-মোঃ মনিরুজ্জামান / টরন্টো থেকে:-
গত মাসে বাংলাদেশে দু’ সপ্তাহের জন্য বেড়িয়ে এসেছি। দেশে অনেক গুলি জরুরি কাজের জন্য যেতে হয়েছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশে এখন অর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে সব পরিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে অনেক কথাই লেখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখেছি অবনতি। এ সবের কিছু বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ সকলের সাথে সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।
বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তথ্য বা যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা অত্যাধিক পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার কাছে এটা একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশে আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি বা মোবাইল ফোন/ ইন্টারনেট / ফেসবুক ও অন্যানো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমার মনে হয়েছে, বিষয়টি যেন দেশে মানুষের জীবনযাত্রার একটি অত্যাবশকীয় অংশে পরিণত হয়েছে।
প্রথমে উল্লেখ করতে চাই দেশের মানুষে মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পর্কে। বাংলাদেশের মানুষের প্রায় প্রত্যেকের হাতে এবার দেখলাম হরেক রকমের মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি। অনেকের হাতেই শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ব্রান্ডের এনরোইড ,আই ফোন বা আরও বিভিন্ন ডিজাইনের ফোন। এমন কম লোকই দেখেছি যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে না। সৌদিয়া এয়ারলাইন্স এর বিমানে জেদ্দা থেকে ঢাকা যাবার বিমানে উঠার পর থেকেই দেখলাম যারা এখানে চাকুরী করতে এসেছে তাদের প্রত্যেকেরই হাতে মোবাইল ফোন। প্লেন উঠে দেশে তাদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে ইতিমধ্যেই কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। প্লেন ছাড়ার প্রাক্কালে বিমানে আরোহনের সময় বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বিমানে মোবাইল ফোন ব্যাবহারের উপরও নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা করা হল। কিন্তু কে শোনে সেসব কথা !! সবাইকে দেখলাম দিব্বি ফোনে কথা বলে চলেছে। যাইহোক, এর মধ্যদিয়েই বিমান যাত্রা শুরু করল। বিমান ঢাকা পৌঁছানোর আগে আবার শুরু হল ফোনালাপ। কতক্ষণ পরে বিমান পৌঁছাবে,কোন গেটে তাদের থাকতে হবে ,কে কে আসছে এয়ারপোর্টে ইত্যাদি হরেক রকম ফোনালাপ।
অবশেষে নির্ধারিত সময়ে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করলাম। বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাহিরে এসে অপেক্ষামান আমার শ্যালিকা ও ভায়রা ভাই কে বের করতে হবে। আমার ফোনে রোমিং করা ছিল না। তাই বিমান বন্দরে এক ভদ্রলোকের ‘মোবাইল ফোন’ থেকে কথা বলে তাদের সন্ধান পেলাম। অতঃপর দীর্ঘ যাত্রার পরিসমাপ্তি শেষে বিশ্রামের জন্য তাদের বাসস্থানের উদ্দেশে যাত্রা। গাড়িতে উঠে দেখলাম আমার শ্যালিকা আমার ও তার ভাই বোনদের আমার সুস্থ শরীরে আগমনের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। অর্থাৎ এখানেও মোবাইল ফোনের ব্যবহার !! ক্লান্ত দেহ ও মনে ভাবছিলাম মাত্র কয়েক বছর আগেও যখন মোবাইল ফোন ছিল না তখন আমাদের দেশের মানুষের কিভাবে চলেছে ?
গ্রামের বাড়ি যাবার আগে একদিন ঢাকায় ছিলাম। কিছু কাজে এলিফ্যান্ট রোড ও নিউমার্কেট যেতে হয়েছিল। ঢাকার রাস্তা ঘাটে দেখলাম মানুষ দৈনন্দিন কাজের জন্য মোবাইল ফোন নির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যাবসায়িক কাজ,অফিসের কাজ বা পরিবার ও বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এখন মোবাইল ফোন। এ কারণে দেশের ডাক বা ল্যান্ড টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন প্রায় অচল। ইউনিভার্সিটি বা কলেজের ছেলে মেয়েরা সব সময়ই ফোন কানের কাছে ধরে রেখেছে। রিকশা চালক তার পরিবারের সাথে কথা বলছে আর রিকশা চালাচ্ছে। বাজারে মাংসের দোকানদারও কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোনে কথা বলছে। সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হল যে মোবাইল ফোন যেন এদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি অত্যান্ত আগ্রহ নিয়ে মানুষের এ ‘মোবাইল ম্যানিয়া’ লক্ষ্য করেছি।
