(গল্পের চরিত্র ও ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক হলেও বিষয়বস্তু বাস্তবধর্মী)

তিথির সাথে তমালের দাম্পত্য সম্পর্কের ভয়াবহ ধরণের অবনতি ঘটলো। ভয়াবহতা এতটাই ভয়ঙ্কর রূপ নিলো যে এ যাবৎকাল স্বপ্নের ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় এসে তমালের এই সংক্ষিপ্ত ইমিগ্রেশন জীবনে যত শত শত শত তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তা সব কিছুকে ছাপিয়ে তমালকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিয়ে গেলো।

তমালকে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে পুলিশের ভ্যানে তোলা হচ্ছে। আজ তমালের বন্ধু পরাগের সাবলেটে থাকা তমালদের বেড রুমে এই কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটি এই পৃথিবীতে অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে যে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে তারই সর্বশেষ উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে আসা নিউ ইমিগ্রান্টদের কাছে একটি শিক্ষামূলক ঘটনা হিসাবে থেকে যাবে। কিন্তু তমালের এই গ্রেফতার হওয়ার কাহিনীটি কানাডায় বাংলাদেশী কমিনিউটিতে মুখরোচক খবর হয়ে সবার মুখে মুখে যে বিদ্যুৎ বেগে মুহূর্তেই রটে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে করে তমাল-তিথিদের সামাজিক মর্যদা, খানিকটা ক্ষুন্ন হলেও তাদের দাম্পত্য জীবনে যে অপূরণীয় ক্ষত তৈরী হলো তা এই এতো বড় টরেন্ট শহরের হাজার হাজার ব্যাস্ত বাংলাদেশিদের কাছে কতখানি গুরুত্ব বহন করবে তাতে বেশ সন্দেহ রয়েছে।

মুদ্রার যেমন এপিঠ ওপিঠ দুই পিঠই থাকে, তেমনি প্রবাসে ইমিগ্রান্টদের জীবনেও দুই পিঠ থাকে। হতভাগা তমালের জীবনে বিধাতার নির্মম পরিহাসে কেবল মুদ্রার একটি পিঠের দেখা মিললেও আরেকটি পিঠ একেবারে অধরাই থেকে গেলো।

মুদ্রার দুই পিঠের বৃত্তান্ত এই গল্পের পাতায় পাতায় বর্ণিত হলেও পাঠক, চলুন তমালের বেডরুমে ঠিক কি ঘটে ছিল তা বিস্তারিত শোনা যাক:
গত কয়েক দিন যাবৎ একেতো প্রচন্ড ঠান্ডা তার মধ্যে এজেন্সি থেকে কাজের জন্য কোনো কল না আসায় তমালের মেজাজ কিছুটা চড়া ছিল। এছাড়াও খুব কাছের বন্ধু পরাগের ৩৩৭ নাম্বার ফ্ল্যাটে সাবলেটে থাকার পর থেকে একের পর এক যে বিশ্রী কান্ড ঘটে যাচ্ছে তাতে এতদিনের পুরোনো বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তমালের মন গত কয়েকদিন ধরেই বেশ খারাপ। দুপুর প্রায় পৌনে দুইটার মতো বাজে। তিতাস এখনও স্কুলে। তমাল নতুন করে রিজুমি আপডেট করা নিয়ে কিছুটা ব্যাস্ত থাকায় তিথিকে বললো, ‘খুব খিদে পেয়েছে তিথি, খাবার দিবে?” তিথি ফ্রিজ থেকে ভাত, ডালের বাটি ও তিতাসের জন্য রান্নাকরা মুরগির মাংসের বাটি বের করে প্লেটে ভাত বেড়ে তার উপর কিছুটা ডাল ঢেলে দিয়ে ও মুরগির মাংসের খানিকটা ঝোল, দুই একটি আলুর পিস্ ও অতি সামান্য একটি হাড্ডিসার মাংস প্লেটের এক কোনায় রেখে মাইক্রো ওভেনে গরম করে কম্পিউটারে ব্যাস্ত তমালের পাশে রাখলো। ক্ষুধার্থ তমাল হাপুস হুপুস করে খেতে যেয়ে দেখে ডালের নিচে ভাত এখনো ঠান্ডাই রয়েছে। তমাল শুধু বললো, ‘প্লেটে আগে শুধু ঠান্ডা ভাত মাইক্রো ওভেনে আলাদা করে গরম করবে তারপর ডাল ও তরকারি আলাদা বাটিতে গরম করে ভাতের প্লেটে ঢেলে দিবে।’ এতেই তিথি তেড়ে উঠলো,’ওতো গরম গরম খেতে চাইলে ঘরে বসে না থেকে তোমার পরাগ বন্ধুর মতো কাজকাম কিছু করতে হবে। বাসায় কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকবে আর একটু পর পর বাইরে যেয়ে ভূস ভূস করে সিগারেটই খাবে তা চলবে না।’ এবার, তমাল কিছুটা পিছু হেটে গলার স্বর নামিয়ে বললো,’ হাড্ডির সাথে তো কোনো মাংসই নেই শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া যায়? একটি ডিম ভেজে দিলেইতো পারতে। এবার তিথি আগের চেয়ে আরও ঝাঁঝালো গলায় বললো,’ কোথাকার কোন নবাবজাদা এসেছে ডিম ভেজে খাওয়াতে হবে, আরে, এভাবে সরকারের বেকার ভাতার টাকায় এর চেয়ে ভালো কিছু জুটবে না এটা মাথায় ভালো ভাবে ঢুকিয়ে নাও।

ঝগড়া ঝাটির এ পর্যায় পর্যন্ত কিছুটা টিপিক্যাল মিডিল ক্লাস বাংলাদেশী ইমিগ্রান্ট পরিবারের মতো ছিল, কিন্তু ক্রমাগত কথার পিঠে পারস্পরিক উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় পর্বটি ক্রমশঃই নোংরা ঝগড়াঝাটিতে রূপান্তরিত হতে লাগলো। দুই পক্ষ থেকেই নানান রকম জন্তু জানোয়ারের নাম মুর্মুহু উচ্চারিত হতে লাগলো। এক পর্যায়ে তমাল যখন তুই তোকারিতে নেমে এসে বললো,’তোর চৌদ্দ ঘুষ্টির ক্ষমতা ছিল কানাডায় আসার? আমার জন্যইতো কানাডায় আসতে পেরেছিস।’ এতদিন দিনের পর দিন প্রবাস নিয়ে স্বপ্নে বিভোর তিথির স্বপ্নগুলি যখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে খান খান অবস্থা সেরকম সিচুয়েশনে হতাশ তিথি তমালের কোথায় উত্তেজিত হয়ে বাঘিনীর মতো তমালের দিকে ফুঁসে এলো। বোকা তমাল তার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম কাজটি করে বসলো, তিথির গায়ে হাত তুললো। তিথি অকস্মাৎ ভাব্যাচেকা খেয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও, তমালের আরেকটি জোরে ধাক্কায় তিথি মেঝেতে পরে যেতেই বেডের কোনা লেগে কপালের কেটে যেয়ে রক্তারক্তি অবস্থা। রক্ত দেখে দিকবেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তিথি পাশের ঘরে স্বামীর বন্ধু পরাগের রুমে ঢুকলো। পরাগ বাসায় ছিল না। পরাগের স্ত্রী বকুল দ্রুত তিথির কপালের ক্ষত জায়গায় ব্যন্ডেজ লাগিয়ে তিথিকে সান্তনা দিতে যেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। এই পৃথিবী কতই না রহস্যময়ী। এই কিছুদিন আগেও সাবলেটে থাকার বিভিন্ন ইস্যুতে এই দুই মহিলার মধ্যে বিরোধ থাকলেও আজ তাবৎ অত্যাচারিত নারী জাতির মুক্তির লক্ষে একাট্টা হয়ে পরিকল্পনা করছে কিভাবে তমালের এই অন্যায় আচরণের জবাব দেয়া যায়। এক পর্যায়ে, বকুলের পরামর্শে তিথি নাইন ওয়ান ওয়ান কল করায় ঝটপট সাইরন বাজিয়ে লাল নীল, হলুদ লাইট জ্বালিয়ে বকুলদের বিল্ডিঙের সামনে দুইটি পুলিশের গাড়ি চলে এলো।

পুলিশ তমালকে বিল্ডিঙের সামনে থেকে সিগারেট খাওয়া অবস্থায় গ্রেফতার করলো। পরাগদের হাইরাইজ বিল্ডিঙের সামনের দিকের ইউনিটগুলির জানালা, ব্যালকনি থেকে উৎসুক লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তিন জন পুলিশে কনস্টেবল হ্যান্ডকাপ হাতে তমালকে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বিলডিং এর ডান পাশে ভিজিটর পার্কিং লটের চারিধারে উঁচু উঁচু ঢিবির মতো তুষারের স্তুপগুলির একটি স্তুপের মাথায় দুইটি কুচ্কুচে কালো রঙের কাঠবিড়ালি তুষারের মধ্যে হুটোপুটি খাচ্ছিলো। দুইটির একটি কিছুক্ষন ডিগবাজি খেয়ে তর তর করে দৌড়ে আরেকটি স্তুপের দিকে যাচ্ছে, আরেকটি পুলিশের গাড়ির রঙিন লাইটের দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার তার সাথীকে অনুসরণ করে দৌড়াচ্ছে। তমাল পুলিশের ভ্যানে ওঠার মুহূর্তে সেই কাঠবিড়ালি দুইটির দিকে কিছুক্ষনের জন্য তাকিয়ে থাকলো আহা!! এই পার্থিব জগতের যাবতীয় দুশ্চিন্তা মুক্ত কী সুন্দর এদের জীবন।


ওদিকে ৩৩৭ নাম্বার ফ্ল্যাটে তিথি বকুলকে জড়িয়ে কেঁদেই চলেছে। বকুল ও তিথির দুই জনের কান্নার সুর একই হলেও বকুলের কান্নার কারণ হয়তো একজন অত্যাচারী স্বামীকে পুলিশের হাতে তুলে আত্মতৃপ্তি নিয়ে একজন অসহায় নিউ ইমিগ্রান্ট মহিলাকে সমবেদনা জানানো । অন্যদিকে, তিথির কান্নার পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে তার স্বপ্নের ইমিগ্রেশন এর সব রঙিন স্বপ্নগুলি শুধুমাত্র একে একে দাউ দাউ করে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েই যায়নি সেই আগুনের লেলিহান শিখা কত তুচ্ছ কারণে আজ তার সাধের সংসার জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো !!


বিয়ের পর থেকে তমাল কখনোই স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাতো দূরের কথা কখনো চ্যাচামেচি করেছে এমন কথা শোনা যায়নি। একই ভাবে বাংলাদেশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তিথি স্বামীতো দূরের কথা কখনো তার কোনো তার সহকর্মীদের সাথে বা কোনো ছাত্র/ছাত্রীদের সাথে কখনো কটু কথা বলেছে এমনটি একেবারেই শোনা যায়নি। কিন্তু এই স্বপ্নের কানাডায় এসে তাদের দুইজনের এই চারিত্রিক পরিবর্তন আজ যে ভয়াবহ রূপে আবির্ভুত হয়ে থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ালো তার জন্য তিথি দায়ী না তমাল দায়ী নাকি সরকারের নিউকামারদের সেটেলমেন্ট কর্মসূচি দায়ী তা নিয়ে তর্ক না করে সেটি উৎঘাটনের দায়িত্ব সমাজ বিজ্ঞানীদের উপর ছেড়ে দেওয়াটাই সম্ভবত যুক্তিসঙ্গত হবে ।

কিন্তু তমাল পুলিশের ভ্যানে থানায় যেতে যেতে সারা রাস্তা ভাবতে লাগলো এতদিন যে তিথির সাথে এতো বছর ঘর করলো সেই তিথির এই মারমূখী আচরণ তাকে কিভাবে উত্তেজিত করে আজকের এই অঘটন তাকে দিয়ে করিয়েছে। তমালের এই জীবনে পুলিশের গাড়িতে চড়ার অভিজ্ঞতা কখনোই ছিল না। কানাডায় আসার পর থেকে এতদিন যে Three “W ” এর খবর শুনে আসছিলো বাকি দুইটির সাথে আগেই সাক্ষাৎ হয়েছে আজ সর্বশেষ w এর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে ষোলো কোলা পূর্ণ হলো। সেই সাথে মনের অজান্তে সে আজ তার সংক্ষিপ্ত প্রবাসী জীবনের কফিনের বাক্সে শেষ পেরেক টুকু যেন গেঁথে ফেললো ।
—————–
(চলবে)

জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীনউদ্দিন.
রেজিস্টার্ড সোস্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, কানাডা,
জানুয়ারি, ২০২২

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“রেইকি”-স্পর্শচিকিৎসা-পর্ব ৪
পরবর্তী নিবন্ধভুলে যেতে চাই
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন