ভাল একটি বই আমাদের মননের বিকাশে ঘটায় , কল্পনা শক্তি কে প্রসারিত করে আত্মশুদ্ধির সহায়ক হয় lতাই এর আবেদন প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে অম্লান থাকে l কানাডায় বাংলা ভাষা ও বাংলা বই এবং সাহিত্যের মূলস্রোত কে অম্লান রাখার দৃপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গত ৬ ও ৭ ই আগস্ট এর দুই দিন ব্যাপী বর্ণাঢ্য রুচিশীল আয়োজনের মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হলো ‘ষোলতম টরেন্টো বাংলা বই মেলা’ l দীর্ঘ পনের বছর কানাডায় বাংলা বইয়ের প্রথম দোকান ও প্রতিষ্ঠান ‘ অন্যমেলার ‘ এবং সেই ধারাবাহিকতায় বাংলা বই এর জনপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠান ও বাংলা বইমেলার মূল রূপকার দেশাত্মবোধের আলোকে লালিত শেখ সাদী আহমেদ ভাই এর ঐকান্তিক ও সফল নেতৃত্বে এবং সংশ্লিষ্ট উদ্যোমী কয়েকজনের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলা বই মেলা স্থাপন করেছে বাঙালির ঐতিহ্যর সুদৃঢ় ভিত্তি l মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলা সংষ্কৃতির বিশুদ্ধ আবহে টরেন্টো বইমেলা এই বছর ষোল বছরে পদার্পণ করে l দুই দিনের এই আনন্দমুখর সাংষ্কৃতিক উৎসবে এক হাজারের বেশি অতিথির সমাগম ঘটে l দীর্ঘপথ পরিক্রমায় টরেন্টো বাংলা বই মেলা একটি অন্যতম সাংষ্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে l দুই দিন ব্যাপী এই বর্ণিল তথ্যবহুল মেলা উদযাপনে বাংলা লেখক ও বই পরিচিতির পাশাপাশি বর্ণিল শোভাযাত্রা, সাহিত্য, সংষ্কৃতি বিষয়ক বিশেষ আলোচনা,কবিতা উৎসব, নৃত্য সহ পরিবেশিত হয় বহুমাত্রিক বাংলা কৃষ্টি নির্ভর সাংষ্কৃতিক আয়োজন l
এই উৎসবে শুধুমাত্র টরেন্টো শহর হতেই নয় কানাডার বিভিন্ন শহর হতে যোগদান করেন বরেণ্য লেখক, চিন্তাবিদ সাহিত্যিক কয়েক হাজার অধিবাসী, বই মেলার অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কথা সাহিত্যিক কবি আসাদ চৌদুরীর নেতৃত্বে অন্যান্য কথা সাহিত্যিক, লেখকদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ উদ্বোধনী শোভাযাত্রার মাধ্যমে টরেন্টোর ডেন্টোনিয়া পার্কে বাংলাদেশের.শহীদ মিনারের আদলে স্হাপিত মাদার ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট এ শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন ও বইমেলার আবহ সংগীত পরিবেশন করেন l
বই মেলার প্রথম দিন কানাডার মূলধারার জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশিবংশদ্ভুত কানাডিয়ান এম পি পি ডলি বেগমl
ছয় ই অগস্ট এর রৌদ্রকরোজ্জ্বল উজ্জ্বল সকালে প্রায় এগারোটায় সময় সমবেত শোভাযাত্রা মাধ্যমে লেখক চিন্তাবিদরা ডেন্টোনিয়া পার্কে অমর একুশের শহীদ মিনারের আদলে স্মরণে নির্মিত মাতৃভাষা মনুমেন্টে গমনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় l
এরপর তাঁরা বইমেলার আবহ সংগীত গাইতে গাইতে মূল অনুষ্ঠানস্থলে যাত্রা করেন l দুপুর বারোটায় ৯ ডজ রোডে রয়েল কানাডিয়ান লিজিয়ন হলের মেইন ফ্লোরে অনুষ্ঠান স্থলে ফিতা কেটে বই মেলার অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কথা সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী , সাথে ছিলেন বই মেলার রূপকার শেখ সাদী আহমদ এবং আমন্ত্রিত ও আগত লেখক চিন্তাবিদ সহ অগণিত অতিথিবৃন্দ l এর পর শেখ সাদী আহমেদের রচিত ও বিজয় মামুনের সুরারোপিত বইমেলার সেই আবহ সংগীত পরিবেশিত হয় l দুই দিনের টরেন্টো বাংলা বই মেলার সার্বিক রুচিশীল আয়োজন সেজেছিল বাংলাদেশ ও বাঙালির সংষ্কৃতির ঘরানার এক পূর্ণাঙ্গ আবহে l
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে দুপুর বারোটা তিরিশ মিনিটে সুকন্যা নৃত্যাঙ্গনের আয়োজনের নৃত্য পরিবেশিত হয় l তারপর সুলোলিত কণ্ঠে সংগীত পরিবেশনা করেন টরেন্টোর জনপ্রিয় শিল্পী ফারহানা সান্তা lবেলা একটায় মীর সাব্বির পরিচালিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘রাত জাগা ফুল’ এই চলচ্চিত্র উপস্থাপিত হয় , বিকেল তিনটায় অনুষ্ঠিত হয় জনপ্রিয় সাংষ্কৃতিক সংগঠন ‘উদীচী র বিশেষ ‘ পরিবেশনা l বিকেল সাড়ে তিনটার পরিবেশনায় ছিল কবি তাজুল ইমাম ও কবি জিন্নাহ চৌধুরীর স্মৃতি চারণ ও অসাধারণ কবিতা আবৃত্তি। চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক হাসান মাহমুদ তাঁর বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় জীবনবোধের সত্য দর্শন সম্বলিত ‘ জিহবা ‘ কবিতাটি পরিবেশনা করেন l
বিকেল চারটায় পরিবেশিত হয় কবি ও মুক্তিযোদ্ধা মেহরাব রহমানের উদ্যোগে নান্দনিক উপস্থাপনা ‘উত্তর আমেরিকা কবিতা উৎসব’ l উল্লেখ্য যে এই উৎসবে ছিল তার উদ্যোগে আয়োজিত ষষ্ঠ কবিতা উৎসব যাতে উত্তর আমেরিকাবাসী কবিরা প্রাণবন্ত ভঙ্গিমায় কবিতা আবৃত্তি করেন ।
বিকেল পাঁচটায় উপস্থাপিত হয় নৃত্যানুষ্ঠান , এর পর বিকেল ছয়টায় পর্যায়ক্রমে জনপ্রিয় ‘ কন্ঠচিত্র’ আবৃত্তিসংগঠন ও ‘অন্যস্বর’ আবৃত্তি সংগঠন তাদের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা করেন l ‘অন্যস্বর’ আবৃত্তি সংগঠন টি তাঁদের পোস্টাটার টি বিশেষ ‘সম্মাননা ‘ হিসেবে বই মেলার রূপকার শেখ সাদী আহমেদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তানন্তর করেন l
বিশেষ অথিতি আলোচনা পর্বে মূল্যবান ও প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরী , টরেন্টোর বাংলাদেশ কনসুলেটের কনসল জেনারেল লুৎফর রহমান, এম পি পি ডলি বেগম, চয়নিকা দত্ত, সুলতানা হায়দার, সাদী আহমেদ l
‘অভিবাসী বাঙালির সাহিত্য ও সংষ্কৃতি চর্চা ‘ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য ও সুচিন্তিত, গঠনমূলক মতামত দেন কয়েকজন বরেণ্য লেখক ও চিন্তাবিদ গণ i বক্তারা হলেন সালমা বাণী , হাসান মাহমুদ ,জসিম মল্লিক ,আশরাফ আলী , নাজমুন নেসা পিয়ারী , ফরিদা রহমান, সিরাজুল ইসলাম মুনির , শাম্মি আখতার হ্যাপি ও আশরাফ আলী। রাত নয়টায় পরিবেশিত হয় গান নুতন প্রজন্মের শিল্পী প্রতিষ্ঠার প্রাণবন্ত গান l শিল্পী অমিত শুভ্রর অসাধারণ রাগপ্রধান ও আধুনিক সংগীত পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা উপভোগ করেন l
প্রথম দিনের আয়োজনের স্বতঃস্ফূর্ত ও সুচারু ভাবে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন হিমাদ্রি রায়, অজন্তা চৌধুরী এবং অনন্যা l
বাংলা বই মেলার দ্বিতীয় দিন ৭ ই আগস্ট র সাংষ্কৃতিক আয়োজন শুরু হয় বিকেল তিনটা হতে l প্রথমেই রাসেল রানার ‘হাউসের ধুয়া’ এই ডকুমেন্টরি চলচ্চিত্ৰ প্রদর্শিত হয় l ডকুমেন্টরি টির মূল বিষয়বস্তু হলো ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে সংগীতের জন্যে নিবেদিত প্রাণ কিছু মানুষের ভূমিকা lবিকেল চারটা হতে এক ঘন্টার জন্য শুরু হয় লেখক , লেখা ও নুতন বই বিষয়ক উপস্থাপনা ও আলোচনা l এই পর্যায়ে ঔপন্যাসিক জসিম মল্লিকের পরিচালনায় “নতুন বই” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন মোস্তফা চৌধুরী, জিন্নাহ চৌধুরী, মেহরাব রহমান এবং সিরাজুল ইসলাম মুনির। দুইদিনের এই সুন্দর আয়োজনে আগত অতিথি বৃন্দরা টেবিলে সাজানো বই দেখার কেনার পাশাপাশি এই সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান বিশেষ ভাবে উপভোগ করে l গত দুই বছর মহামারীর কঠোর বাস্তবতায় অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে বইমেলা আন্তর্জালে আয়োজিত হয়েছিলll দীর্ঘ অবরুদ্ধ অপেক্ষার পর সরাসরি এই আনুষ্ঠানিকতায় অবধারিতভাবে তাই প্রচুর অতিথির সমাগম ঘটেছিল l
বিকেল পাঁচটায় মহরম ও রবীন্দ্র মৃত্যু বার্ষিকী কে মূল প্রতিপাদ্য করে দরাজকণ্ঠে অসাধারণ ভাবে কবিতা উপস্থাপন করেন কবি শফিক আহমেদ , এরপর দেবব্রত সিংহের ‘তেজ’ কবিতা অসাধারণ ভাবে আবৃত্তি করেন জ্যোতি সাত্তার।
এর পর পরেই আলো দিয়ে যাই ‘এই শিরোনামের টরেন্টোর শিল্পীরা সুন্দর ভাবে তাঁদের কবিতা ও গান উপস্থান করেন l জনপ্রিয় আবৃত্তির সংগঠন বাচনিক এর আবৃত্তিশিল্পীবৃন্দ তাঁদের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা করেন lবাচনিক তাঁদের পোস্টের এ ‘আমার যখন বই সংগ্রহ করি তখন আনন্’কে সংগ্রহ করি ‘ এই থিমে বই মেলার পোস্টার সাজিয়েছিলেন l
‘অভিবাসীর সেকাল একাল’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা পর্বে আলোচক হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন কবি আসাদ চৌধুরী , মনীষ রফিক ,সৈয়দ নাজমুল হোসেন , মোস্তফা চৌধুরী ,ড জহির সাদেক, শহীদ খন্দোকার টুকু , জিন্নাহ চৌধুরী i বিশিষ্ট বক্তাদের তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপর্ণ, বাস্তবভিত্তিক অভিজ্ঞতা ও নির্দেশনা সমৃদ্ধ সময় পযোগী মতামত দেন l
টরেন্টোর সুকণ্ঠী সংগীত শিল্পী শিখা রউফ ও ফারজানা শান্তা কয়েকটি গান পরিবেশনা করেন l সমাজকর্মী, সংস্কারক ও সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদ খন্দকার টুকু ভাইয়ের একটি অসাধারণ ও বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ।
দ্বিতীয় দিনের সামগ্রিক সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন দিলার নাহার বাবু ও কামরান করিম l তাঁদের প্রাণবন্ত সঞ্চালনা অনুষ্ঠানে অসাধারণ মাত্রা আনে l বই মেলা অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি বিশেষ সাহিত্য সংকলন প্রকাশ হয় lকানাডা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঙালি লেখকদের লেখা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী ,বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সহ কানাডার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি ও উদ্যোক্তারা স্বনাম ধন্য প্রকাশদের শুভেচ্ছা র সন্নিবেশ ঘটেছে lসাহিত্য সংকলন টি যৌথ ভাবে সম্পাদনাত দায়িত্ব ছিলেন অনিরুদ্ধ আলম ও আমি ফারজানা নাজ l
শক্তি , সমৃদ্ধি ও বিশ্বাস বৈভবে বই এই শুদ্ধ প্রত্যয় কে প্রতিপাদ্য করে টরেন্টো বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে iনবীন প্রবীণ লেখক ও বাংলাভাষী সাংষ্কৃতিক কর্মীর সমন্বয়ে পরিপূর্ন রূপ লাভ করেছিল বই মেলা l বই মেলা আমাদের উপলদ্ধি করতে শেখায় আর শক্তিদেয় এক বিশেষ সত্যের ‘এই দুর পরবাসেও অনেক বাঙালি ও বাংলাদেশিরা স্ব তন্ত্র কৃষ্টিনির্ভর ঐতিহ্যকে মননে ধারণ করেন জন্মভূমি বাংলাদেশ কে l কানাডার পরবাসী জীবনে এইভাবে ঐক্যবদ্ধ সৃষ্টিশীল উদ্যোগের আলোকে বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা আর আবহমান কাল ধরে লালিত বাংলার আলোক বিচ্ছুরণ ঘটুক বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার l