বক রাক্ষসের মত বিশালাকায় বই এর ক্ষুধা নিয়ে ঢু মারলাম কবি নাহিদা আশরাফীর বাস্তবায়িত স্বপ্ন “কবিতা ক্যাফেতে”। মনের মাঝে সুপ্ত বাসনা, এই শীতের অপরাহ্নে প্যান্ডেমিকের মাঝে কিছুটা সময় যদি গরম পানীয় ও বই এর সাথে কাটানো যায় তো মন্দ হয় না। এককাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি হাতে প্রেম করব কিছু বই এর সাথে। একান্তেই একটি চমৎকার দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে পূরণ করব “বাংলাদেশ বাকেট লিষ্টে” জমে থাকা সুপ্ত আকাংখা।মায়ের কাছে বহু মিনতির পরে অনুমতি পাওয়া গেল বাইরে যাবার। তবে শর্ত আছে, দাদাকে নিয়ে যেতে হবে বডি গার্ড হিসেবে। দাদা আমার বড় প্রিয়,তবু ঘ্যান ঘ্যান করাতে বই কেনার জন্য কিছু টাকাও পেলাম অনুমতির সাথে সাথে। দয়া করে ভুরু কুঁচকাবেন না। মায়ের কাছ থেকে ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেল করে বই কেনার টাকা উদ্ধার করাটাকে আমি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। তাই কোনওরকম অপরাধবোধ আমার মাঝে কাজ করে না। চললাম ফুল ও কাঁটায় ঘেরা কাঁটাবন।করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হালের ঠুলি মুখে পুরে ব্যাকপ্যাক পিঠে সোজা চলে গেলাম।
বিদেশে থেকে কি আর দেশি সাহিত্যর মজা বোঝা যায়? তবু আমার মত বিশিষ্ট ফকির, যারা বিদেশে বাংলা বই কিনে ফতুর হওয়ার পথে, তারা আত্মার টানে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ফ্রী অনলাইন বই খুঁজে পড়ে। দৃষ্টিশক্তির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে চশমার কাঁচ ও ভুঁড়ির সাইজ বাড়তে বাড়তে মৈনাক পর্বত হয়ে যায়। তাদের কাছে বাংলা বইসমৃদ্ধ একটি ক্যাফে স্বপ্নের মত মনে হয়।তাই যখন টরন্টো বসে প্রিয় কবি নাহিদা আশরাফীর মুখে প্রথম তাঁর “কবিতা ক্যাফের” কথা শুনি, তখন তাঁর চোখে মুখের উচ্ছ্বসিত আবেগ আমার মাঝে এক অবর্ণনীয় আগ্রহ তৈরী করে। তাই আমার “বাংলাদেশ বাকেট লিষ্টে” অন্যতম স্থান ধারন করে থাকে “কবিতা ক্যাফে”।
দুরুদুরু বুকে স্লাইডিং দরজা খুলে প্রবেশ করলাম আমরা দুজন। আমি আবার সাহিত্যিক ও কবিদের ভীষণ ভয় পাই। যারা এক একটি পৃথিবী মাথায় নিয়ে দিন যাপন করেন, তাদের সামনে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়। আমার মত মহা বাচালও মুখের শব্দ হারিয়ে ফেলে।তবে ঢুকতেই মনে হল আমি এখানে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি।ধুলি ধুসরিত ব্যাস্ত নগরীর নিরানন্দের মাঝে একটুখানি দম নেওয়ার মরুদ্যান। সবুজাভ সেই বই-অরন্য অশান্ত মনকে শান্ত করে নিমেষেই।ঢুকেই ঘোরাঘুরি। বিশালাকায় “কবিতা ক্যাফে”, সৌভাগ্যবশত একেবারে মধ্য দুপুর বলে একটু ফাঁকা। কাজে ব্যাস্ত একটি ছেলের কাছে চাইলাম দুকাপ কফি। আহা,ভালোবাসার কবিতার মত প্রাণচঞ্চল প্রথম চুমুক।বই এর কালেকশন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বহু ভালো বই রয়েছে। পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি নতুনদেরও সমানভাবে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তুলে নিলাম পছন্দের কিছু বই। আমার কাছে বই মানে লেখকের মস্তিষ্কের মাঝে তৈরী করা পার্থিব ও অপার্থিব জগতে বিচরন করা। কখনও সম্পূর্ণ অপরিচিত অজানা দুর্বোধ্য বিশ্বের ভয়াবহ জটিল সব রহস্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়া। আবার কখনও দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েনের মাঝে দোদ্যুল্যমান জীবনের কর্কশ সব কাব্যে আটকে পড়া মানুষ। আহা, পুরো পৃথিবী যেন গল্পে পোরা। বিষন্ন কবিতার গল্প, ঝলমলে জীবানুর গল্প, বিজ্ঞানের গল্প,নির্মম ইতিহাসের গল্প, রসাল রাজনীতি, শুষ্ক অর্থনীতি আরও কত কত বিশ্বের জানালা খুলে দেন লেখকেরা। আর আমার মত অলস, ঘুমকাতুরে পাঠকেরা কেবল সেই গ্লাসভর্তি সুমিষ্ট অমৃত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। তৃপ্তি এলেও তৃষ্ণা মেটে না। মনে হয় সবকিছু গবগব করে গিলে ফেলি।
বই এ ডুবে থেকে কখন যে যাবার সময় হল, বেচারা দাদা, বই হয়ত তাকে অতখানিও আনন্দ দেয় না যতখানি প্রিয় ভাবীর সান্নিধ্য দেয়। তবে বইগুলো ফেলে আসতে মায়া হল, মনে হল দত্তক নিই তাদের, নি:সন্দেহে ভালো মা হতে পারব। বই কিনে পেমেন্ট দেওয়ার সময় স্বভাবসুলভ দুষ্ট চিন্তা উঁকি দিল মাথায়, হ্যাংলার মত মনে হল যার কবিতা এত প্রিয় সেই কবির অটোগ্রাফ যদি নিতে পারি। অনুরোধের পরে সাক্ষাত পেলাম “কবিতা ক্যাফের” কর্ণধার এবং দুই বাংলার অন্যতম গুনি কবি নাহিদা আশরাফীর। দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বিস্তারিত পরে বলব। কাব্যিক কিছু শুভেচ্ছা বার্তা লিখে দিলেন অটোগ্রাফের সাথে সাথে। আর পেলাম কবির নিজের পছন্দ করা কিছু বই।
আনন্দ এবং আহ্লাদে আটখানা হয়ে সমাপ্ত হল আমার প্রথমবারের “কবিতা ক্যাফে” ভ্রমন।
বাংলা সাহিত্য,কবি, কবিতা, আড্ডা, নির্মল পরিবেশের সাথে সুস্বাদু খাবার ও চা কফি যারা পছন্দ করেন, আমি অনুরোধ করব অন্তত একবার হলেও ঘুরে আসতে। আর কিছু না হোক, বাংলা সাহিত্যর বর্তমান অবস্থা জানার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। তা নাহলে আপনার পড়ুয়া বান্ধবীর সাথে একটি চমৎকার বিকেলের গ্যারান্টি তো দিতেই পারি।