জহির সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসমতো সেলফোনে ফেসবুক নাড়াচাড়া করতেই একটি পোষ্ট দেখে ভুত দেখারমতো চমকে গেলো। কানাডার টরেন্ট ভিত্তিক একটি গ্রূপ থেকে বুবুর বড় একটি হাসি মাখা ছবি-র পাশে লেখা রয়েছে :
‘আমাদের প্রিয় আবৃত্তি শিল্পী নীলিমা রহমান কোভিড-১৯ এ সনাক্ত হয়ে টরেন্ট-র একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, উনার জন্য আপনাদের সবার দোয়া কামনা করছি।’
জহির কম করে হলেও প্রায় সাত/আটবার এক নিঃশ্বাসে পোষ্ট টি পড়ার পরে হতবম্ভ হয়ে বসে আছে। পরশুদিন রাতেই বুবুর সাথে তাঁর কথা হয়েছিল:
-‘জহির, আমার শরীরটা তেমন ভালো নেই রে, কয়েকদিন ধরে গায়ে হালকা জ্বর, গলার দিকটা কেমন ব্যাথা করছে, বুঝতে পাচ্ছিনা, কি করবো। এবার দু মাসের একসাথে বাসার খরচের টাকা পাঠালাম, বলা যায় না, কি হতে কি হয়ে যায়, চারিদিকে যা অবস্থা। শোন, আমার যদি কিছু হয়েই যায়, তোকেই কিন্তু সংসারের হাল ধরতে হবে ভাই আমার। আর শোন, গ্রাম থেকে সুন্দরমতো একটি মেয়ে বিয়ে করে ঘরে আনবি। আমাদের বাংলাদেশে গ্রামঞ্চলের মেয়েরা বেশ কর্মঠ হয়, দেখবি, সংসারটা কেমন আগলে রেখেছে।’

জহির মাঝ পথে বুবুকে থামিয়ে দেয়। ‘কি যা তা বলছো বুবু, রেস্ট নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’। জহিরের নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা হচ্ছে। কেন যে গতকাল বুবুকে ফোন করা হয়নি। লক- ডাউনের সময় তার হোটেলের ব্যাবসা বন্ধ। তাই ভেবেছিলো এই সুযোগে হোটেলের রান্নাঘরে কিছুটা কনস্ট্রাকশনের কাজ করিয়ে নিতে। গতকাল সারাদিন গেছে মিস্ত্রি খোঁজার সংগ্রামে, বুবুর ব্যাপারটি মাথার মধ্যেই ছিল না। আজ সকাল থেকে হোটেলের কাজে মিস্ত্রি লাগার কথা। 

জহির ঠান্ডা মাথায় দিনের কার্যক্রম ঠিক করতে থাকে। হোটেলের ম্যানেজার ইয়াসিন আলীকে ফোন করে বলে দিতে হবে তাঁর আসতে দেরি হবে মিস্ত্রিদের সাথে থেকে যেন কাজ বুঝায়ে দেয়; আব্বা, চিনু. মিনু ও মন্টুকে ডেকে বুবুর অসুখের ব্যাপারটি বলতে হবে; ফেসবুকের সেই গ্রূপের এডমিনের সাথে যোগাযোগ করে বুবুর হাসপাতালের ফোন নাম্বার নিয়ে রাখতে হবে, টরেন্টোতে বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করে এমন কোনো বেসরকারি সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

নীলিমা রহমান ওরফে নীলু ডিসি অফিসের অবসরপ্রাপ্ত হেড ক্লার্ক সায়েদুর রহমান সাহেবের বয়োজ্যষ্ঠ সন্তান। প্রায় পনেরো বছর ধরে কানাডার টরেন্টোতে বসবাস করে আসছেন। ওদের কোনো বাচ্চা/কাচ্চা হয় নি। স্বামী রাশেদ এর সাথে নীলিমা রহমানের পাকাপাকি ভাবে সম্পর্কচ্ছেদ হয় এখন থেকে প্রায় বছর সাতেক আগে। ডিভোর্সের পরে নীলিমা আর বিয়ে থা করেনি। রাশেদ বাংলাদেশে একটি বেসরকারি কলেজে কমার্সের শিক্ষক ছিলেন, পরে স্কিলড ওয়ার্কার ক্যাটাগরিতে কানাডায় এসে আবার নতুন করে একই বিষয়ে পড়াশুনা করে একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশের একটি ট্রাডিশনাল বিশ্বাসঃ হলো শিক্ষকরা ভালো মানুষ টাইপের হয়ে থাকে। কথাটি হয়তো ঠিক, বা ঠিক না। তবে রাশেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একশত ভাগ যে ওঠিক এটা নিশ্চিত। অথচ, বিয়ের আগে রাশেদকে দেখে একেবারেই বুঝার উপায় ছিল না তাঁর মধ্যে বদরাগের প্রতিভা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।  বিয়ের আগে যদি মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টাবলীর করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণের টেস্টের মতো টেস্ট করানো যেত খুবই ভালো হতো। যেমন: আগে প্রেম/বিয়ে করছে কি না তার জন্য একধরণের টেস্ট, বদরাগের জন্য এক ধরণের টেস্ট, মদ খাবার অভ্যাস আছে কিনা তার জন্যে আরেক ধরণের টেস্ট ইত্যাদি।

