উত্তর-পশ্চিম কর্ণারের দুই চেয়ারের ঐ টেবিলটা আমার বেশ পছন্দের। আর এ কারনেই ছুটির সকাল গুলোতে এই কফিশপটায় আসা। দেয়ালের সাথের চেয়ারটায় বসলে দোকানের দুই তৃতীয়াংশের বেশী কাস্টমারকে চোখে পড়ে। প্রায়শঃই চেয়ারটা খালি পাওয়া যায়। দু’টা টেবিল পরে উল্টো পাশের দেয়ালে দুই চেয়ারের অন্য টেবিলটায় বলা যায় সবসময়ই একজন বয়স্ক মহিলা বসে থাকেন। হয়তো মধ্য ষাটের আশেপাশে হবেন উনি। একটা কফি নিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। কফি পানের চেয়েও তার দুহাতে ধরা উল বুননের কাঁটার দিকেই মনোযোগটা বেশী মনে হয়। শপে ঢুকেই পছন্দের ঐ টেবিলটায় তাকিয়ে দেখলাম একজোড়া যুবক যুবতী ওটা দখলে নিয়েছে। পাশের টেবিল থেকে একটা বেবি চেয়ার টেনে এনে বসতে দিয়েছে বছর চারেক বয়সী শিশুটিকে। হয়তো ওদের ছেলে। লম্বা ছুটির সপ্তাহ বলেই আজ এতোটা ভিড় মনে হচ্ছে । দ্বিতীয় পছন্দ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম মাত্র তিনটি আসন এখনো খালি আছে এবং তার দু’টি হলো সাত/আট জনের বড় যে গ্রুপটি খুব জোরে সোরে কথা এবং হাসি ঠাট্টা করে চলছে তারই পাশে। এই সময়টায় আমি যে উদ্দেশ্যে এখানে আসি তাতে ওখানে বসার কোন মানে হয় না। ঐ উলের শিল্প হাতে মহিলার সামনের চেয়ারটাই হলো তাহলে একমাত্র অপশন। আমার সামনে আরও একজন কাস্টমার। জানি না সওদাটা সেরে সে বেড়িয়ে যাবে না ওরই কোন একটা চেয়ার নিয়ে বসবে? সিদ্ধান্ত নিলাম মহিলার সামনের চেয়ারটা যদি তখনো খালি থাকে তাহলে হয়তো ওখানে বসা যেতে পারে। তা না হলে গাড়ি। পার্কিং লটে বসে দু’একটা গাংচিল এর জীবনচরিত পাঠ করতে করতে আজকের সকালটা কাটিয়ে দেয়া যাবে।
বহু সংস্কৃতির দেশ। কাছাকাছি বসা দু’জন মানুষের মাঝে কিছু সময়ের জন্যে বরফ শীতল নীরবতাকে এখানে কেউ তেমন কিছু মনে করে না। আমিও অনেকটাই তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর প্রযুক্তির প্রাসারতা তো পৃথিবীর মানুষ গুলোকে সব একেকটা নিঃসঙ্গ দ্বীপেই ঠেলে দিয়েছে! কফির কাপ হাতে নিয়ে আমি ঐ একাকী মহিলার টেবিলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—
চেয়ারটায় বসার জন্যে তোমার কি কেউ আছে?
সে খুব সপ্রতিভ ভাবেই বললো ওহ্—না না তুমি বসতে পারো।
আসনটা নিয়ে আমি ট্যাবলেট বেড় করে অর্ধ সমাপ্ত একটা লেখার সূত্র মনে করার চেষ্টা করছি। খানিকক্ষণ দেখে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন—
তুমি কি লেখালেখি করো?
বললাম এই মাঝেমধ্যে একটু আধটু চেষ্টা করি। বলতে পারো সময় ক্ষেপণ (Time Pass)।
কি বিষয় নিয়ে লেখো?
তেমন নির্দিষ্ট কিছু নয়, তবে প্রধানত কবিতা, মাঝেমধ্যে ছোট গল্প এবং নিবন্ধ।
কোন ভাষায় লেখো?
বললাম আমার মাতৃভাষা বাংলা, তবে ইংরেজিতেও মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি।
আমি কি পড়তে পারি?
আমার কয়েকটা লেখা গুগলে খুঁজলে পাওয়া যায়। আমি তারই একটার শিরোনাম চিরকুটে লিখে দিয়ে বললাম এটা গুগলে পাবে। তুমি চাইলে আমি পরে আরও লিংক দিবো।
এমন সব ক্ষেত্রে আমি সাধারণত কারোর ব্যাক্তিগত বিষয়ে কিছু জানার জন্যে আগ্রহী হই না। কিন্তু শুধু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাওয়া কতোটা শোভন এই ভেবে জিজ্ঞেস করলাম—
আমি প্রায়শঃই তোমাকে এখানে দেখি, বিশেষ করে এই টেবিলটায় তুমি বসো। তুমি কি দীর্ঘদিন ধরে এই কফিশপে আসো?
তা বলতে পারো। প্রায় সতেরো / আঠারো বছর। বলা যায় এটার জন্মলগ্ন থেকেই।
তখনো কি একা আসতে?
একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলা বললো, না। আমার হাসব্যান্ড সাথে থাকতো।
উনি এখন?—
প্রায় তিন বছর হতে চললো ও পৃথিবীকে ‘বিদায় (Goodbye)’ বলেছে!
বললাম, আমি খুব দুঃখিত, বিষয়টা হয়তো তুমি এই সময়ে মনে করতে চাওনি!?
নাহ্– দুঃখিত হবে কেন? এটা তো একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন। তাছাড়া এই চেয়ারটায় বসে তো তোমার ঐ চেয়ারটায় বসা সেই তাকেই আমি স্মরণ করি!
কেমন একটা অস্বস্তি খেলে গেলো শরীরময়। বললাম, ওহ্— আমি কি তাহলে?–
নাহ্– তা করতে যাবে কেন? বরং তোমার সাথে কথা বলতে আমার এখন বেশ ভালো লাগছে!
একটা স্বয়ংক্রিয় মেশিনের বোতামে চাপ দেয়ার পরে তা যেমন চালু হয়ে যায় অনেকটা যেন তেমনই ভদ্রমহিলা সময়ের কনভেয়র বেল্টে চড়ে বসলেন। ওটা চলছে তার স্মরণের পথ ধরে। যা বললেন তার সংক্ষিপ্ততম সারমর্ম দাঁড়ায়—
এখান থেকে এক কিলোমিটারের মতো দূরত্বে ঐ যে রেস্ট হেভেন সেমিটারী (Rest Heaven Cemetery), ওখানেই শুয়ে আছেন তার পরলোকগত স্বামী, জেফ কার্টার। প্রতি ছুটির দিনে এবং কখনো কখনো অন্যদিনও উনি তার সমাধিপাশে একটা ফুল রেখে আসেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কেমন দ্রুত চলে গেলো চল্লিশ বছরের ও অধিক সময়! অথচ এখন এক একটা দিন যেন কাটতেই চায় না!
বললাম চল্লিশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের কি ভালোবাসার বিয়ে ছিলো?
এবার সে যেন একেবারেই নিমজ্জিত হয়ে গেলো! বললো, জ্বী। ভালোবাসা তো বটেই, বলতে পারো ইলোপ করে।
বললাম কেন?
কার্টার তো আফ্রিকান কানাডিয়ান ছিলো। ঐ সময়ে এমন সম্পর্ক এতোটা সহজ ছিলোনা। বিশেষ করে আমাদের ককেশীয় পরিবারগুলো এটাকে খুব ঘৃণার চোখে দেখতো!
তোমরা পরস্পরকে চিনলে কি করে?
আমরা একই অফিসে কাজ করতাম। ও অন্য বিভাগে একটা ছোট পদে কাজ করতো। খুব ভালো মানুষ বলে ওকে আমার ক্রমশ ভালো লাগতে থাকে। খুব স্বাভাবিক কারনে আমিই ওকে প্রস্তাব করি। সবকিছু ভেবে প্রথমটায় ও খুব দ্বিধান্বিত ছিলো। বিশেষ করে আমার কথা ভেবে। কিন্তু আমি খুব— বুঝতেই পারছো আমি খুব করে চাইতাম ওকে। যতোদিন ছিলাম একসাথে একদিনের জন্যে ও আমার মনে হয়নি আমি ভুল করেছি!
তোমাদের পরিবার কি শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলো?
তেমন ভাবে কখনোই না। তিন ভাইবোনের আমিই বড়। মা-বাবা দুজনেই প্রথমে ক্ষিপ্ত পরে মুষড়ে পড়েছিলেন। তবে বাবার কষ্টটা খুব বেশী হতো বুঝতে পারতাম। বছর দুয়েক পর থেকে মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেতেন। পরে মাকে নিয়েও আসতে শুরু করলেন। তবে তখনো বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন না। আমিও কখনো আগ্রহ দেখাই নি। এটুকু স্বাভাবিক হতে আরও প্রায় বছর পাঁচেক লেগে গেলো! শুধু পরিবারই বা বলি কেন? অফিস, সমাজ সব ক্ষেত্রেই তো সমস্যার মুখোমুখি হতাম!
বললাম, ভালোবাসার জন্যে তোমার ত্যাগ অপরিসীম। মিস্টার কার্টার খুব ভাগ্যবান মানুষ ছিলেন!
একটু হেসে বললেন, তা হয়তো ঠিক, তবে আমি বিষয়টাকে ওভাবে দেখি না। প্রকৃতপক্ষে আমিই তো ওকে আমার সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছি। বলতে পারো এটাই তো সবচেয়ে বড় বিনিময়। ত্যাগটা দু’দিকেরই।
কথা শুনে আমি কয়েক মূহুর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম! তারপর হাতের বিনুনি রত কার্ডিগানটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার জন্যে?
ওহ্—এটা হলো আমার ছোট নাতনীর জন্যে। আসছে দশই এপ্রিল ওর তিন বছর হবে।
বললাম চমৎকার বিষয়। আমার মায়ের ও এটা একটা নেশার মতো ছিলো। আমাদের সব ভাইবোনের জন্যে বানাতেন।
সে বললো এ কাজটির একটি সুবিধে হলো একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে খুব বেশী মনোযোগ দিতে হয় না। তোমার হাত চলছে কিন্তু মনোজগতে তুমি আরেকটি জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছো।
বললাম বিষয়টা আমি এখন বেশ অনুধাবন করতে পারছি।
উনি বললেন দেখো জীবন হলো একজন শিল্পীর হাতে ছবি আঁকার ক্যানভাসের মতো। তার সব স্বপ্ন, সব কল্পনা এবং জীবন বোধকে তিনি তুলে আনার চেষ্টা করেন সেখানে। কিন্তু একটা সময় পরে সেখানে নূতন করে আর কিছু করার থাকেনা। তার তুলির ভুবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। তখন সে কেবল তার আঁকা ক্যানভাসেই ফিরে ফিরে তাকায়! একদিন যখন আমাদের স্বপ্ন জগতের আলোগুলো একে একে নিভতে থাকে, তখন আমরাও ঐ শিল্পীর মতো পেছনের জীবনে ঘুরপাক খেতে থাকি!
বললাম তুমি একদম ঠিক বলেছো।
আমার কফি কাপের তলানিতে এসে পড়েছে। একটা সৌজন্য বিদায় জানিয়ে উঠবো ভাবছি তখনি তিনি জিজ্ঞেস করলেন—
তোমার ব্যাক হোম কোথায়?
বললাম বাংলাদেশ। নিশ্চয়ই নাম শুনেছো?
বললেন অবশ্যই। তবে খুব বেশী কিছু জানিনা তোমাদের দেশ সম্পর্কে।
আমি একটু ধারণা দিয়ে বললাম, গত শতকের শেষ দশক থেকে আমরা এখানে বেশী সংখ্যায় অভিবাসী হতে শুরু করেছি। এর আগেও অনেকে এসেছে তবে সে সংখ্যাটা খুব বেশী নয়।
উনি বললেন, তোমাকে তো সবসময় একাই দেখি, তুমি কি একাই থাকো এখানে?
বললাম, না। আমি, আমার আমার স্ত্রী এবং আমাদের দুই কন্যা।
তোমরা একসাথে কখনো বের হও না? সরি এটা একটু ব্যাক্তিগত প্রশ্ন!
বললাম না না– সরি বলার কিছু নেই। অবশ্যই বের হই। তবে ছুটির দিনগুলোতে সবাই একটু দেরীতে বিছানা ছাড়ে। আর সপ্তাহের এ সময়টুকু আমি লেখালেখির জন্যেই নেই, তাই একাকী–
এ জায়গাটা তো তেমন নীরব নয়, লেখালেখির জন্যে তুমি এমন পরিবেশ বেছে নাও কেন?
একটু হেসে দিয়ে বললাম, আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতিই এর প্রধান কারণ বলতে পারো।
সেটা কেমন?
বললাম, আমাদের বাসাটা নিশ্চিত ভাবে এর চেয়ে অনেক নীরব, কিন্তু লেখার মানসিকতা বা আবেগ যা ই বলো না কেন, তার জন্যে আমার মধ্যে একটা তীব্র একাকীত্বের অনুভূতি আসতে হয়। বাসায় নিভৃতে থেকেও এই অনুভূতির মাত্রা ঐ পর্যায়ে উঠে না। চূড়ান্ত হিসেবে পৃথিবীতে আমরা তো একা, এই অনুভূতিটা আমার একটা অপরিচিত জন অরণ্যের ভীড়ে একা এক কোণে বসে খুব ভালো আসে। আর এমন অনুভূতিতেই কেন জানি আমার কলম ভালো কাজ করে।
কথা শেষ করে মহিলার চোখের বিস্ময় পড়তে আমার এতটুকুও অসুবিধা হলো না!
একটু চুপ থেকে বললেন তোমার লেখা পড়ার আগ্রহটা আমার আরও বেড়ে গেলো!
বললাম অবশ্যই পড়বে, এটা আমার আনন্দ। তুমি চাইলে আমার যে কটা লেখা ইংরেজিতে আছে সেগুলো তোমার জন্যে নিয়ে আসবো। বলে উঠে দাঁড়ালাম।
মহিলা বললেন অবশ্যই আনবে। আর এরপরে তোমার পছন্দের ঐ চেয়ারটা যদি না পাও তবে এখানে বসতে কোন দ্বিধা করো না। একটু হেসে দিয়ে বললেন, চিন্তা করোনা আমরা পরস্পর আগন্তুক এর মতোই থাকবো যতোক্ষণ না তোমার লেখা শেষ হয়।
বললাম, আমার মনে থাকবে। তুমি ভালো থেকো!
সুন্দর। স্মৃতিময় সময় কাটানোটা অর্থবহ।