গ্রামের বাড়িতে যেয়ে দেখলাম আরো ভয়াবহ ‘মোবাইল ম্যানিয়া’। বাড়িতে ,হাটে বাজারে, গাড়িতে সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে দেদারছে। প্রতি সেকেন্ডেই যেনো শুনা যায় কোনো না কোনো ফোনের রিংটোন। উন্নত দেশে এ ধরণের লাউড রিংটোন পাবলিক প্লেসে কেউ খুব একটা শুনতে পায় না। মানুষের বিরক্তি যাতে না হয় এজন্য সবাই ফোন ভাইব্রেশনে বা সাইলেন্ট মোড দিয়ে রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের কথা আলাদা। কেউ এসব কেয়ার করে বলে মনে হল না। তাই বাসা বাড়ি,বাজার,গাড়িতে বা অফিসে হরহামেশা মোবাইল ফোনের হরেকরকম রিংটোন শুনা যায়। গ্রামের ছেলে মেয়ে বা বয়স্ক নরনারী সবাইকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখলাম। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমাদের এক নিম্নবিত্ত চাচার মেয়েরা আমাদের বাড়িতে আগে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতো। ঐ চাচার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে। কেউ খুব একটা লেখাপড়া জানে না। ছেলেরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাদের বাড়িতে মোট সাতটি মোবাইল ফোন আছে। আমি বিষয়টি জেনে হতবাক হয়ে গেলাম। এ ছাড়া আমার আপন চাচাতো ভায়ের মোবাইলের সংখ্যা আটটি। সে অবশ্য ফোনে টাকা রিচার্জ ও বিকাশ (মোবাইলের মাধমে টাকা পাঠানোর ব্যাবসা) এর ব্যাবসা করে। এ সব দেখে আমি ভাবছিলাম দেশে মোবাইল কোম্পানি গুলি কিভাবে ব্যাবসা ফেঁদে বসেছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা আয় করছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলি। জানিনা সরকার এসব কোম্পানি থেকে ইনকাম ট্যাক্স পাচ্ছে কিনা।
বাড়ির কাছে ঘোনাপাড়া মোড় এখন একটি ব্যাস্ততম এলাকা। এখানে বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। সেই সাথে ইউনিভার্সিটি, বাস স্টেশন ও নির্মাণাধীন রেলওয়ে জংশন। এটি গোপালগঞ্জ -টুঙ্গিপাড়া -খুলনা-বাগেরহাট-পিরোজপুর যাবার রাস্তার একটি জংশন বা ইন্টারসেকশন। এ বাজারে অন্যানো দোকানের সাথে আছে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের দোকান। অনেক দোকানে দেখলাম কম্পিউটারের সামনে ছেলে মেয়েরা বসে আছে। উনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরাও কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে কম্পিউটার বহন করছে। আজকাল ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্যাকেজ কিনতে পাওয়া যায়। বাড়িতে ব্রডব্যান্ড সংযোগও নেয়া যাচ্ছে। টেম্পুতে ঘোনাপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে যাবার সময় ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়েদের কথোপকথন লক্ষ্য করেছি। একজন গাড়ি থেকে নেমে যাবার সময় অপরজনকে বলছে , রাতে ‘নেট’-এ কথা হবে । পরে জানতে পারলাম “নেট ” অর্থাৎ ইন্টারনেট।
আমার শশুরবাড়ি যশোর জেলার শার্শা বেনাপোলেও দেখলাম মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার। বেনাপোলে কাস্টমস ,বর্ডার এলাকা ও সাধারণ ব্যাবসা-বিপনী কেন্দ্রেও দেখলাম সবাই একটি কম্পিউটার সংযোগ করেছে। মানুষ এখানে তাদের কাজকর্মে আধুনিকতার প্রচলন শুরু করেছে।আমার শশুড়বাড়িতে হিসাব করে দেখলাম মোবাইলে ফোনের সংখ্যা মোট বিশটি। আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি ( বয়স নব্বই বছর) আম্মাও একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। ছোট সমন্ধীর স্কুলে পড়া ছেলের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রা ও জ্ঞান দেখে আমি অবিভুত হয়েছি।
দেশ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে শ্যালিকার বাসায় দুদিন ছিলাম। এ সময় ঢাকায় আমার বাল্যবন্ধু ও সম্বন্ধীর স্ত্রী ,তার কন্যারা এবং আমার শ্যালিকা ও তার বান্ধবীগণ পরস্পর কিভাবে যোগাযোগ করে সেটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । এরা সবাই এখন মোবাইল ও “নেট” নির্ভর। নেটের মাধ্যমে সবাই ফেসবুক,ইনিস্টাগ্রাম বা অন্যানো সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের আবার ফেসবুকে যোগাযোগের নিজস্ব ভাষা আছে। এটাকে নেটের ভাষা বলা হয়। এটি আসলে চলতি বাংলা ভাষাকে ইংরেজি অক্ষরে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফেসবুকের ব্যবহার মূলত ফটো পোস্ট করার মধ্যেই সীমিত। ফটো পোস্ট করা ,সেটার উপর মন্তব্য ,পরামর্শ, উপদেশ ইত্যাদির জন্যই যেন ফেসবুক। অবশ্য ,কেউ কেউ আবার আত্মপ্রচার বা বিজ্ঞাপনের হাতিয়ার হিসাবেও ফেসবুক ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে এভাবেই আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। অতি দ্রুত এ প্রযুক্তি আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। দেশে চতুর্থ প্রজন্মের (4G) দ্রুত গতি ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা চালু হতে যাচ্ছে শীঘ্রই। এতে প্রথমদিকে বড় শহরগুলোতে এই সেবা চালু হলেও ক্রমান্বয়ে পুরো দেশে তা বিস্তৃত হবে। এ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভাল ও খারাপ দুই প্রকার জ্ঞানই অর্জন করা যায়। তাই , এ প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার দেশের মানুষের জন্য সুফল না কুফল বয়ে আনছে সেটা সময়ের উপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু করণীয় আছে বলে মনে হয় না।
(ছবি:-সৌজন্যে Newley.com)