রাশেদ নীলুদের দূরসম্পর্কের ফুপাতো ভাই। একই পাড়ায় বাড়ি। রাশেদ বাসায় এসে নীলু ও জহিরকে পড়াতো। নীলুদের মফস্বল শহরে মেট্রিকের পরে মেয়েদের পড়ার জন্য দুই ধরণের ব্যবস্থা। মহিলা কলেজ অথবা ছেলে/মেয়ে একসাথে কো -এডুকেশন ডিগ্রি কলেজ। নীলুর জন্য মহিলা কলেজে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত যখন মোটামুটি চূড়ান্ত, তখন রাশেদ প্রবল বেগে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে  যাতে ওকে ডিগ্ৰী কলেজে ভর্তি করানো হয়, যেহেতু রাশেদ একই কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্র। রাশেদের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, ডিগ্রি কলেজে মহিলা কলেজের চেয়ে রেজাল্ট ভালো । তাছাড়া, ডিগ্রি কলেজে ভালো কালচারাল প্রোগ্রাম হয়। নীলু ছোটবেলা থেকেই স্কুলের কালচারাল পোগ্রামে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃতিতে নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতো। একবার, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় জেলা পর্যায়ে এক অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতা আবৃতি করে সবাইকে তাকে লাগিয়ে দিলো। জেলা প্রশাসক নীলুকে জড়িয়ে ধরে পাঁচ শত টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিলেন। লোকাল পত্রিকায় জেলাপ্রশাসক সহ নীলুর ছবি বড় বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হলো। পুরো শহরে নীলুকে নিয়ে এলাহী কান্ড। সঙ্গত কারণেই, রাশেদের পীড়াপীড়িতে নীলুকে ডিগ্রি কলেজেই ভর্তি হতে হলো।


কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে রাশেদের তদবিরের কারণে নবীনদের পক্ষ থেকে নীলুকে নির্বাচিত করা হয়েছে কিছু একটা পারফর্ম করার জন্যে । নীলু সেদিনের সেই প্রোগ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ কবিতা আবৃতি করে প্রথম দিনেই একেবারে বক্স অফিস হিট। কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার নিজে আসন ছেড়ে স্টেজ এসে নীলুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। দর্শকের কাতারে মা, বাবা বসে। জহিরের বেশ আক্ষেপ, তাঁর বুবু যখন ঠিক স্টেজে উঠবে সে সময় সাত মাসের যমজ বোন চিনু , মিনু গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মরা কান্না, তাই ওদেরকে কোলে নিয়ে বাহিরে ঘুরে এসে দেখে বুবুর আবৃতি শেষ। সেদিন রাতে বাসায় ছোটোখাটো একটা উৎসব হয়ে গেলো। সায়েদুর রহমান সাহেব বাজারে থেকে মাঝারি সাইজের একটি ইলিশ মাছ নিয়ে স্ত্রীকে বললেন :
‘রাহেলা, অনেক দিন ইলিশ পোলাও খাওয়া হয় না, আজ একটু ইলিশ পোলাও করো আর ওই রাশেদ গাধাটাকেও বোলো রাতে আমাদের সাথে খেয়ে যেতে। রাতের খাবার পরে, বাবার বিশেষ অনুরোধে নীলুকে আবারোও কবিতাটি আবৃত্তি করতে হলো। রাহেলা বেগম চিনু, মিনুকে ঘুম পাড়াতে যেয়ে নিজেও কিছুটা ঘুমিয়ে পড়েছে। সায়েদুর রহমান সাহেব পাশের ঘরে এসার নামাজ পড়ছেন। রাশেদ উঠি উঠি করেও বিভিন্ন ছলে এখনোও যাচ্ছে না। ঝকঝকে আকাশে প্রকান্ড চাঁদের আলোয় চারিদিকে আলো উপচে পড়ছে। জহিরের চোখে এড়ায় না তাঁর বুবু রাশেদ স্যারের বুকে মাথা রেখে নিচু স্বরে কথা বলছে। হাই স্কুলের ছাত্র জহিরের বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের স্যারের সাথে বুবুর বিশেষ সম্পর্ক চলছে।

জহিরের সাথে রাশেদ স্যারের পড়া লেখার বাইরে খেলাধুলা, রাজনীতি, আন্তজার্তিক বিভিন্ন বিষিয়ে গভীর আলাপ হতো। জহিরের কাছে রাশেদ স্যার ছিলেন পৃথিবীর মধ্যে সেরা জ্ঞানী মানুষদের একজন। অথচ, সেই রাশেদ স্যার যখন বুবুকে বিয়ে করে কানাডায় গেলেন, বছর তিনেকের মাথায় জহির জানতে পারলো, বুবুর উপর রাশেদ স্যারের দুর্ব্যবহার এর কথা। নির্মম অসহনীয় অত্যাচারের কথা। সভ্য দেশের সভ্যতার মধ্যে থেকেও অনেক পশু যে মানুষ হতে পারে না রাশেদ স্যার তার অন্যতম উদাহরণ।নীলুর সাথে জহিরের বয়সের গ্যাপ প্রায় আড়াই বছর হলেও দুই জন্যেই একে অন্যের পেটের কথা সব বলতো। জহির শুনেছে, দুলাভাই এর অত্যাচারের মাত্রা এমন পর্যায়ে ছিল যে বুবুকে একাধিকবার পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। জহির অবাক হয়ে ভাবে তাঁর এক সময়ের প্রিয় রাশেদ স্যারের কথা, মানুষ এত দ্রুত কিভাবে বদলায়।

রাহেলা বেগম প্রায় বছর দেড়েক হলো পর পর দুইবার স্ট্রোক হওয়ার পরে প্যারালাইসিসের রুগী হয়ে একে বারে শয্যাশায়ী। এর উপর আবার ডান পায়ে বাতের ব্যাথা। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এ বাড়িতে আয়ার মতো একজন বাড়িতে আসে উনাকে দেখাশুনার জন্যে। আয়ার কাজ হচ্ছে বেডপ্যান, বিছানা চেঞ্জ করা, রাহেলা বেগমকে গোসল করে দিয়ে এটা ওটা কাজ করে দুপুর পর্যন্ত থেকে দুপুরের খাওয়া খাইয়ে তার পরে চলে যাওয়া। এর জন্য তাকে মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা দেওয়া হয় যা নীলিমা রহমান সুদূর কানাডা থেকে বাসার অন্যান্য খরচের সাথে প্রতি মাসে জহিরের একাউন্টে পাঠায়। সকালে আয়া আসার আগে পর্যন্ত রাহেলা বেগমের দেখভালের দায়িত্ব স্বামী সায়েদুর রহমানের। আর সন্ধ্যার পরে, চিনু, মিনু পালা করে মায়ের দেখাশুনা করে। আজ সকাল পোনে আটটার মতো বাজে অথচ এখন পর্যন্ত কেউ তাঁর কাছে এলো না, রাহেলা বেগম কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন।

– ‘কি রে চিনু, মিনু, বাবা জহির, মন্টু তোরা সব কৈ গেলি, আমার ওষুধ খাবার সময় হলো কে কোথায় আছিস?’

রাহেলা বেগমের কথায় কেউ সাড়া দেয় না। কোনার দিকের ঘরে দরজা বন্ধ করে তখন জহির তার বুবুর অসুখের কথা সবাইকে সবিস্তারে বলছে। চিনু, মিনু তাদের বুবুর অসুখের কথা শুনে বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছে । বাবা সাইদুর রহমান সাহেব ওদের ধমক দিয়ে বললেন,’ কান্নাকাটি না করে দোয়া দরূদ পর, এই বলে তিনি নিজেও ওদের জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। মন্টুকে বলা হলো তার পালা খাসি যদি বুবুর জন্য ছদগা দেওয়া হয়, তার কোনো আপত্তি আছে কি না, মন্টু অতি দ্রুত রাজি হয়ে গেলো। অথচ, এই কিছুক্ষন আগেও, বুবুর অসুখের খবর শুনার আগে পৃথিবীর বিনিময় হলেও মন্টু কখনোই তার অতি প্রিয় খাসি হাতছাড়া করতে রাজি হতো না। এ বাড়িতে বুবুকে সবাই প্রাণের চেয়োও ভালোবাসে।

