দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ১০।।
হাতে হাত রেখেছি। সত্য সত্যের অনুগত হল। পুলকেপুলকে-গড়া পালকে রাখি নি কি প্রাণ? পাশে নিথর পড়ে আছে পানগুছি নদীর একটি প্রসঙ্গোচিত পাথর। আসলে তুমি যে-রকম, সে-রকমটি নও। তুমি ঘোমটাময় মায়া। কৃপাহীন মায়াবতীর মতো আঁখিতে স্বেচ্ছানির্বাসিত ছলনা রাখো না। মেঘের শিরা-উপশিরায় ফেটে পড়ল কার্পাস তুলো। তারপরেও বলি, তুমি মরমী মায়াবতী। তবে, মায়ার মরীচিকা নও।
পাহাড়ও বোবা হতে পারে না। আমি একতরফা চিৎকার করি। সে প্রতিধবনি ক’রে উত্তর দেয়। কোথায় চলেছি?– তা আমি জানতে চাই নি। জানতে চাওয়া হয়ত অর্থহীন। পেছনে ফেলে-আসা মান্ধাতা-আমলের দেবদারু বৃক্ষগুলো ক্রমে অচেনা হয়ে গেলে, আমার পা-ই ভরসা। গুরুদেবের গরিমা নিয়ে তারা আমাকে জানিয়ে দেয় আমি কোথায় চলেছি।
চলেছি সাঁওতালী একাগ্রতা-ঘেরা দিগন্তের দিকে। আলুথালু বাতাস সোচ্চার রোদের এককালীন খোলসগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাঢ় রঙ ছড়িয়ে দিল আকাশে। নৌকাটে রোদ কি রূপবান বাতাসের সদ্য ফেলে-যাওয়া কুলিন খোসাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাবে চপল পীরের আশ্রমে? মায়াময় আকাশ মায়া-সভ্যতার হারানো মুখরতা নিয়ে প্রবল প্রাংশু হয়ে আছে। পাখির প্রতিটি উড়ালই একেকটি তীর্থযাত্রা।
ভালবাসা কি তীর্থযাত্রার আমিষ জাতীয় প্রতিশব্দ? সেই তো এক-পৃথিবী, এক-নীড়ে ফিরে আসা!
একজন পর্যটকের গৃহে ফিরে আসার জন্যে আত্মজীবনী লেখা জরুরি নয়। জলছাদের মতো অর্বুদ স্তব্ধতা নিয়ে একটি ত্রেতা মেঘ নেমে এল যন্ত্রণাকাতর নগরের কাছাকাছি আঁধারের ভঙ্গিমায়। বৃষ্টি হবে-হবে। কে সে মায়ান নারী? দাঁতের দেয়ালে ফুল আঁকা চর্চা করতে-করতে ভেবেছিল একদিন সে সজনে ফুলের বর্গ-বিশেষজ্ঞ হবে!
দাঁতাল বাবলাকাঁটাতে বিদ্ধ বেড়ালের থাবা অবসর খোঁজে। আর গৃহস্থের কুড়িয়ে-আনা কুকুরছানাটাও কেমন যেন রাতারাতি জ্বলন্ত যুবক হয়ে উঠল। খেজুররসের নীরবতায় আবিষ্ট সুড়িপথের পাশঘেঁষা ঢেঁড়স গাছটাতে সোনালি ফড়িঙ দেখলেই, বিকেলের রোদ গোধূলিকে ডেকে এনে শুকতারার খোঁজখবর নেয়। এর সবটাই ফাঁকি নয়! অধীরকে বলো, সে যেন নদীর কাছ থেকে প্রাসঙ্গিকভাবে স্থির থাকার পঙক্তিমালা শেখে। আজ পাখিবার। ইন্দ্রনীল এ দিনে সারাবেলা প্রিয় পাখিদের গান শুনেশুনে কাটাব। ব্যতিক্রম শব্দটি বড়ই আলঙ্কারিক! বটের ছায়াও কখনো-কখনো বনষ্পতি হয়ে ওঠে।
লালমুখীর ঠোঁট পক্ষপাতশূন্য নিশানের তোয়াজহীন ঝিলিকে মেতে উঠেছে ব্যাকুলতায়। ভাবে– এই বুঝি মোরগ ফুল হয়ে পাতাদের মাঝে প্রশংসিত লাবণ্য ছড়াবে। মহুয়ার বনে মাতাল বাতাসের তাণ্ডবে ঘাড়-মুচড়ে যাওয়া আলোছায়াদের মূক হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। লোলুপ হতাশারা সিনেমা-প্রেমী মাকড়সার অভিনয়ে পারদর্শী। জালের কুচকাওয়াজে দুমড়ে যায় সাঁতারে অদক্ষ আশারা। ছাইকুড়ানির কাছে নিভে-যাওয়া চুল্লী তো অমূল্য গন্তব্যস্থল। অন্যদিকে পড়োবাড়িতে আগন্তুকের ব্যস্ত পায়ের ছাপে ঢেকে যায় হাতেম তাই পিঁপড়েদের পদচিহ্ন।
ভীমগড়ার ব্যতিব্যস্ত ঢোলের উদাসিন কর্তব্য নিয়ে শুকনো বাঁশপাতাদের অর্বাচীন চিৎকার দ্বিমত করতেই পারে। প্রত্ন প্রশ্নপত্রে থাকতেই পারে– কোন জন্মে দেয়ালঘড়িরা বাবুই পাখি ছিল? তাই বলে কি সারেঙবাড়ি হৃদপিণ্ডে পুষবে না বিরহ? তেঁতুলের জলে-ধোয়া প্রত্যাশারা আবার বৃষ্টিতে ভিজে গেলে রোদের ফুসফুস হয়। জঙ্গলমহালের কোলঘেঁষা কুমার বাড়ির মেয়ে কলসির কানা গড়তে-গড়তে আসন্ন রাসমেলার গীতগুলো ঝালাই করে নিল। চড়ুইভাতিতে বিভোর কিছু সরলরেখা সংগ্রহে রাখা ভালো। অবিমিশ্র বৃত্ত আঁকতে গেলে বক্ররেখারা বড্ড বেশি সারকাস করতে পছন্দ করে।
না-বলা গল্পের মতো বিপ্লবী বৃষ্টির শার্সিতে লেগে থাকে রঙদার সিংহের স্নিগ্ধ রেখা। চকের প্রভূত মরা-চামড়া ঘষেঘষে পরিত্যক্ত ব্ল্যাকবোর্ডের নিরেট আঁধারে তুলে রাখি একটি অচেনা চাঁদের আঁকিবুঁকি। ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরার অলস মুহূর্তে হঠাৎ প্যান্টের ডান পকেটে দেখি– পড়ে আছে একগুচ্ছ দুরন্ত দৌড়। যমুনার উমে বৈশালী এক সদগোপী যেন প্রাঙ্মুখ পদ্ম হয়ে ফুটে আছে নিভৃত কোটরে। সে কী! হযবরল আলোকসজ্জার চমৎকারিত্বে সাজানো দিনগুলো কেমন তাড়াতাড়ি বদলে যায়।
বদলে যায় নির্বাচনী উত্তেজনায় উন্মুখ গ্রাম। শহর। দেশ। মহাদেশ। একেকটি পৃথিবী।
‘পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে।‘ বাংলাদেশ বিমানের লোগোতে জুড়ে-দেয়া এই সমীচীন কথাটা আমাকে খুব ভাবায়। আকাঙ্ক্ষা কি কখনো অন্ধকূপের মতো প্রবল? ভাবি স্ক্লারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাব। কাচের বয়ামের অবয়বে কল্পনারা খুব রক্ষণশীল! সেখানে উত্তর-কাঙাল কিছু প্রশ্ন গুইসাপের উপযোগিতায় ছটফট করে মরে। কোথায় যাব? কানাডায়? যেই ভাবা সেই কাজ। বিন্ধ্যপর্বতের বিশালতা-সমৃদ্ধ আশা নিয়ে আবেদন করলাম। ছয় মাসের মধ্যে ওয়াটার লু ইউনিভারসিটিতে স্ক্লারশিপ নিশ্চিত। আর পেছন ফিরে তাকাবার সময় নেই।
একসময় হাটখোলা চিলেকোঠায় বসে চাঁদহীন আকাশে নিরঙ্কুশ তারা গুনেছি। কে যেন বলেছিল, ‘যত বেশি তারা গুণতে পারবি তত তোর নিষ্কলুষ আয়ু বাড়বে।‘ আয়ু বাড়ানো? মোটেও তা নয়। আমার তারা-গোণা ছিল নিষ্কাম। আহা কী চমৎকার আংরা আকাশে তারাদের পায়চারী! এভাবে পাহাড়িয়া আঁধারে বৈঠকী তারা গুণতেগুণতে ধুন্ধুমার শিখে গেলাম ওদের নিগূঢ় অবস্থান। কাকে কোথায় কখন দেখা যাবে– সব ঠা ঠা মুখস্থ।
পাতাল-রেলের কাঁটা-কাঁটা নিস্তব্ধতা থেকে উঠে-আসা রূপশালী তারাদের আবার সহজাত প্রবৃত্তি হল মানবপ্রবৃত্তি। অর্থাৎ তারারা নিঃসঙ্গ অবস্থান করতে পারে না। মানুষের মতো দলে বিভক্ত হয়ে জোটবদ্ধ অবস্থান করে। যেমন এক-একটি খানদানী দলের নাম হল কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডলী, বকমণ্ডলী ইত্যাদি-ইত্যাদি। রাশভারী কালপুরুষের কথাই ধরা যাক। খইয়ের সরসতায় কালপুরুষের তারারা শিকারি-আকৃতির বিশদ রেখাতে অবস্থান করে। দেখে মনে হবে রামকিঙ্কর-গড়া মূর্তির মতো এক উদগ্রীব শিকারি শিকারে উদ্ধত।
দেখতাম – তোমার নিভৃত কামিজের প্রান্তিক রেখাতে বাতাসে-ঝুলে-থাকা একগুচ্ছ বকের মতো কিছু রুপোলি সেফটিপিন দুলছে। বকেরা যার-পর-নাই ধৈর্যশীল। এককথায় গোঁড়া লক্ষ্যভেদী। তুমি বলেছিলে, ‘জীবনের লক্ষ্য শুধু একটাই– অনেক-অনেক মেরুন ফিতে আর প্রজাপতি-ক্লিপ জমানো।’ আসলে জীবনের মানে একেক সময় একেক রকম হয়ে দাঁড়ায়।
জোঁকের ধৃষ্টতায় আদৃত লোভ বা মোহ আমাদেরকে হাত ধরে নিয়ে যায় রাক্ষসদের ডেরায়। পুনরুক্তিজাত রাক্ষসরা আমাদেরকে লালনপালন করে। খাইয়ে-পরিয়ে ওদের শিস্য করে গড়ে তোলে পলকে। কৃতজ্ঞতাবশত আমরা ওদের নিতান্ত ভৃত্য। রাজমিস্ত্রির দক্ষতায় ফাইফরমায়েস খাটি। ফরমায়েসি শিক্ষাদীক্ষা আমাদেরকে সর্বগ্রাসী করে তোলে। ক্রমশ নিজের অজান্তেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসে পরিণত হই।
সেই রূপকথার রাক্ষসের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। গল্পটা তুমিই বলেছিলে। এক-রাজ্যে ছিল ভয়ঙ্কর এক-রাক্ষস। সে ছিল প্রায়-অমর। তাকে যতবারেই মেরে ফেলা হত ততবারেই তার জাহাঁবাজ রক্তের ফোঁটা থেকে একাধিক রাক্ষস জন্ম নিত। তাই বলে কী কোনো আশা নেই? কুরুক্ষেত্রের সকণ্টক উদ্বিগ্নতায় ভরসার পাট কি চুকে গেছে? যে-ভরসা করে কোকিল কাকের বাসায় কষ্টসাধ্য ডিম পেড়ে আসে (এই ভেবে যে একদিন কাকই তার সন্তানকে দেখেশুনে রাখবে), সে-রকম ভরসা আমদের ভাগ্যরেখাকে যেন আর কলঙ্কিত না-করে। একমুঠো শুদ্ধ শস্যবীজের মতো দৃঢ় আত্মবিশ্বাসই আমাদের ভরসার মূল আশ্রয়স্থল হতে পারে। (চলবে…)