লেখার শুরুতে টরন্টো শহরে ঘটে যাওয়া গত সোমবারের ঘটনায় মৃতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে, আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে এবং মৃত ও আহতদের পরিবার পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জানাসচ্ছি। পরমকরুণাময় এদের সবার মঙ্গোল করুন।
আক্রমণকারী আলেক যে সন্ত্রাসী না; সেটা জানার পরে দ্রুতই ধারণা করা হয় তার হয়তো মানসিক কোনো সমস্যা ছিল, এবং তার পূর্বের কিছু তথ্য অনেকের ধারণাকে সেই দিকেই ধাবিত করছে। পুরাপুরি তদন্তের পর আমরা হয়তো সে বেপারে স্পষ্ট হতে পারবো।কিন্তু আমার কথা হলো, তার মানসিক সমস্যা ছিল এবং তার জন্য সে এই কাজ করেছে, এই ধারণার উপর ভিত্তি করে আমরা যেন বর্তমানে আমাদের মধ্যে যাদের মানসিক সমস্যা আছে তাদেরকে বা তাদের পরিবারকে যেন stigmatized বা generalized না করে ফেলি। তাদেরকে যেন খাটো করে না দেখি।
মানসিক রোগে আক্রান্ত সবাই কিন্তু মানুষ খুন করে না বা অপরাধ করে না, বরং সুস্থ লোকেরাই এই কান্ড করে বেশি। যেমন একটি গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৮৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ওন্টারিওতে মোট ৪,৪০২ টি হত্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে শুধু মাত্র ৪% হত্যা সংঘটিত হয়েছে মানসিক রোগে আক্রান্ত বেক্তির দ্বারা। কিন্তু প্রায় দেখা যায় যখন একজন মানসিক রোগীর দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় তখন হৈচৈ বেশি হয়, সেটা কোনো mass murder না হলেও (কিছু বেতিক্রম ছাড়া)। আর, অনেকে মনে করে যে তার পাশের বাড়ির যে মানসিক রোগী সে হয়তো তাকে আক্রমণ করবে। তাছাড়া আমাদের একটা প্রবণতা আছে যে, কেউ যদি শারীরিক, মানসিক বা যেভাবেই হোক প্রতিবন্ধী হলে তাদের দিকে একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকাই এবং এই তাকানোটা শুভ দৃষ্টি নয়। তারাও যে মানুষ সেটা আমরা ভুলে যাই। যাহোক আমি আশা করবো আমরা যেন এদেরকে প্রথমে মানুষ হিসাবে দেখি, তারপর তার কন্ডিশনকে দেখি এবং এদের বা এদের পরিবারকে আমাদের থেকে isolate না করে ফেলি । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভীন্ন মানষিক রোগের ট্রিগার ঘটে এই জাতীয় isolation এবং stigmatization থেকে। আর আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে মানসিক অসুস্থতার দোহাই দিয়ে যেন আসল বা মূল কাজটি ভুলে না যাই।
এবার আসি, আমার মি. আলেক এবং আমাদের, তথা সমাজের কিছু দায়িত্বের বেপার নিয়ে। পুলিশ অফিসার মি. ল্যাম আলেকে কে জীবিত ধরে আমাদেরকে বেশ কিছু কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। সে তাকে মেরে ফেললে আমরা আলেকের মটিভ সমন্ধে কিছুই জানতে পারতাম না, এবং ভবিৎষতে কোনো preventive measure নিয়েও চিন্তা করতে পারতাম না। আপাতত তার সমন্ধে কিছু কিছু তথ্যের মাধ্যমে তাকে নারী বিদ্বেষী, ইন্ট্রোভার্ট, awkward স্বভাবের ইত্যাদি বলা হস্ছে, যদিও এগুলি ওই অল্পকিছু তথ্যের মাধ্যমে মানুষের ধারণা মাত্র। আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে সমস্ত ধরণের তদন্তের পরে আসল কি মোটিভ বেরিয়ে আসে, সে জন্য। তখন বোঝা যাবে তার এই ধরণের horrific হত্যাযজ্ঞের মানসিকতার জন্য শুধু কি সে একাই দায়ী, না কি সমাজের কোথাও কোনো জায়গায় গ্যাপ ছিল।
তার এই হত্যাযজ্ঞ, তার সম্মন্ধে এ পর্যন্ত পাওয়া সীমিত কিছু তথ্য এবং সাম্প্রতিক এই জাতীয় একাকী মানুষের কিছু হত্যাযজ্ঞের ঘটনা থেকে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। আশা করি সময়ে সেগুলির উত্তর পাওয়া যাবে। প্রশ্নগুলি হলো : যেমন তার বাবা মার্ সম্পর্ক কেমন ছিল, তার বেড়ে উঠার পরিবেশটা কেমন ছিল, তার পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল, তার শাররীক, মানসিক, ব্যবহারিক বা মস্তিকের কোনো সমস্যা থেকে থাকলে সেটার কি আদৌ কোনো ডায়াগনসিস হয়েছিল, হয়ে থাকলে সেটা কখন এবং সেগুলির কোনো ট্রিটমেন্ট কি হয়েছিল, তার কি তার সমস্যার বেপারে কোনো insight ছিল, কোনো ট্রিটমেন্ট থেকে থাকলে সেটার follow up কি ঠিকমতো হয়েছিল, সে কি ঠিকমতো ঘুমাতে পারতো, সে কি কোনো ভাবে ছোটবেলায় abused হয়েছে যেটা বাবা মা জানতেন কি না, স্বপ্নে বা বাস্তবে সে কি কখনো traumatized ছিল। আমাদের জীবনে খুবই ছোট ছোট অনেক সুযোগ আছে, যেগুলি আমরা just take it granted for, তার কি তেমন সুযোগ ছিল। যেমন আমরা আমাদের এক ক্লায়েন্টকে একবার একটি বার্থ-ডে কার্ড দিয়েছিলাম, সে বলেছিলো গত ৮/১০ বছরে কেউ তাকে একটি কার্ড দেয় নি, অতএব সেটি তার কাছে অতি মূল্যবান ছিল। আমরা তাকে লাঞ্চ করিয়েছিলাম সে কথা সে দুদিন পরে ভুলে গেলেও ওই কার্ডের কথা ভোলে নি।
ইতিমধ্যে কানাডা আমেরিকার অনেক আরবান প্লানাররা শহর প্রতিরোধের প্রতিবদ্ধকতার কথা বলছেন, নিউয়র্ক শহরে যেটা অলরেডি হয়েছে। সেটা ভালো কথা। তবে সাথে সাথে এটাও ভাবা দরকার মানুষের মনে এক্সট্রিম বা ডেস্ট্রাক্টিভ চিন্তা বন্ধ করার কি প্রতিবদ্ধকতা নেওয়া যেতে পারে। মানুষের মনে স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা করার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলে সেখানে কিছু গ্যাপ তৈরী হতে পারে, আর কখনো কখনো সে গ্যাপের মধ্যে দিয়ে ধংশকারী বা এক্সট্রিম কোনো চিন্তা প্রবেশ করতে পারে যাকে গুলি বন্দুক বা কোনো ব্যারিকেড দিয়ে সব সময় প্রতিহত করা নাও যেতে পারে। সময় এসেছে আমাদের এ বিষয়ে ভাবববার। আগেকার দিনে স্বাভাবিক চিন্তা করার অনেক অবস্থা ছিল, কিন্তু বর্তমানে এই ভোগ-বিলাস এবং অতিরিক্ত যান্ত্রিকতার জীবনে সেই অবস্থা খুব বেশি নেই। আপনারা যদি কেউ সম্প্রতি নতুন X-File দেখে থাকেন তাহলে দেখবেন season ১১- episode ৭ এ Skully এবং Molder জাপানের একটি ১০০% ডিজিটাল রেস্তোরায় যায়। রেস্তোরাঁটি যদিও ১০০% ডিজিটাল, কিন্তু একেবারে জনমানবশূন্য একটি ভুতুড়ে পরিবেশ। আমি এই ডিজিটাল যুগের হলেও ওই ধরণের রেস্তোরায় যাবো না, তাতে আমাকে যত বড়ো ক্ষেত বা সেকেলে বলা হোক। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা বোধ হয় দিন দিন সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছি।
scrolling=”no”>
যাহোক কানাডার আদিবাসীদের ছোট একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। এক দাদা তার নাতিকে গল্প বলছে। দাদা নাতিকে বলছেন মানুষের মধ্যে ভালো দৈত্য আর খারাপ দৈত্য দুটিই বাস করে। এর পর তিনি এই দুই দৈত্যের যুদ্ধের কথা বললেন, এবং এক পর্যায়ে থেমে গেলেন। দুজন কিছুক্ষন চুপ থাকার পরে নাতি দাদাকে বললো। দাদু যুদ্ধে কে জিতলো ? দাদু উত্তরে শুধু বললেন, “it depends who you feed”. ওই আলেক জাতীয় মানুষের মধ্যে যে দানব আছে, আমাদের মধ্যেও সেই দানব আছে। এখন কথা হস্ছে আমাদের সমাজ আমাদের ভিতরের এই দানব জেগে না উঠার জন্য কতটুকু কি করছে এবং সবাই কি সেই সুযোগ পাছে।
আলেকের এই হত্যাযজ্ঞের সাথে যেহেতু মানসিক অসুস্থতার বেপার উঠে এসেছে তাই বলছি এই মানসিকভাবে অসুস্থ বেক্তিদের জন্য আমরা কতখানি কি করছি। অন্নান্ন অসুস্থতার মতো মানুষিক অসুস্থতাও একটি রোগ, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে হেলথ কেয়ারের ফান্ডিং এখনো শিশু পর্যায়ে, যদিও আস্তে আস্তে কিছুটা অগাস্ছে কিন্তু প্রয়জনের তুলনায় এই গতি খুব শ্লথ। এছাড়া homelessness, unemployment বা addiction এর মতো অনেক সমস্যাতো রেই গেছে।
তবে আমি আশা করি আস্তে আস্তে আমি আমার উপরোক্ত প্রশ্নগুলির উত্তর পাবো এবং এই ধরণের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কিছুটা হলেও রোধ হবে কারণ কানাডা একটি শান্তির দেশ, মানবতাকে এরা অনেকের থেকে বেশি মূল্য দেয়।
আমাদের সবারই মন একটু ভারী এবং আমরা কিছুটা আতঙ্কিতও বটে । এই ধরণের একটি অকল্পনীয় ঘটনা এখানে ঘটে যাবে আমরা ভাবিনি। তবে এর মধ্যে দিয়ে টোরোন্টোবাসীদের শান্তশিষ্ট, সহযোগিতা, ধৈর্য এবং দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় মিলেছে। আমি সে জন্য গর্বিত। লেখাটি একান্তই আমার নিজের অভিব্যক্তি। কোনো কারণে কেউ offended feel করলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
সবাই ভালো থাকবেন।
বি. মুকুল