বিকেলে রহমত ও আফজাল রমিজকে নিয়ে গোপীবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তান হকার্স মার্কেট হয়ে বায়তুল মুকাররম ঘুরে স্টেডিয়ামের নিচে এক চায়ের দোকানে বসে চা ও সিঙ্গারা কিনে তিনজনে বসে আলাপ করছে। আজ স্টেডিয়ামে মোহামেডান বনাম আবহানীর খেলা,গেট দিয়ে ভিতরে তাকালে বোঝা যায় মাঠ ভর্তি লোক এবং উত্তেজনা। ওরা সেদিকে খেয়াল না দিয়ে রমিজের অবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করে বলে রমিজ গ্রামে খেয়ে না খেয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে যে ভাবে বেঁচে আছে ওটাকে বেঁচে থাকা বলা যায় না। স্ত্রীর গহনা শেষ সম্বল বিক্রি করে দোকানের কিছু টাকা পরিশোধ করলেও বাকী টাকার জন্য দোকানদার অহরহ তাগাদা দিচ্ছে। দোকানদারের নিকট বাকিতে চাল,ডাল,লবন চাইলে বলে আগের টাকা ফেরত দাও। আমি তোমাকে কোত্থেকে বাকিতে দেব, আমার নিজেও এই দোকানদারি করে চলতে হয়।রমিজের ছেলেমেয়েরা অনাহারে বা অর্ধাহারে গ্রামে কোনোরকমে বেঁচে আছে। সে ঢাকা আসতে চায় , তবে সংসারে অভাব ছাড়া ও নানাহ সমস্যা আছে। আমরা কী ভাবে সাহায্য করতে পারি ?
আফজাল বলে রমিজের কোর্ট কেসের কী অবস্থা?
রমিজ বলে কেস আদৌ মীমাংসা হবে বলে মনে হয় না। কেরামত আলী মিয়া এলাকার প্রতাপশালী লোক; তার বাবা নেয়ামত আলী মিয়া কি ভাবে আজ থেকে ৫০- ৫৫ বৎসর আগে আমাদের বাড়ি মাঠ- জরিপের সময় ওদের নামে উঠিয়ে নিয়েছে আমার দাদা বা বাবা তা জানতো না। রহমত বলে তোমার দাদা বা বাবা জানলে এটা মীমাংসা না হয়ে গড়াতো না। হ্যাঁ, ঠিকই বলছো। সে সময় ওদের জন্য এটা মীমাংসা করা সহজ ছিল।
আমাদের গ্রামে- গঞ্জে মাঠ পর্যায়ে যখন জরিপের লোক আসে তখন এলাকার চালাক মানুষ ওদের পকেটে কিছু পয়সা দিয়ে অন্যের জমি নিজের নামে উঠিয়ে নেয়। যারা খোঁজ খবর রাখে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজ দেখিয়ে ঠিক করিয়ে নেয়। তবে সে ক্ষেত্রে কিছু পয়সা খরচ করতে হয়। কিন্তু তোমার দাদা বা বাবা জরিপের সময় খোঁজ-খবর নেয়া উচিৎ ছিল। রমিজ বলে ওরা সরল সোজা ধরণের লোক ছিল, কোনো রকমে দিন এনে দিন খাইতো এবং মিয়াদের সঙ্গে বাদানুবাদ করার মত অবস্থা ছিল না।
জরিপ আসলে ওরা কাগজ দেখিয়ে এই জমি ওদের নামে রেকর্ড করিয়ে নিয়েছে । কিন্তু আমার বাবা জীবিত থাকলেও এ নিয়ে কোনো কথা বলতে শুনি নি। আমি তখন ১৬ বৎসর, বাবার মৃত্যুর পর কেরামত আলী মিয়া বলে যে আমাদের বাড়ি ঘর কাগজ পত্রে ওদের নামে রেকর্ড এবং আমার বাবা বা দাদা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমি এই কথা শুনে কাঁপতে থাকি যেন হঠাৎ করে আমার মাথায় বাজ পড়েছে। আমি কাগজপত্র বুঝি না, তহসিল অফিসে গেলে আমাকে পাত্তা দেয় না ।
আমি এ নিয়ে স্থানীয় গন্যমান্য লোক ডেকে ছিলাম, কেরামত আলী মিয়া কাগজপত্র দেখায়, কোনো মীমাংসা করতে পারি নি। ওরা বলে এটা ওদের জমি। আমি AC ল্যান্ডের অফিসে গিয়ে দরখাস্ত দিয়েছি। কেরামত আলী মিয়া পয়সাকড়ি দিয়ে অফিসের লোকজনকে কিনে নিয়েছে, কেউ আমার কথা শুনে না । কেরামত আলী মিয়া আমার বিরুদ্ধে কোর্টে কেস দিয়েছে যে আমি জোরপূর্বক এ বাড়িতে থাকি। রহমত বলে কেরামত আলী মিয়া সহজে এই কেসের মীমাংসা করবে না। বাড়ির কাগজপত্র সবই ওর নামে, তোমার দাদা,বাবা বা তোমার নামে কিছুই নেই। তোমাকে ব্রিটিশ পিরিয়ডের রেকর্ডে যেতে হবে, তাও অনেক সমস্যা। কুমিল্লা শহরে ব্রিটিশ পিরিয়ডের ত্রিপুরা জেলা পুরানো রেকর্ড অফিস আছে, ওখানে গিয়ে মৌজা নম্বর,জমির দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর দিয়ে তল্লাশি দিয়ে দেখতে পারো।
রমিজ ভাই তুমি ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্য ঢাকা চলে এসো । তাছাড়া ওই বাড়ির কেস কী হবে তুমি কিছুই বলতে পারবে না। মনে সাহস নিয়ে চলবে, যা কিছু আইন মতে হবে মেনে নেবে, এ ছাড়া তোমার কোনো কিছুই করার নেই। আফজাল বলে মুসাকে বলে দেখি যদি আমাদের পাশের রুম খালি হয় তোমাদের দিয়ে দেয়া যায় কী না?
রহমত বলে শুনেছি আমাদের পাশের রুম খালি হবে। আমি এই রুমের লোকদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি যে আমার দরকার। আমার ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে, এক রুমে আর কত দিন থাকবো। যদি খালি হয় বলে কহে কিছু পয়সা মুসাকে ঘুষ দিয়ে নিতে চেষ্টা করবো। চলেন মুসাকে বলে দেখি কী বলে ?
আফজাল বলে মুসা ঘুষ নেয়, পয়সা না দিয়ে কোনো কথা বললে সে শুনবে না। রহমত বলে আগে বলে দেখো সে কী বলে?
গুলিস্তান থেকে আসার পর মুসাকে এক দোকানের সামনে বসে সিগারেট টানতে পাওয়া গেলো । ওকে আফজাল সালাম দিয়ে বলে ভাইজান তোমার সঙ্গে একটু নিরিবিলি কথা আছে, তুমি আসো আমরা চা খাবো এবং কথা বলবো । সে রহমতের দিকে তাকিয়ে বলে এখন সময় হবে না চা খাবার, তুমি কী বলতে চাও?
আফজাল বলে আমি শুনি আমাদের পাশের রুম খালি হবে; মুসা বলে ওই রুম ভাড়া হয়ে গেছে অন্য এক ফ্যামিলির নিকট। আফজাল বলে আমি ও রহমত ভাই অনেক দিন থেকে বলে আসছি, আমাকে না দিয়ে কী ভাবে তুমি বাহিরের লোককে দেবে ?
মুসা মেজাজ গরম করে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে কার জন্য ?
আফজাল বলে রমিজ ভাই অনেক অসুবিধায় আছে গ্রামে ছেলেমেয়ে নিয়ে এবং ঢাকা আসতে চায় । মুসা বলে ওর পরিবারে কতজন লোক?
রহমত বলে চার জন । মুসা বলে এই ছোট্ট রুমে কি করে চার জন থাকবে ?
রহমত বলে কি করবে অসুবিধায় পড়েছে।
মুসা বলে এখানে সব লোক গ্রাম থেকে এসে ভিড় জমাচ্ছে, সিঙ্গল লোক ব্যতীত কাউকে ভাড়া দেয়া হবে না। ৩০–৩৫ জন লোকের জন্য একটা চাপা কল এবং একটা পায়খানা। সপ্তাহে ২/৩ বার চাপা কল নষ্ট হয় । আফজাল বলে আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাবো ?
অনেক অনুরোধের পর মুসা বলে দেখি চিন্তা করে তোমাকে বলবো। আফজাল বলে আমি রাত আর একবার এসে কথা বলবো। ঠিক আছে এখন যাও।
বাসায় আসার পর রহমত ও আফজাল বলে রমিজ তুমি আগে বলো বাসা নেয়া হলে তুমি কী স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঢাকা চলে আসবে ?
রমিজ বলে আমার সংসারের যে অবস্থা এতে এখনই সব নিয়ে ঢাকা চলে আসা উচিৎ। রহমত বলে তোমার বাড়ি নিয়ে কেরামত আলী মিয়ার সঙ্গে যে সমস্যা তার কী হবে ?
রমিজ এর কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারছে না। আফজাল ও রহমত বলে তুমি বাড়িতে গিয়ে এ নিয়ে তোমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের ও স্থানীয় গন্যমান্য দুই/এক জনের সঙ্গে আলাপ করো।
ওকে সদরঘাট নিয়ে লঞ্চে উঠিয়ে দেয়ার সময় আফজাল ও রহমত বলে এটা অত্যন্ত জটিল বিষয়, তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসলে কেরামত আলী মিয়া তোমার ঘর ভেঙে দখল করে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এখানেও তোমার জন্য কোনো কাজ তৈরী নেই যে আসলেই পাবে। এখানেও তোমার অনেক কষ্ট করতে হবে এবং এ নিয়ে নিজের পরিবারের সঙ্গে আলাপ করা উচিৎ। যদি একান্ত চলেই এস, কথা দিলে তোমাদের থাকার জন্য মুসার সঙ্গে আলাপ করে দেখবো। রমিজ বলে আমি বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে জানাবো।
রমিজ গ্রামের বাড়িতে চলে আসার পর এ নিয়ে স্থানীয় কিছু লোক, ঝর্ণা ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে। ঝর্ণা ও ছেলেমেয়েরা বলে আমরা অনাহারে, অর্ধাহারে এখানে আর কতদিন বেঁচে থাকবো ?
তুমি বরং আগে গিয়ে কিছু করতে পারো কিনা দেখো, তার পরে সিদ্ধান্ত নাও। তুমি কিছু করতে পারলে আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে ঢাকা চলে যাবো। ঝর্ণা বলে ঢাকা গেলে তুমি এবং আমি কাজ করবো এবং রহমত ভাই ও হাসি এবং তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকলে এরাও ভালো পড়াশুনা করতে পারবে। কেসের তারিখ অনুযায়ী কোর্টে গিয়ে হাজিরা দেবে। রমিজ বলে ঠিক আছে তাই হবে ।
ভোরের লঞ্চে রমিজ ঢাকা এসে বলে তোমরা যেহেতু আছো, আমি আগে কিছু করি এবং পরে ঝর্ণা ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবো। তোমরা আমার জন্য রিকশা ও থাকার ব্যবস্থা করো। আফজাল ও রহমত বলে আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করবো। আমাদের এখানে থাকা না থাকা নির্ভর করে বাসা খালি হওয়া এবং মুসার উপর। রহমত ও আফজাল রমিজকে আপাতত নিকটে–ই একটা মেসে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
কোনো লোক বাসা ছাড়ছে না। আফজাল এবং রহমত মুসাকে কিছু পয়সা দিয়ে রেখেছে এবংবাসা খালি না হলে কোনো ক্রমেই রমিজকে কিছু বলা যাচ্ছে না। রমিজ কয়েকবার এ নিয়ে আফজাল ও রহমতের সঙ্গে আলাপ করেছে ।
শেষে রমিজ বাড়ি গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে মেসে অন্য লোকের সঙ্গে শেয়ার করে থেকে রিক্সা চালাবে; অপরদিকে তার স্ত্রী ঝর্ণা এবং ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে দেবে। রমিজ বলে আমি সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করি , ছেলে সোহেল এসে বাড়ির খবর দেবে ও যা কিছু টাকা দিতে পারি নিয়ে যাবে। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে আফজাল, রহমত ও রমিজ রিক্সা নিয়ে কাজে বের হয় এবং ভোরে রিক্সা জমা দিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
ঝর্ণা সোহেল ও লতাকে নিয়ে মিয়া বাড়ি গিয়ে কেরামত আলী মিয়ার স্ত্রীকে বলে রমিজ গ্রামে যে পয়সা রোজগার করে তা দিয়ে কোনো রকমে ও চারজনের খাওয়া খরচের পয়সা আসে না। সে জন্য সে ঢাকা গিয়েছে এবং দেখে যদি রিক্সা চালিয়ে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। রাবেয়া ও দিলারা বলে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু করা দরকার করবে । ঝর্ণা বলে আপা আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে একা একা থাকতে ভয় পাই। রাবেয়া বলে তোমার ছেলে মেয়েরা বড়ো হয়েছে, ওরা তোমার সঙ্গে থাকলে ভয় আবার কিসের ? তাছাড়া রমিজ প্রতি সপ্তাহে বাড়ি এসে দেখাশুনা করে ।
আজকাল ঝর্ণা দিনের বেলা নিজের কাজ সেরে ছেলেমেয়েরা ঘরে আসলে বিকেলে মাঝে মধ্যে এসে একটু আধটু কাজ করে দিয়ে যায় এবং রাবেয়া যাওয়ার সময় একটু ভাত, তরকারি বা কিছু চাল দিয়ে বলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে রান্না করে দিও।
রমিজ ও ঝর্ণা বসে আলাপ করে ঠিক করেছে যে গ্রামের ভিটা ছেড়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে সে ঢাকা বাসা করে থাকবে না। সোহেল ও লতা বলে আমরা এখান থেকে চলে গেলে মিয়া আমাদের বাড়ি দখল করে নিয়ে যাবে।
রমিজ আফজাল ও রহমতকে বলে যে সে আপাতত তার পরিবারকে গ্রাম থেকে এখানে আনবে না। কেরামত আলী মিয়ার সঙ্গে যে কেস রয়েছে তার মীমাংসা না করে বাড়ি থেকে পরিবার নিয়ে আসলে হয়তো সাথে সাথে বাড়ি বেদখল হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত: ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করছে এবং ওদের স্কুলের শিক্ষক বলেন যে ওদের স্কুল শেষ না করে ঢাকা নিয়ে আশা ঠিক হবে না। আমি একাই কাজ করে দেখি কতদূর কি করতে পারি। রহমত বলে আমি মুসাকে কিছু টাকা দিয়েছি এবং ভালোভাবে চিন্তা করে দেখো কি করবে। মুসা কোনোদিন ও ঐ টাকা ফেরত দেবে না। রহমত বলে আমার নিজের ও ছেলেমেয়েদের জন্য আর এক কামরা দরকার। ওরা বড়ো হয়েছে, দেখা যাক কি হয়।
কেসের তারিখ অনুযায়ী কেরামত আলী মিয়া উকিল নিয়ে কোর্টে হাজির হয়েছে এবং রমিজ হেডমাস্টার আতিক সাহেবকে ভলান্টিয়ার হিসাবে কোর্টে উপস্থিত করেছে।
জাজ কেরামত আলী মিয়াকে বলে এই জমি তোমার বাবা নেয়ামত আলী মিয়া খরিদা সূত্রে মালিক এর কি প্রমাণাদি আছে ?
কেরামত আলী মিয়ার উকিল বলে স্যার এই জমি গত ৪০ বৎসর নেয়ামত আলী মিয়া ও ছেলে কেরামত আলী মিয়া খাজনা দিয়ে আসছে এবং এর চেয়ে বড় প্রমান আর কি হতে পারে ?
জাজ পুনরায় বলে এই জমি খরিদ করা হয়েছে এই ধরণের কোনো প্রমাণাদি কি আছে ?
স্যার মিয়াদের বাড়ি পোড়া গিয়েছে এবং যত কাগজ পত্র ছিল সবই আগুনে পুড়ে গেছে। জাজ জিজ্ঞেস করে কত সনে বাড়িতে আগুন লেগেছিলো?
উকিল বলে স্যার, সঠিক তারিখ বলতে পারবো না, তাও আজ থেকে ৩০ বৎসর হবে। তহসিল অফিসে খাজনা দেয়া হয়ে থাকে, সে জন্য রেকর্ড পাওয়া গেছে। তহসিল অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী এই জমি খরিদা সূত্রে কেরামত আলীর বাবা এবং ছেলে মালিক।
আতিক সাহেব বলেন মহামান্য আদালত, ওপর পক্ষের উকিল বলেছে রমিজ জোর করে বাড়ি দখল করে আছে ,এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট কথা। রমিজকে বাড়ি ছাড়া করে কেরামত আলী মিয়া সুন্দর করে চতুস্কোন সমান করে বাড়ি করবে । সে গরিব রমিজকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করতেছে। রমিজের স্ত্রী ঘরে একা থাকতে দিনের বেলায় ও ভয় পায়। কেরামত আলী মিয়া তার লোক দিয়ে অত্যাচার করে বাড়ি থেকে ওদের উঠিয়ে দিতে চাচ্ছে। জাজ কোর্টে উভয় পক্ষের শুনানি ও জেরা শুনে কোনো রায় না দিয়ে পুনরায় তারিখ দিয়ে কেস মুলতবি করেন।
আতিক সাহেব এগিয়ে এসে কেরামত আলী মিয়ার উকিলকে বলেন আপনাদের কেসের কোনো মেরিট নেই : অযথা কেস চালিয়ে দুই পক্ষের হয়রানি হচ্ছে। তার চেয়ে বরং কেস উইথড্র করে ঘরে চলে যান। কেরামত আলী মিয়ার উকিল বলে আমরা কেসের শেষ না হওয়া পৰ্যন্ত চালিয়ে যাবো। তহসিল অফিসে আমার বড় ধরণের রেকর্ড এবং ওতে লেখা আছে যে এই বাড়ি রমিজের বাবার কাছ থেকে কেনা হয়েছে।
রমিজ আফজাল এবং রহমতকে বলে কেরামত আলী মিয়ার উকিল জমি সংক্রান্ত যাবতীয় খাজনার কাগজ জমা দিয়েছে তবে জাজ খরিদা সূত্রে মালিক এই জাতীয় কোনো প্রমাণাদি আছে কিনা দেখাতে চেয়েছে। উকিল বলেছে ৩০ বৎসর পূর্বে মিয়াদের বাড়ি পোড়া গিয়েছে এবং দলিল পোড়া গেছে বলে জানিয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছে জমি বিক্রি করেছে এই জাতীয় কোনো প্রমান আছে কী ?
আতিক সাহেব জাজকে বলেছেন এটা মিথ্যা বানোয়াট কথা; এই বাড়ি কোনোদিন বিক্রি হয় নি। রমিজ মিয়া এবং ওর বাবা অশিক্ষিত লোক পেয়ে কেরামত আলী মিয়ার বাবা নেয়ামত আলী মিয়া ধোকা দিয়ে কাগজ বানিয়েছে, জরিপে বাড়ি নিজেদের নাম উঠিয়ে নিয়েছে।
আফজাল বলে কেরামত আলী মিয়া হীনমনা, লোভ লালসা বেশি, তোমাকে ঠকিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করবে । রহমত বলে এই লোক পরের ক্ষতি করে নিজের পেট ভরে । সে এলাকার একজন প্রভাবশালী লোক এবং গরিব লোকদের জমি দখল করে ধনী হয়েছে। রহমত বলে তুমি এ সব নিয়ে চিন্তা করবে না, ছেলেমেয়েদের বলবে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে। তোমার ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করলে দেখবে তোমার দুর্দিন আর থাকবে না।
আফজাল, রহমত ও রমিজ সন্ধ্যায় একত্রে বের হয় রিকশা নিয়ে। তিন জনের একই দূরবস্থা, একই চিন্তা ভাবনা,সৎভাবে পরিশ্রম করে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা দিয়ে মানুষ করা একমাত্র লক্ষ্য। ওরা তিনজনে রাতে মাঝে মধ্যে সদরঘাটে চায়ের দোকান থেকে চা ও সিঙ্গারা নিয়ে খায় ও কার কত রোজগার হয়েছে এ নিয়ে আলাপ করে । তাছাড়া নিজেদের সুখ দুঃখ নিয়ে ও আলোচনা করে।
রমিজ বাস্তুহারাদের কয়েকজন মিলে রহমত ও আফজালের নিকটে একটা ছোট্ট রুমে থাকে। ওরা সবাই মাটিতে হোগলা বিছিয়ে ঘুমায়। ওকে বাদ দিলে বাকিরা সবাই দিনে কাজ করে এবং রমিজ সকালে কাজ থেকে আসলে কারো সঙ্গে দেখা হয় না। এদের কেউ কেউ ফুটপাথে এটাসেটা বিক্রি করে , কেউ জুতায় কালি এবং দুই জন ঠেলা গাড়ি চালায় । এরা সকালে খেয়ে বের হয় এবং কেউ দুপুরে খায় না, সন্ধ্যার দিকে এসে রাতের খাওয়া সেরে নেয়।
এরা মাসে তিন সপ্তাহ কাজ করে এবং গড়ে এক সপ্তাহ বাড়িতে থাকে। এদের মধ্যে প্রবীণ রমিজ এবং ওরা বড়ো ভাই হিসাবে ডাকে। এদের বাড়ি চলে যাওয়া এবং বাড়িতে বেশি সময় থাকার কারণ নুতন বিয়ে করেছে। ওরা হাঁসতে হাঁসতে বলে বৌ আসতে দেয় না, আমাদের স্ত্রীগণ ঢাকা শহরকে বিদেশ মনে করে এবং কবে বাড়ি আসবে পথের পানে তাকিয়ে থাকে। সবার একটা রেডিও ট্রান্সিস্টর কেনার শখ এবং বাড়ি গেলে ওটা নিয়ে সারাক্ষন গান শুনবে । তাছাড়া শ্বশুর বাড়ি গেলে ওটা নিয়ে যাবে, এই ঘর সেই ঘরের লোক জন এসে গান শুনবে, এতেই আনন্দ। মাঝে মধ্যে সিনেমা হলে সবাই মিলে রিয়ার স্টলের টিকেট কিনে দেখতে যায় এবং বাসায় এসে কবরী, শাবানা, সুজাতার অভিনয় কার কেমন লেগেছে এ নিয়ে হাসাহাসি করে। প্রবীণ রমিজ সদ্য গ্রাম থেকে এসেছে ,ওদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে না।
কাজের বুয়া সকাল ও বিকেলের রান্না করে দিয়ে যায়। রমিজ এদের সঙ্গে ঘুমায় ,রহমতের পরিবারের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে ।
ক্রমশ :