদে ধ্বনিত হচ্ছিল-
“আস সালাতু খাইরুম মিনাওন্নাউম”…
ঊষার আকাশ একটু একটু করে কালো পর্দা সরিয়ে উদ্ভাসিত হতে থাকে, চারিদিকে গাছে গাছে পাখ-পাখলি জেগে উঠতে থাকে।
মুসল্লিরা মসজিদে যেতে থাকে, রেল লাইনের ধার দিয়ে ঝুপড়ির লোকেরা প্রাত্যক্রিত সারতে বসে।
দিবস শুরুর সকল আয়োজন ছাপিয়ে, বিশাল ট্রেনের প্রকম্পিত গর্জন ছাপিয়ে আকাশে বাতাসে তরঙ্গ তোলে একটি কচি শিশুর রিনরিনে কন্ঠ- –
মা- আ – আ- আ- আ…
রেললাইনের নুড়ি পাথর, ধূলা, সবুজ ঘাস, ঝরা পাতা সবাই কি পারুলির সাথে একাত্মতা ঘোষনা করল- ধ্বনি ওঠে আ- আ- আ- আ-
রেলের নিচ দিয়ে, স্লিপারের পাশ দিয়ে, ঘাস- পাথরের এপাস ওপাশ দিয়ে রক্তের মোটা , চিকন ধারা বয়ে যায়- বয়ে বয়ে, একে বেঁকে সেখানে যেন ফুটে উঠে এক মাণচিত্র।