রাহেলা বেগম আগের চেয়ে আরো খানিকটা গলার স্বর বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকছেন:
কি হোলোরে, তোরা সব কাঁদছিস কেন, কি হয়েছে, ও মন্টুর বাবা, এদিকে এসোতো।’

সায়েদুর রহমান স্ত্রীকে ঔষুধ খাইয়ে, নীলুর কথা না বোলে স্ত্রীকে এটা ওটা অল্প কোথায় বুঝে বোলে তীর বেগে ছুটলেন মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবের খোঁজে। মুয়াজ্জিন সাহেবকে সাথে নিয়ে মাদ্রাসার কিছু ছাত্র বাসায় এনে কোরান খতম করতে হবে। জহির ইতিমধ্যে তার বুবু যে হাসপাতালে আছে তার ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন করে বুবুর আপডেট খবরের জন্য ক্রমাগত রিকোয়েস্ট করে যাচ্ছে, কিন্তু এসব দেশে হাসপাতালের কঠিন নিয়ম । রোগীর লিখিত বা মৌখিক অনুমতি ছাড়া রোগী সস্পর্কে টু শব্দ করবে না। সকাল দশটার মতো বাজে। অর্থ্যাৎ টরেন্টোতে এখন রাত্রি বারোটা। জহির ঢাকায় কানাডিয়ান দূতাবাসে ফোন করেছিল, ওরা বলেছে আগামী কাল আবার খোঁজ নিতে। ফেস বুকের সেই গ্রূপের এডমিনকে ইমেইল করেছিল, এখনো কোনো উত্তর পায়নি। এভাবেই পুরা একটি দিন কেটে গেলো।

মন্টুর ভীষণ মন খারাপ। বুবুর জন্য সারাক্ষন দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কয়েকদিন আগেই বড় ভাইজানের ফোনে বুবুর সাথে কথা হয়েছিল। বুবু বললেন, ‘মন্টু ক্লাস এইট হচ্ছে খুম ইম্পোর্ট্যানন্ট ক্লাস। ক্লাস এইটের রেজাল্টের উপর নির্ভর করবে তুই সায়েন্সে চান্স পাবি কি না। দরকার হলে ইংরেজি, অঙ্ক আর বিজ্ঞানের জন্য আলাদা আলাদা টিচার নিয়ে পড়। টাকা পয়সা যা লাগে, আমি দিবো । ভালো করে মন দিয়ে পর ভাই, তোকে ভালো রেজাল্ট করে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তারপর, আমার এখানে আসবি। এখানে ইঞ্জিনিয়ারের অনেক দাম, বুঝলি। এখানে অনেক টাকার চাকরি হলে তুই, আমি দুজন মিলে একে একে বাসার সবাইকে এখানে নিয়ে আসবো। এখানে, দূরে গ্রামের দিকে লেকের ধারে সুন্দর সুন্দর বাসা। আমরা সবাই মিলে একটি বিরাট বাসা নিয়ে থাকবো। আম্মাকে ভালো ডাক্তার দেখাবো।’

মন্টু বাবার সাথে ভোরে মসজিদে ফজর নামাজ পড়তে এসেছে। বড় ভাইজানকেও বলা হয়েছিল, বড় ভাইজান ঘুমাচ্ছে। ফজর ওয়াক্তে মাত্র দুই রাকাত ফরজ নামাজ হলেও ইমাম সাহেব অনেক লম্বা সূরা সুর করে পড়েন। অন্যান্য দিন হলে মন্টুর নামাজের সময় বার বার হাই উঠতো। আজ কে জানি ইমাম সাহেবের লম্বা সূরা মন্টুর বুকের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি তৈরী করছে। মোনাজাতের সময়, মন্টু প্রানপনে বুবুর জন্য দোয়া করলো: ‘হে আল্লাহ, আমার বুবুকে তুমি ভালো করে দাও’. মন্টু খেয়াল করলো পাশে বসা আব্বাও মোনাজাতের সময় নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন।

যমজ বোন চিনু, মিনু দুইজনেই একেবারেই একরকম, চঞ্চল প্রকৃতির। দুজনেরই স্বভাব হচ্ছে  সারাক্ষন হাসি খুশিতে থাকা। দুই বোনের চেহেরা যেমন একেবারে একই রকম, জামা কাপড়ও একই রকম করে পড়ে। দুই জন বাসা থেকে যখন কলেজের জন্য বের হয়ে রিক্সায় উঠে, পাড়ার ছেলেরা অবাক হয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে। দুই বোন এতে খুব মজা পেয়ে খিল খিল করে হাসে আর, ছেলেরা সেই হাসি দেখে মজা পায়। একবার, চিনুর সাথে ফেস বুকে পরিচয় হয়েছিল নতুন পোস্টিং হওয়া এক অবিবাহিত সহকারী প্রকৌশলী, নাম শরিফুল ইসলাম। ফেস বুকের প্রোফাইল পিকচার অনুযায়ী চেহেরায় বেশ ভদ্র টাইপের। ফেস বুকে ঠিক করা ছিল কলেজ যাওয়ার পথে সকাল সোয়া নয়টার সময় তিন মাথার মোড়ে শরিফুল সাদা শার্ট , নীল জিন্স পরে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্ল্যান মতো ছেলেটির কাছে রিকশা আসতেই রিকশা থামিয়ে চিনু মিনু একসাথে একই রকম করে হেসে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। ব্যাচারা শরিফুল কার হাতে ফুলের তোড়া দিবে ধান্দার মধ্যে পড়ে যেয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। চিনু, মিনু একসাথে হাসতে হাসতে বললো, ‘ ভাইয়া মুখ বন্ধ করেন, মশা ঢুকবে।’

সেই চিনু, মিনুর মুখে আজ কোনো হাসি নেই। পড়তে বসে কেবল বুবুর কোথায় মনে হয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

জহির হাপাতে হাপাতে চিনু, মিনুর নাম ধরে ডাকছে। সায়েদুর রহমান মুয়াজ্জিন সাহেবের  সাথে বারান্দার কোনার দিকে মাদ্রাসার ছাত্রদের সাথে কোরান শরীফ পড়ছিলেন। জহির কে দেখে ছুঁটে এলেন,: কি রে নীলুর কোনো খবর পেলি ?’
-‘ জি আব্বা, বুবু টরেন্টোতে যে হাসপাতালে আছে সেই হাসপাতালের ডাক্তারের সাথে এই মাত্র কথা হলো, অবস্থা আগের মতোই আছে। হাসপাতালে আমার ফোন নাম্বার দেওয়া আছে, ওরা আপডেট খবর জানাবে।’

রাহেলা বেগম অসুস্থ হলেও , কানে স্পষ্ট বুবু, হাসপাতাল শব্দ গুলি শুনতে পেয়ে চিৎকার করে বললেন :
‘ও রে চিনু, মিনু, তোরা আমার কাছে কি লুকাচ্ছিস, নীলু মার কিছু হয়েছে? জহির কি বললো? এদিকে আমার কাছে আয়, খুলে বলতো নীলু মার কি হয়েছে ?
চিনু, মিনু ঠিক করে, আম্মার কাছে বুবুর অসুখের ব্যাপারটি একেবারে না লুকিয়ে কিছুটা ইনিয়ে বিনিয়ে বলা উচিত। রাহেলা বেগম যে ঘরে শুয়ে থাকে সেই ঘরে ছোট্ট একটি টেলিভিশন রাখা আছে। তাই, দেশ.বিদেশের খবর শুনে করোনা ভাইরাস সম্মন্ধে রাহেলা বেগমের যথেষ্ট ধারণা আছে। চিনু, মিনু মা কে জানালো :
‘আম্মা, বুবুর গায়ে জ্বরতো, তাই হাসপাতালে বুবু করোনা ভাইরাসের টেস্ট করার জন্য গেছে । তুমি দুঃচিন্তা করবে তাই তোমাকে বলা হয় নি। ‘
জহির মন্টুর সেই খাসি এতিম খানায় নিয়ে জবাই করে মাংস ভালো করে কুটে বেছে কিছু মাংস বাড়িতে এনেছে মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য । এতিম খানায় এক বন্ধুকে বসিয়ে রেখেছে তদারকি করে একেবারে ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাওয়া খাইয়ে তারপরে যেন এতিম খানা থেকে চলে আসে। জহির বাড়িতে এসে সবেমাত্র গোসল সেড়ে কাপড় চেঞ্জ করছে , এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠলো । জহির ফোনের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে বললো, ‘ দেশের বাহিরের ফোন। ‘

বাবা সাইদুর রহমান, মন্টু , চিনু, মিনু সবাই বারান্দায় জহিরকে ঘিরে ধরেছে। জহিরের গলার স্বর কাঁপছে। জহির মূর্তিরমতো ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জহির কান্নায় ভেঙে পড়লো।
: ‘আব্বা, বুবু আর নেই।’

চিনু. মিনু আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। সায়েদুর রহমান শিশুর মতো শব্দকরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। মন্টু দৌড়ে মায়ের কাছে গেলো।
-‘ কি হয়ে হয়েছে মন্টু সোনা, সবাই কাঁদছে কেন”.
মন্টু কাঁদতে কাঁদতে বললো :
-‘আম্মা, বুবু আর নেই’।
বাড়ি শুদ্ধ সবার কান্নার শব্দে আশে পাশের প্রতিবেশী ছুঁটে এসেছে। রাহেলা বেগম জ্ঞান হারিয়েছেন, উনাকে মাথায় পানি দেওয়া হচ্ছে। মাদ্রসার ছোট ছোট ছেলেরা যারা এতক্ষন সুর করে কোরান শরীফ পড়ছিলো, তারা কিছুক্ষনের জন্যে থামিয়ে আবারোও পড়া শুরু করছে ….’ ফাবিআইয়্যি আ-লা-য়ি রব্বিকুমা- তুকায্যিবা-ন্। যার অর্থ হচ্ছে ‘অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?’


যমজ বোন চিনু, মিনু যারা সারাক্ষন হাসি খুশি থাকে, তাদের বুবুর জন্যে কান্নাকাটি করে দুজনেরই গলার স্বর ভারী হয়ে গেছে। বুবু বাড়িতে এলে বাসায় আঁনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এই গত বছরই বুবু বাড়ি এসেছিলো, সঙ্গে করে হরেক রকমের লিপস্টিক, মেয়েদের দামি ভ্যানিটি ব্যাগ, দামি দামি ব্র্যান্ডের  সেন্ট, চকলেট, আরোও কত কি এনেছিল ওদের জন্য। সবাই মিলে কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যান ছিল, মায়ের অসুস্থতার কথা ভেবে প্ল্যানটি ক্যান্সেল করে মাইক্রো বাস ভাড়া করে যমুনা ব্রিজের কাছে একটি রিসোর্টে হৈচৈ করে দুই রাত কাটানো হলো। সায়েদুর রহমানের পরিবারে এই প্রথম কোনো রিসোর্টে থাকা । খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থাও বেশ উন্নত। প্রথম দিন শেষে ডিনারে যমুনা নদীতে ধরা বোয়াল মাছ কাঁচা মরিচ, কালো জিরা, সর্ষের তেল দিয়ে ঝোল ঝোল করে রান্না করা হয়েছে, সাথে আস্ত মুরগির রোস্ট। মন্টু রোষ্টে কামড় দিয়ে বলে উঠে ,’বুবু তুমি প্রত্যেক বছর এভাবে যদি বাংলাদেশে  আসতে খুব মজা হতো মন্টুর কথা শুনে সবাই এক সাথে হেসে উঠে।


রিসোর্টের ইনডোর সুইমিংপুলে তিন বোন মিলে অনেকক্ষণ পানিতে দাপাদাপি করছে । এক বোন আরেক বোনকে পানি ছিটাচ্ছে আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। রাহেলা বেগমের অনেক দিন এমন সুন্দর মুহূর্ত কাটানো হয় নি। রাহেলা বেগম বেডরুমের সাথে লাগানো লম্বা বারান্দায় গদি আলা বেতের চেয়ারে বসে নীল আকাশে শরৎকালের মেঘের ভেলা দেখছে। জহির, মন্টু তাদের বাবার সাথে পাশের গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে বিলের পানিতে মাছ ধরতে যেয়ে সারা গায়ে কাদা লেপ্টে একেবারে যা তা অবস্থা। কাদা মেখে বাপ ব্যাটা দের কিম্ভুত কিমাকার চেহারা দেখে অসুস্থ রাহেলা বেগম বাতের ব্যাথা ভুলে হেসে কুটি কুটি। একটিমাত্র টেলিফোনে এমন দৃশ্য সায়েদুর রহমানের পরিবারে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলো।


পরের দিন টরেন্টোতে বাংলাদেশী কমিউনিটি নিয়ে কাজ করে এমন এমন একটি সংস্থার সহায়তায় আবৃতি শিল্পী নীলিমা রহমানকে টরেন্টোর কাছে কোথাও পরিবারের সম্মতিতে সমাধিস্থ করা হয়। মন্টুর কানের কাছে বুবুর শেষ কথাগুলি রিন্ রিন্ হয়ে বাজতে থাকে ‘ভালো করে মন দিয়ে পর ভাই, তোকে ভালো রেজাল্ট করে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তারপর, আমার এখানে আসবি.. ।’ মন্টুর ইঞ্জিনিয়ার হওয়া অনেক দূরের পথ, তবে মন্টুর খুব সাধ হয় টোরেন্টোতে যেয়ে বুবুর কবরটি একবার শুধু ছুঁয়ে দেখতে।


পরের দিন জহির ফেসবুক খুলতেই আবারো সেই গ্রূপের পোষ্ট দেখতে পায়। এবার বুবুর একই ছবি পোষ্ট করে ক্যাপশনে লেখা আছে :’আমাদের প্রিয় আবৃতি শিল্পী নীলিমা রহমান আর নেই’। নীচে, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে কমেন্টস করেছে। কেউ লিখেছে ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেউন’, কেউ বা লিখেছে ‘ মহান আল্লাহতায়ালা যেন তাঁকে মাফ করেন ও বেহেস্ত নসিব করেন । জহির প্রতিটি কমেন্ট সময় করে পড়ে এবং বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করে সেখানে রাশেদ স্যারের কোনো কমেন্টস নেই, অথচ জহির নিশ্চিত রাশেদ স্যার
এই গ্রূপের এক জন মেম্বার।

জহির দরজা বন্ধ করে তার বুবুর ফেসবুক পেজ ঘেটে বুবুর পোষ্ট করা অনেক পুরানো বুবুর কণ্ঠে একটি ভিডিও কবি নজরুল ইসলামের মহররম কবিতাটি শুনতে থাকে
‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া,–
‘আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’ ……….।’


জহির হটাৎ করে খেয়াল করে তার বুবুর পুরা নাম হচ্ছে ‘নীলিমা রহমান’। নীল রংটি বুবুর খুব প্রিয় ছিল। মানুষ বিয়ের সময় লাল রংএর শাড়ি পরে, তার বুবু পরেছিলেন লাল পেড়ে গাঢ় নীল রং এর কাতান। অথৈ সমুদ্রের পানির রং নীল, স্বচ্ছ আকাশের রং নীল। জহির অবাক হয়ে ভাবতে থাকে সেই নীল রং এর আরেক রূপের কথা। কেউ শরীরের কোথাও ব্যাথা পেলে, জায়গাটি নীল হয়ে যায়। তবে কি নীল রঙের এর সাথে সৌন্দের্যের পাশাপাশি মানুষের হৃদয়ের কোথাও বেদনা লুকিয়ে থাকে !! দিন দিন বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। কারো বুবু, কারো মা, কারো বাবা কারো বা ভাই/বোন। এক সময়, করোনা ভাইরাসের বিষাক্ত ছোবলে লাল সবুজের বাংলাদেশের পতাকা জহিরের কাছে নীল বর্ণ ধারণ করে । এ এক নীল কষ্ট যা পরিবারের একেবারে কাছের কেউ আক্রান্ত না হলে কিছুতেই বুঝা যায় না। কোথায় যেন নীল কষ্টের একটি কবিতা অনেক আগে জহির পড়েছিল, কবির নাম কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছেনা বিড় বিড় করে আপন মনে জহির বলতে থাকে থাকে ..

‘কষ্ট অনেক
অনেক কষ্ট
ছোট কষ্ট
বড় কষ্ট
রং-বেরং এর নানা কষ্ট
কান্না কষ্ট, হাসি কষ্ট,
আমার বুকে নীল কষ্ট।……’ 

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের খেরোখাতাঃ এলোমেলো পংক্তিমালা-পর্ব ১১
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের বাংলাদেশি ছেলে মেয়েদের জন্য টুকিটাকি-পর্ব ৩
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন