দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
পর্ব ১৩।।     

শীতার্ত দেয়ালের তরুণ শ্রবণ-ইন্দ্রীয় চক্ষুলজ্জাহীন হয়ে উঠতে পারে অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে। অভিজাত গৃহস্থবাড়ির বিষণ্ণ মায়াবী গিন্নি প্রতি বিকেলে নিজে মুড়ি ভেজে নাইওর যাওয়ার আস্বাদ উদযাপন করে। খবরটা চাউর হওয়ার আগেই গৃহপালিত হাওয়ারা চৌরাস্তার মোড়ে গেল চায়ের আড্ডায় বসা শ্রমিকদের মুখে আদিরসের গল্প শুনতে। 

অল্পবিস্তর সন্ধ্যা নামলে, আবছায়া বৃত্তের বাতায়নগুলো নদীর পাড় ধরে নিভে যেতে থাকে। হয়ত পঞ্চপ্রদীপের মতো প্রদীপ্ত কামনাতে ভর ক’রে আবারো ঋজু হয়ে চাঁদ উঁকি দেবে নৈসর্গিক তাজমহলের আর্দ্রতা ছড়িয়ে।  

সাতটি তারার ঐশ্বরিক আলোতে ফুটফুটে ছায়ারা নির্ভীক শিল্পী। এইসব সমবেত নাবিক ভালবেসেছিল একাকীত্বের আগুন, হাঘরে পাখিদের প্রবাহ, স্বীকৃতিহীন স্বজাতিপ্রীতি। মাথুর অভিপ্রায়ে সংশয়ের নাভিমূলে এঁকে দেয় নি কি বেনিপুর বাওড়ের প্রভা? উট-দৌড়ের চিত্রলিপিতে প্রার্থনাঢ্য চোখের পর্দা দুলে ওঠে স্থাবর-অস্থাবর স্মৃতির থিতানো চলচ্চিত্রে। প্রায়ই বলো ও কথা, ‘দেখেছি তোমার হৃদয়ে জিয়ল মাছের সন্তরণ।‘ 

মনের মোহন কায়াকে ছায়ারা ছেড়ে গেলে, তুমি কি প্রেরণাস্থানীয় বৃক্ষ? ওখান থেকে তোমার অজান্তে কিছু চিরহরিৎ পাতা লুকিয়ে রেখেছিলাম আমার প্রকারন্তরে। খুবখুব মনে আছে। 

থেকে-থেকে কারো কি মায়াবী মানসে দিয়ে আছি ডুব? সাঁতার তো শিখি নাই! স্মরণে হরিতকীর স্পষ্ট অস্তিত্ব ভাপ-ওঠা ভাপাপিঠার সরলবর্গীয় গন্ধে মিশে একাকার। গরম ভাতের বাষ্পীভূত উষ্ণতাতে এক-লহমায় ভ্রমণ করি অগোচরীভূত দশদিক। 

পোশাকহীন খাসজমির দাম্ভিক ঘনিষ্ঠতা কুমোরবাড়ির উঠোন পর্যন্ত পৌঁছায় না। অবহেলার স্থূল শিঙের পাশে বিনীত ভঙ্গীতে পড়ে-থাকা ধূলি-পরিহিত কানাকড়িটা নিজেকে মোহর ভাবতে শেখে নি। শেখে নি অভিনয়বশত কোনো ভৈরবী সংলাপ, যা তাকে উচ্চস্থানীয় বলে জাহির করবে। শুশ্রূষা কোনো ডাবের নির্লিপ্ত জল? গলধকরণ করলেই কণ্ঠনালীতে প্রশান্তিময় কুয়োতলার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। ভাঙাকুলোর ব্যস্ততাতে লালিত ভঙ্গুর শিরা-উপশিরাগুলো যেন তখন নকশি হাতপাখার সাদৃশ্যে কোমর দুলাতে থাকে। চেতনে-অবচেতনে গুঁড়ি মেরে বসে-থাকা একটা যদুবংশী মই সবসময় আমার পিছু লেগে আছে। বলে, ‘ওপরে ওঠো।’ ওপরে উঠে আবার নিচে নেমে আসি দলছুট কোনো ঝরাপাতার প্রণিধান নিয়ে। 

অপ্রধান হাতের অনভ্যস্ত মুঠি থেকে ফসকে-যাওয়া ময়ূখমালী অপদেবতার কোনো কুশপুত্তলিকা পাঞ্চালী পাকদণ্ডির কোথাও খুঁজে পাই না আর। কবে স্বাবলম্বী হব ফিঙেদের উড়াল অনুকরণে? দেখেছি সোনালিদির প্রশান্ত চোখে নীলনীল ঝড়ের হরিণাত্মক চঞ্চলতা। শর্তহীন পরিধির বর্তুল অন্দরে ছটফট-করা নিরন্ন বিন্দুগুলো সম্মিলিত প্রয়াসে শরদিন্দুর লক্ষ্মী ফড়িঙ হতে পারত। নবজাতক কোনো ধনুকের তীর হতেও বাঁধা ছিল না। 

সাদাসিধে বাঁশির কণ্ঠে নজরুলের পদ্য মুখর হতেই, সকালের একফালি রোদ দুপুরের অলিন্দে ভুলবশত প্রবেশ ক’রে লজ্জায় দিঘিতে পদ্ম হয়ে ফুটে রইল। 

বিসমিল্লাহ খার চিরায়ত সুরগুলোকে জংলা জলে পরিশীলিত পাখির মুসৌরী খ্যাত নীড় ভেবে সংগোপনে কুড়িয়ে নিয়ে যায় কে ওই যক্ষের সন্ধ্যামালতী বউ? হাঁ-করা বোয়ালের মাংসাশী আগ্রহ ছুঁড়ে দিয়ে কাঙাল ধুলোবালি শস্যক্ষেতে ধূসরতার চাষাবাদ সারে। নিষিদ্ধ পল্লীতে বেড়ে-ওঠা সন্তের অনাকাঙ্ক্ষিত পুনর্জন্মের গ্লানি মুছে যায় অবাধ্য যৌবনের গান্ধর্ব অবগাহনে।

বেদনার মতো বেজে-ওঠা প্রমাণসাধ্য বাদ্যযন্ত্রের বংশগত বিশ্বাস– ‘বাড়ি-ফেরা মানে অর্থহীন তলোয়ারের খাপ।‘ কেরানী পেশাটা ভুলে পথিক পদবী পেতে একদিন উদ্ভট পথে-পথে ঘুরবে সংবৃত রোবটের দল। বিষের বীজ বুনলে গজিয়ে-ওঠা ফণা খামারের মালিককেও দংশন করতে পারে। রঙ্গমঞ্চে জল-ডাকাতের মতো সশস্ত্র পিপাসা একটি দ্বিমাত্রিক অভিযাত্রা। একদিকে অধিষ্ঠিত– কার্যকারণ হিসেবে তীব্র আকাঙ্ক্ষাতে পাড়ি। অন্যদিক আপ্লুত ঋণপ্রবণ বাস্তুঠিকানার শরীরসর্বস্ব টানে। 

সংবিধিবদ্ধ ঘড়ির আলটপকা তারল্যে নিদান ঘুম স্বপ্ন দেখার প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র। 

অপ্রাসঙ্গিক নিশিডাকে তুমি একদিন গুপ্তঘাতক নয় এমন মধ্যরাতে গলির মোড়ে চায়ের দোকানে চা খেতে বের হলে। চা খেতে বসে আবিষ্কার করলে– চায়ের দোকানটি একটি সদ্যসমাপ্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি। 

মিসিসিপি নদীর মতোই স্পর্ধিত আলিঙ্গন কি ফুলনদেবীর মগ্ন-অভ্যুত্থানে ভর করে ফোটা বৈষয়িক পারিজাত? মর্মকোষে সংগ্রহে-রাখা ময়ূরাক্ষীর ধীর ঢেউ এখনো ভালোলাগার মন্বন্তরে আমাকে সাতসাগরের গল্প শোনায়। চিত্রপটে জমানো মেঘ গাছ পাখিকে আজ একটু যথেচ্ছা ছড়ালাম নদীটার ওপাড়ে। বানান ভুলে পারদর্শী অভিমান তুলির অস্পষ্টতায় পড়ে রইল কিছু বিষণ্ণ রঙে মুখ গুঁজে। মন্ত্রের মূর্তি ধ’রে শব্দ হল বাতাসের জের।  

ঢের-ঢের লাউলতার অগোচরে ফসিল হয়ে-যাওয়া অনন্য পদচিহ্ন ছুঁয়ে কখনো নগ্ন বৃষ্টি ফুলতোলা চাদর! মদ্যপ বন্যার সম্ভোগে আদৃত পথ মেলট্রেনের উন্নাসিকতায় জর্জরিত। তবুও গুছিয়ে রাখে ঘাসফুলের উদ্গীরণ, রোদ্রে দ্রবীভূত ডালভাতের ঘ্রাণ। পর্ণমোচী সূর্যাস্তের নুয়ে-পড়া জেল্লায় ছবি তুলতে গিয়ে  মনে পড়ল– তোমার অন্য একটি নাম প্রজাপতি। 

কচুবনে পড়ে-থাকা অতি পুণ্যার্থী রোদের রগরগে ঘুঙুর পরে নিয়েছে অতিথি ঘুঘুরা। রঙভুক ডুমুরের পালিত ডাল ভাবছে– কখন কুড়াবে বৃষ্টির খোলস; শ্লোগান-প্রণীত জলের গৌড়ীয় আনচান? গয়না নৌকার সতর্ক প্রহরী বাতাসি কম্পনরা নতুন করে জন্ম নেয়। শেষবিকেলের কাকাতুয়ার কাছে ভিখিরির মতো চেয়ে নেবে কি সাম্প্রতিক আষাঢ়ে-গল্পের কাঁড়া আর আকাঁড়া অক্ষর?

নিরক্ষর বলেই কি, কর্কশ পদাঘাতে মুমূর্ষু পথদের আসলে নেই কোনো আশ্রয়শিবির? করুণ কাকের কণ্ঠ-চিহ্নিত উদ্বেগে ধুলোরা চিরকালই দাবিহীন? নদীমাতৃক দেশে মনিপুরী মেঘদের মাতৃভাষা শিখতে পাড়ি জমায় পরিযায়ী পাখিরা। দুপুরের তাঁবু চিরে সরালির ডানা থেকে খসে-পড়া শরণার্থী পালক আমার আঁজলাতে আশ্রয় নিলে, বিষণ্ণ বসতবাটি চলে যায় একটি লাল মোরগ আর এক-দঙ্গল মোরগফুলের দখলে। 

সফল রন্ধনপ্রক্রিয়ায় আজকাল আমার ক্ষুধার্ত দৃষ্টিরা নিজের এই বিশ্বস্ত চোখদুটোকে আচার বানিয়ে চেটেপুটে খায়। বিভিন্ন বৃষ্টির ফুলেল পরতে ভিজতে দেখেছি ক্ষণকালের মৌনতাতে কাবাব-হওয়া শিমুল-জারুলের মৌতাত; ওতে আশ্রিত অশ্রু-কাতরতা। তিতপুঁটির মগজে বিস্তার করে-থাকা মাথামোটা স্নায়ুতন্তুগুলো পরজন্মে তিমি হয়ে জন্মাবার স্বপ্নজাল বুনে চলে।

খুনখুনে শিলাঝড়ের ধৃষ্টতায় ভেঙে খানখান হোক বুকের স্বচ্ছ শূন্যতা। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার লেহনে মুছে যাক সচিত্র কৃত্রিমতার এলবাম। বজ্রের কাঁটাতারে শোভা হয়ে ফিরুক-না সকল নিঃসঙ্গতা। তিমির গোল পেটের মতো সন্ন্যাস পাঁচটি গুলমরিচের ঝাঁঝাল কাঁটাচামচে ফুস করে চুপসে যেতে কি পারে না? 

শস্যের লালাতে, লালার কাণ্ডজ্ঞানে হতবিহ্বল আলোর জলাশয়, জলাশয়ের আলো। সেখানে চোরাবালি বিছিয়ে বিষণ্ণতার পাটাতন নিদারুণ উদ্ধত। আর কত বিনা সমীকরণের নখে ক্ষতবিক্ষত, বেআব্রু হবে জীর্ণশীর্ণ বুড়িগঙ্গা? (চলবে…)

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন