হটাৎ করে বাল্যবন্ধু পাইলটের সাথে দেখা হয়ে গেল, সিনেমা হলের পাশে ফুটপাতে
পাটি পেতে ফেরি করে রকমারি দ্রব্যাদি বিক্রি করছে।
তার পাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শরৎ চন্দ্রের দেবদাস, বড় দিদি, অনুরাধা, নব-বিধান,
নিমাইয়ের মেমসাব, ডেল কার্নেগির দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন,
নেতাজি সুভাষ বসু, নেড়ে মাথা মহাত্মা গান্ধী, বিপ্লবী চেগুয়েবার
নজরুল, রবীন্দ্রনাধ, স্বামী বিবেকানন্দের রঙ্গিন পোষ্টার,
সুন্দর বনের খাঁটি মধু, চোখে দেয়ার সুরমা, তালের টুপি, আতর।
শহরের এই দিকটায় দিনের কাজ শেষে ব্যাস্তমুখর সন্ধ্যায়
ফুটপাতের ঝাল মুড়ি, ডুব তেলে ভাজা গরম পিয়াজু, শিখ কাবাব
মাঘের কনকনে ঠান্ডায় বাড়তি মাত্রা পায়
আড্ডায শহরতলীর কত পেষার সব মানুষ কেউ বাদ নেই
ঔষুধ কোম্পনির রিপ্রেজেনটেটিভ, রাজনীতিবিদ নুতুন জয়েন করা ডাক্তার, কলেজের লেকচার মশাই
ভিড়ের মধ্যে থেকে পাইলট ঠিকই চিনে নেয় আমাকে, ‘আরে রন্জু তুই?’
আমি থতমত খেয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে
সেই কালো বেটে পাইলট, কনুই পর্যন্ত গোটানো শার্ট, থুতনির দিকে কাটা দাগ
মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল
কত আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করে, আমাদের ফাস্ট বয় পিন্টু, হ্যাংলা পাতলা টুটুল
চৌধুরী বাড়ির পেট মোটা নরেশ, হাসিম স্যারের ছেলে বকুল
একে একে সবার কথা জানতে চেয়ে
সারাদিনের ফেরি করে বিক্রির ক্লান্তি ছাপিয়ে বলে ,
‘হ্যা রে ওরা সব ভালো আছেতো ?
আমরা অর্থাৎ সামনের বেঞ্চিতে বসা ছেলেরা কজনেই বা মনে রেখেছি এই পাইলটকে !
আমরা যাকে পাত্তাই দিতাম না, ব্যাচারা ময়লা দুর্গন্ধময় কাপড় পরে
লাষ্ট বেঞ্চিতে একা একা বসে বাহিরে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো
গা থেকে উকুন বের করে কুটুস কুটুস করে মারতো
ক্লাসের কারো পেন্সিল, বই চুরি হলে, সহসাই পাইলটের ডাক পড়তো
‘প্রেজেন্ট ইনডিফিনেট টেন্সে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের শেষে এস বা ই এস যুক্ত হয়’
এই মহান কথাটি মনে না থাকায় পন্ডিত স্যারের নির্মম বেতের আঘাতেও দাঁতে দাঁত চেপে থাকতো।
আমি বিস্ময়ে বললাম, ‘তুই আমাদের সবার কথা মনে রেখেছিস কি করে ?
‘তোরা যখন সুন্দর ঝকঝকে জামাকাপড় পরে স্যারের সামনে
গড় গড় করে পড়া বলতিস, কি যে ভীষণ ভালো লাগতো রে
বুঝিসতো, আমাদের অভাবের সংসারে লেগেই থাকতো যতসব অশান্তি
ক্লাসে যখন থাকতাম, চোখে তখন রাজ্যের ক্লান্তি
সারা রাত জেগে জেগে আমি, বাবা আর মা তামাকের পাতা দিয়ে বিড়ির মুঠি বানাতাম ,
আর ক্লাস শেষে বাবার সাথে এদোকানে ওদোকানে ঘুরে ঘুরে সেই বিড়ির বান্ডিল বিক্রি করতাম,
পড়ার সময়ই পেতাম না, লাস্ট বেঞ্চিতে বসে তোদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম’
– ‘তো বিড়ি/সিগ্রেট বাদ দিয়ে ফেনসিডিল, গাঁজা অথবা ইয়াবা না বেঁচে
এসব হাবিজাবি বিক্রি করছিস যে ? এতে কতইবা পয়সা ?
-‘তুই যেগুলিকে হাবি জাবি বলছিস, এগুলি মোটেই সেরকম না
আমার বিক্রি করা প্রতিটি জিনিসের আলাদা মান আছে রে , তোরা এসবের কদর বুঝবিনা
মাষ্টার মশায়ের একেকটি বেতের আঘাতে আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম
আমি একদিন মানুষ হবো, সত্যিকারের মানুষ মানে দুটো পয়সা সৎ পথে থেকে করবো আয়
এই আমি, সারাদিন এসব বিক্রি করে যা পাই, মোটামুটি চলে যায় ।
যখন বাসায় ফিরি, মা আগ্রহভরে আমার আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে
তোর ভাবি একেক দিন একেক পদের রান্না করে
কোনোদিন, গরম ভাতে কালিজিরা ভর্তা, কোনোদিন, টমেটো দিয়ে আলু ডিমের ঘাঁটি,
কোনো দিন পুঁইশাক দিয়ে রুই মাছের মাথা, অথবা কাঁচা আম আর ডাল দিয়ে রাধা ডালের বাটি
মা, আমি, বাচ্চা/কাচ্চা সবাই মিলে এসব খাবারই কত মজা করে চেটে পুটে খাই
তোরা ভদ্দর লোকেরা এসব সুখ বুঝবিনা ভাই
আমি পাইলটের উপচে পড়া সুখ দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাই।
পন্ডিত সারের ইংরেজি, জহির স্যারের গণিত, বিজ্ঞান মুখস্ত করে
আমরা একেকজন যান্ত্রিক মানুষ হলাম, কেউ হলাম ডাক্তার, প্রকৌশুলি , এনজিও-র কর্মকর্তা
কেউ বা গভীর রাতের টিভিতে লাইভ টক শো’র তুখোড় বক্তা
অথবা কেউ বা বৈদেশিক প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পারি জমালাম অচিন ভিন দেশে
এতো বিদ্যা, এতো অর্থ তবুও কি মানুষ হয়েছি সব শেষে ?
পাইলটের মতো করে পেয়েছি কি সুখ, বিয়ের পরে খেয়েছি কি এক নলা ভাত মায়ের পাশে বসে?
(–জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীনউদ্দিন.
রেজিস্টার্ড সোস্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, কানাডা, জুলাই ৬,২০২০)